Latest News

ঘরের ভিতরে ঠিক কী কী আছে এখনও অজানা

চিনি তো? যে ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে রয়েছি, সেই ঘরটিকে আমি চিনি তো?

অংশুমান কর

এইবার ভয় লাগছে। না, কবে এই অন্তরিন দশা থেকে মুক্তি পাব সেজন্য নয়। ভয় লাগছে অন্য কারণে। মনে হচ্ছে এই যে ঘরের মধ্যে আমি আছি, এই ঘরটিকে আমি চিনি তো? অন্তরিন জীবনের প্রথম দিকে এই রকম অদ্ভুত একটি চিন্তা আমার পেটের কাছে ছুরি উঁচিয়ে ধরেনি। কিন্তু এখন তিরতিরে একটা ভয়ের স্রোত শিরদাঁড়া দিয়ে বয়েই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, চিনি তো? যে ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে রয়েছি, সেই ঘরটিকে আমি চিনি তো?

ঢুকলাম একদিন রান্নাঘরে। চা বানাব। এমনিতে আমি চা বানাই মাঝেসাজে। কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকার সময়। কিন্তু এই বর্ধমানের বাসায় আমি চা খেতে ইচ্ছে হলে মাইক্রোআভেনে দুধ গরম করে তাতে টি-ব্যাগ ফেলে নিতাম। কিন্তু এইবার ঢুকলাম ওই নকল টি-ব্যাগের বিস্বাদ চা নয়, সত্যিকারের চা-পাতা ফেলা চা বানাতে। ঢুকেই হঠাৎ মনে হল, এই রান্নাঘরটিকে আমি চিনি তো? হ্যাঁ, চিনিই তো। খাবার গরম করতে রোজই ঢুকি। দুধ গরম করি। কিন্তু তাও মনে হল অচেনা। এক্কেবারে নতুন। মনে হতেই একটা চোরা ভয়ের স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া দিয়ে। একটু পরেই বুঝলাম এই যে ভয় পেলাম তার কারণ হল আমি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোথায় রাখা আছে চা-পাতা রাখার কৌটোটি! ওহ, তাহলে এই ব্যাপার! আমার পুরুষতান্ত্রিক মন তাহলে ভয় পেয়েছে। ভেবে খানিক সান্ত্বনা দিলাম মনকে।

কিন্তু একদিন পরেই আবার ভয়। জানলার পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল, চিনি আমি এই পর্দাগুলোকে? চিনিই তো। আমিই তো কিনে এনেছিলাম এই পর্দাগুলো। নিজে পছন্দ করে। আমার রুচি নিয়ে বেশ খানিকটা হাসাহাসিই করেছিল বন্ধুবান্ধবরা। আমি সবাইকেই ডেকে ডেকে তখন জিজ্ঞেস করছিলাম, পর্দাগুলো ভাল হয়েছে তো? সেও হল প্রায় বেশ কয়েকবছর। আমারই কেনা পর্দা, চেনা পর্দা, তাও এমন অচেনা লাগছে কেন? তাহলে কি এই অন্তরিন অবস্থা মনের গভীরে ছাপ ফেলল কোনও? ফোন করব নাকি চেনাজানা কোনও সাইকোলজিস্টকে?

এইসব ভাবি। তারপর দেখি, না, সবই ঠিকঠাক আছে আগের মতো। রান্নাঘরটিকে অচেনা লাগছে না আর। পর্দাগুলোকেও মনে হচ্ছে, এই তো, চেনাই তো। সেই যে সিটি টাওয়ারের পাশের একটা দোকান থেকে কিনলাম! যাক, সব ঠিকঠাক তাহলে।

কিন্তু না, দু’দিন যেতে না যেতেই আবারও ভয়। ঝাঁট দিচ্ছিলাম নিচু হয়ে বসে। না, ভাববেন না যেন কাজকর্ম সমান সমান ভাবে ভাগ করা হয়েছে আমাদের ঘরে। ঘরের কাজ বেশিরভাগই করছেন আমার স্ত্রী। বাইরের ‘জরুরি’ কাজগুলো আমি। তবে, টুকটাক গেরস্থালির কাজ আমিও করছি। তারই অঙ্গ হিসেবে কখনও বাসন মাজা, কখনও ওই ঝাঁট দেওয়া। নিচু হয়ে বসে ঝাঁট দিতে দিতে হঠাৎ মনে হল ডাইনিং টেবিলটার নীচে রয়েছে একটা জঙ্গল। এই বোধহয় বেরিয়ে এল বুনো কুকুর আর রোমশ ভাল্লুক। এইরকম মনে হচ্ছে কেন? কবিতা লেখার ঘোরটি আসছে নাকি? জন্ম নেবে নাকি একটা নতুন কবিতা? তাই মনে হচ্ছে ডাইনিং টেবিলের নীচে রয়েছে একটা জঙ্গল? না, তখন তো এলই না। দিন পেরিয়ে, রাতও পেরিয়ে গেল, তাও কবিতা এল না। হল টা কী আমার?

