
দুনিয়ার পর আরও দুনিয়ায় ভিড়ে গিয়েছে
সত্যিই কি পৃথিবীর থেকে মুখ ঘুরিয়ে বেঁচে থাকা যাবে? যাবে না, মনে হয়।
অংশুমান কর
স্কটল্যান্ড থেকে কিনে আনা একটি ছোট্ট স্যুভেনির। তাতে এডিনবরা ক্যাসেলের ছবি। রয়েছেন একজন স্কটিশ পাইপারও। তারই পাশে রাখা বার্লিন থেকে কিনে আনা একটি কাপ। তাতে লেখা ‘আই লাভ বার্লিন’। এইরকম সব ছোটখাট স্মৃতিস্মারক। অন্য অনেকের ঘরের মতোই আমার ঘরেও রাখা আছে। নানা সময়ে নানা কাজে দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। যখনই গিয়েছি, টুকটাক ছোটখাট জিনিস কিনে এনেছি, যেমন আপনারা অনেকেই আনেন। এইসব স্যুভেনিরগুলি এখন তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। নাকি আমিই তাকিয়ে রয়েছি তাদের দিকে?
এখন তো উড়ান বন্ধ। চাইলেও কেউ বিদেশে যেতে পারবেন না। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, ক’জন যাবেন বিদেশ? বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা? কেমন একটা ভয় ঢুকে গেছে না? বন্ধু-বান্ধবদের অনেকের ছেলেমেয়েরাই আছে বিদেশে। কেউ গেছে পড়তে। কেউ ছোট ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণার কাজ করতে। আটকে পড়েছে তারা ইউরোপ-আমেরিকার নানা জায়গায়। কী দুশ্চিন্তাতেই না আছেন তাদের বাবা-মায়েরা! কিছু কিছু বন্ধুবান্ধব যাঁরা ভাবছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠাবেন, তাঁদের অনেকেই বলছেন, বিদেশ তো দূরঅস্ত, ভিনরাজ্যেই আর ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠাবেন না।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ভয় অনেকখানি কাটবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ভুবনায়নের ফলে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত যতখানি সহজ হয়ে গিয়েছিল, ততখানিই সহজ থাকবে কি করোনা-উত্তর পৃথিবীতে? সহজেই মিলবে ভিসা? ভিসার জন্য আবেদনের ফর্মে কি এবার নতুন কলাম থাকবে করোনার কোনও ইতিহাস আবেদনকারীর বা তাঁর নিকট আত্মীয়দের আছে কি না তা জানানোর? ভিসা পেয়ে বিদেশের মাটিতে নামলেও, পেরোনো যাবে তো ইমিগ্রেশনের লক্ষ্মণরেখা? স্পষ্ট নয়। কিছুই স্পষ্ট নয় এখন। আমার এক সহকর্মী একদিন আমাকে বললেন যে, এক ‘অবাস্তব’ পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে পড়েছি আমরা। কথাটি খুব মনে ধরেছে আমার। সত্যিই এই পৃথিবীকে ‘অবাস্তব’ই মনে হচ্ছে।
ইউরোপ-আমেরিকায় যতজন বন্ধু আছেন আমার, তাঁদের প্রায় সকলেরই খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এঁদের মধ্যে ভারতীয় যেমন আছেন, অভারতীয়ও তেমন আছেন। না, এঁরা কেউই করোনা আক্রান্ত হননি। নিরাপদেই আছেন। কিন্তু দেখছেন মৃত্যুমিছিল। আমেরিকায় ম্যানহাটনে, যেখানে এই রোগটির এপিসেন্টার, ঠিক সেই ম্যানহাটনেই একটি চমৎকার ফ্ল্যাটে থাকে মৌসুমীদি আর কাজলদা। কাজলদা আবার ডায়বেটিক। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ঠিক আছ তো?” আজ সকালেই মৌসুমীদি জানিয়েছে যে, ওরা এখনও সুস্থ আছে, কিন্তু ওর এক বন্ধু, যে ডাক্তার, মারা গেছেন। বয়স মাত্র ৪৩। তার বাবা এখন ভেন্টিলেশনে। ওদের চেনাজানা অনেকেই মারা গেছেন। কাজলদার অফিসেও একজন মারা গেছেন। বস হাসপাতালে। মৌসুমীদি প্রশ্ন করেছে, “বল, একে কি ঠিক থাকা বলে”? এই রকম অনেক প্রশ্নেরই উত্তর আমরা এখন তো দিতে পারব না। তবে এই মৃত্যুমিছিল আবারও বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, একটি দেশের নাগরিক আর সেই দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়।
মনে আছে আমার প্রথম প্লেনের চড়াই হয়েছিল বিদেশ যেতে গিয়ে। গিয়েছিলাম অক্সফোর্ড। কী যে ভয় ছিল সেই যাত্রা নিয়ে! কতজনকে যে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম প্লেনে ওঠার নিয়মকানুন। কাকে বলে চেকড-ইন ব্যাগ, কাকে বলে হ্যান্ড লাগেজ, কাকে বলে বোর্ডিং পাস, কাকে বলে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস চেকিংই বা কী–- এসবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানাজনকে জিজ্ঞেস করে বুঝে নিতে চেয়েছিলাম। তারপরেও, ভয় কাটেনি। না, আমাকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে কেউ যায়নি। তবে আমার এক ছাত্র মিলটন (সে এখন একটি কলেজের অধ্যাপক) গিয়েছিল। সে শুধু এয়ারপোর্টের বাইরে থেকে আমার এয়ার ইন্ডিয়ার হিথরোগামী প্লেনটাকে উড়ে যেতে দেখেছিল। ফেরার দিনও সে হাজির ছিল হাতে একগুচ্ছ রক্তগোলাপ নিয়ে। আমার অক্সফোর্ড সফরে আমার চেয়ে তার উত্তেজনাই ছিল বেশি। তবে প্লেনের মধ্যে উঠে আমি অনেকক্ষণ বেশ ঘাবড়েই ছিলাম। হিথরোতে নেমেও একটা চোরা-ভয় কাজ করছিলই। বাস ধরে যাব অক্সফোর্ড। ঠিকঠাক পৌঁছতে পারব তো বাস টার্মিনাসে? সেই ভয়। তবে মিথ্যে বলব না, সেই ভয়ের সঙ্গে মিশে ছিল উত্তেজনা। তিরতিরে আনন্দের স্রোত। ভাবছি, এরপর যখন বিদেশে যাব, তখন কি আর থাকবে ওই উত্তেজনা বা আনন্দ? নাকি এরপর থেকে সঙ্গী হবে শুধুই ভয়? শুধুই আতঙ্ক?
অবশ্য দেশে-বিদেশে ভ্রমণ না করেই তো কত মানুষ দিব্বি জীবন কাটিয়ে দেন। আমার জেঠুই যেমন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি কখনও ওঁকে ভিনরাজ্যেও যেতে দেখিনি। পাহাড় আর সমুদ্র উনি দেখতেন ছবিতে আর টিভিতে। কিন্তু চমৎকার ছবি আঁকতেন সমুদ্রের, পাহাড়ের। অসুবিধে হয়নি তো!