এরপর দু’দিন আবারও ঠিকঠাক। আবারও ভাবলাম, যাক। বাঁচা গেছে। আপদ বিদেয় হয়েছে। কিন্তু আপদ বিদেয় হয়নি। ঘাপটি মেরে সে বসেছিল ঘরেরই কোনও একটা কোণে। টের পেলাম স্নান করতে গিয়ে। স্নান করছি। হঠাৎ মনে হল আরে, এই বাথরুমটার মতো এত বড় ভয়্যার আর তো কেউ নেই পৃথিবীতে! এ যে সব দেখছে বছরের পর বছর ধরে। ব্যাস, আর যায় কোথায়! আবার ওই চোরাস্রোতের মতো ফিরে এল ভয়। মনে হতে লাগল এত বছর ধরে যত বাড়ি, যত কোয়াটার্স, যত গেস্ট হাউস, যত হোটেলে থেকেছি সেই সব জায়গার বাথরুমগুলি একটা একটা ভয়্যার। ওহ! বাথরুম তো আবার বলা যাবে না। নানা জায়গায় এর তো আবার নানারকম নাম। আমাদের বাড়িতে এসেও তো কেউ কেউ বলেন ‘ওয়াশরুমটা কোনদিকে?’ এইসব কথা মনে পড়তেই রাগ গেল আরও বেড়ে! মনে হল ধুত্তোর, রাখ ব্যাটা তোর কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম। তোর ব্যবস্থা আজ আমি করছি বাথরুম। কিন্তু ওই এক মুহূর্তই! তারপরেই রাগ নেমে গেল পায়ের তলা দিয়ে, মিশে গেল, যাকে আমার ঠাম্মা বলতেন শান বাঁধানো মেঝে, সেই শান বাঁধানো মেঝেতে। বাথরুমের বিরুদ্ধে কি আর পুলিশ ডায়েরি নেবে? নেবে না! আর আমাদের গোপন সব কিছুই তো, শুনছি নাকি এই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আর হালের এই জুম-এর কারণে, চলে যাচ্ছে তথ্য-মাফিয়াদের হাতে! কোন পুলিশ এফআইআর নেবে তাদের বিরুদ্ধে?

কিন্তু, এইরকমটা আমার হচ্ছে কেন? তিন-চারদিন ধরে গভীর অনুসন্ধান করে আমি অবশেষে খুঁজে পেয়েছি কারণ। কবিতা পড়ার ফল এটা। প্রচুর কবিতা পড়ছি তো এখন। তারই শাস্তি। কিছুদিন আগে পড়েছিলাম আলোক সরকারের একটি কবিতা। এই যে নতুন রোগ আমার সেই রোগটি ওই কবিতাটির দান। এই চোরাস্রোতের মতো ভয় ওই কবিতাটিরই উপহার। কোন কবিতা? “প্রেত”। পড়ুন আগে। তারপর বলছি একটি কথা।

‘ঘরের ভিতরে ঠিক কী-কী আছে

এখনও অজানা। অথচ আমার

তিরিশ বছর হল এই ঘরে বাস। খুব কাছে

যা কিছু রয়েছে তাকে চিনি। কালকের কেনা

ছবির বইটা, সাদা চিরুনিটা, জানলার

সবুজ রঙের পর্দা–এইসব। কিন্তু কোনখানে

শীতল ভয়ের মতো মনে হয়। মনে হয় নীরক্ত অচেনা

আরও কিছু আছে মূক দীর্ঘশ্বাস! যথাসময়েই

জানাবে নিশ্চিত দাবি। একদিন দুপুরবেলায়

খাটের তলার থেকে পেয়েছি একটি চিঠি, কোনও নাম নেই

কিন্তু সাদা ধূসর অক্ষর থেকে ষোল বছরের

একটি কিশোর ধুধু অস্পষ্ট ধূসর মৌনতায়

প্রেতের মতন স্তব্ধ জেগে উঠেছিল’।

জানি, কবিতাটি পড়ে বিশুদ্ধবাদীরা এক্ষুনি বলবেন ‘মৌনতা’ শব্দটা হয় না, হয় না, হয় না। আরে বাবা, কবিদের জন্য সব হয়। আর্ষ প্রয়োগ। তাই না? এই তর্ক ছাড়ুন তো। বরং অন্য একটি কথা বলি। এই যে ঘর হঠাৎ অচেনা লাগছে সে কি আসলে এই ঘরে এক প্রেত রয়ে গেছে বলে? এ কি পুরোনো আমির প্রেত? যে আমিকে রোজই আমি একটু একটু করে মেরে ফেলি, সেই আমির প্রেত? যে আমি মরে, আর রোজই হয়ে ওঠে প্রেত? সেই প্রেতই কি ভয় দেখাচ্ছে আমাকে? ফিশফিশ করে আমার কানের কাছে বলছে, “নিজের অতীতকে মেরে ফেলব বললেই কি অত সহজে মেরে ফেলা যায়?” ঠিকই। যায় না। এ বড় কঠিন কাজ। এতকাল ধরে নিজের অন্দরের ঘরটিতে কত কত নিজেরই মৃতদেহ লুকিয়ে রেখেছি বলেই কি আজ এই ভয়? তাই কি মনে হচ্ছে এই বাহিরের ঘরটিতে ঠিক কী কী আছে এখনও অজানা?

পড়ুন, আগের পর্বগুলি…

দূরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়, ডাকলে দরজায় আসে না কেউ

একটা পূর্বদিক বেছে নিতে হবে

খুব সহজেই আসতে পারে কাছে…

আমি কি এ হাতে কোনও পাপ করতে পারি?

খসে যেত মিথ্যা এ পাহারা…

যতবার আলো জ্বালাতে চাই…

দাদাগিরি ‘আনলিমিটেড’

লকডাউন কি বাড়ানো উচিত হবে?

শিশুদের ভাল রাখার উপায় সম্বন্ধে যে দু-একটি কথা আমি জানি

সময়, সবুজ ডাইনি

কেরল পারলে, বাকি দেশ পারবে না কেন?

টাটকা মাছ কেনে প্রতিদিন?

যেকথা বলিনি আগে

বান্দ্রার পরে আর শুকনো কথায় চিঁড়ে ভিজবে কি?

You might also like