বিদেশ যাওয়া এরপর থেকে আর সহজ হবে না এই কথা বলায় আমার এক বন্ধু বললেন, তোমাদের কবিদের বাপু অত বিদেশ যাওয়ার দরকারই বা কী? তোমরা তো ঘরে বসে বসেই বিশ্বভ্রমণ করতে পারো, মনশ্চক্ষু দিয়ে। ভুল নয়, এই কথা। এই যে রবীন্দ্রনাথের তালগাছ। সেও তো কেমন একজায়গায় দাঁড়িয়েই বিশ্বভ্রমণ সেরে নেয়! হাওয়া দিলেই ঝরঝর থরথর পাতাপত্তর কাঁপিয়ে সে ভেবে নেয় আকাশেতে উড়ে বেড়াচ্ছে সে। যাচ্ছে তারাদের এড়িয়ে অন্য কোন সুদূরে। তারপর ওই বিশ্বভ্রমণ শেষ করে সে দিব্বি নিজের ফেরে ঘরে। কিন্তু এই কবিতা যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, যিনি ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া খুঁজে পেয়েছিলেন ‘বিদেশ’, সেই তিনিই ছিলেন এক বিশ্বপরিব্রাজক। কোথায়ই না গিয়েছিলেন তিনি! বাঙালি কবিদের মধ্যে তিনিই সম্ভবত প্রথম গ্লোব ট্রটার! আর বিশ্বকেও তিনি ঠাঁই দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। তৈরি করেছিলেন ‘বিশ্বভারতী’। বিশ্বকে এনে ফেলেছিলেন একেবারে বাংলার উঠোনে! কিন্তু আজ আমরা যেমন বিদেশে যেতে ভয় পাচ্ছি, তেমন বিদেশ থেকে কেউ এলেও তো তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি কোয়ারেন্টাইনে। আমরা কি আমাদের বিদেশি বন্ধুদেরও ঘরে আসার নিমন্ত্রণ করতে ভয় পাব এবার? তাদের ডাকব না ডিনার আর লাঞ্চে?
এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে মনে হল, সত্যিই কি পৃথিবীর থেকে মুখ ঘুরিয়ে বেঁচে থাকা যাবে? যাবে না, মনে হয়। মনে পড়ছে অরুণ মিত্রের একটি কবিতার কথা। কবিতাটির নাম “আমার ঘর”। দেখি অরুণ মিত্র লিখেছেন:
‘অগত্যা পৃথিবীর দিকে ঘুরি, মেঘরোদের দিকে ঘুরি, তাদের বলিঃ তোমরা চলে এসো, সমস্ত ফসলের আহ্লাদ বুকে ধরে চলে এসো। তারাদের ডেকে বলিঃ তোমরা মায়াবী আকাশটা নিয়ে ঢুকে পড়ো। সবাইকে বলিঃ তোমাদের কোনও অন্তরায় এখানে নেই। এখানে যেটুকু কথাবার্তা হয় যেটুকু নিঃশ্বাস বয় তার ওপর ভর দিয়েই এসে পড়ো। এসো পাহাড় এসো সমুদ্র এসো অরণ্য পশুপাখি, আমার প্রাণবায়ু আমার উচ্চারণ সব ফটক খুলে দিয়েছে, এসো।…এই আমার ঘর, ছোট ঘর বটে, কিন্তু কখন দেয়াল ভেঙে ছাত ভেঙে সে দুনিয়ায়, দুনিয়ার পর আরও দুনিয়ায় ভিড়ে গিয়েছে। আমার প্রিয়রা তোমরা যেখানেই থাক, তোমাদের সবার ঠাঁই আছে আমার এই ঘরে’।
আমার মনে হয়, আমি এই কথাগুলিই আমার বিদেশি বন্ধুদের জন্য চিৎকার করে বলি। বলি, এসো, এসো আমার ঘরে। ও পাহাড়, ও সমুদ্র, ও অরণ্য, ও পশুপাখি–- এসো আমার ঘরে। আসলে আমার বন্ধুদের কাউকে কাউকে তো দেখে সত্যিই আমার মনে হয় এ একটা পাহাড়, ও তো অ্যাটলান্টিক সিটির সমুদ্র, ও জয়পুরের জঙ্গল, আর ওরা দু’জন দু’টি হরিয়াল! এই অন্তরিন দিন কেটে গেলে, চৌকাঠ ডিঙোতে কেবল বুঝি নিয়মের কড়াকড়িই হবে? ছোট্ট ঘরে অনেকজনার বসত হবে না?
পড়ুন, আগের পর্বগুলি…
দূরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়, ডাকলে দরজায় আসে না কেউ
আমি কি এ হাতে কোনও পাপ করতে পারি?
শিশুদের ভাল রাখার উপায় সম্বন্ধে যে দু-একটি কথা আমি জানি
কেরল পারলে, বাকি দেশ পারবে না কেন?
বান্দ্রার পরে আর শুকনো কথায় চিঁড়ে ভিজবে কি?