
টাটকা মাছ কেনে প্রতিদিন?
আমরা ভাগ্যবান। এই রকম সুরক্ষিত ক্যাম্পাসে যাঁরা আছেন, তাঁরা অনেকেই ভাগ্যবান। বাজার আজ বাড়ির দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাড়িতে কাঁচা সবজি, মাছ পৌঁছে দিচ্ছে বলে শুনেছি। কিন্তু সকলের এই সৌভাগ্য হয়নি। তাঁদের বাজারে যেতেই হচ্ছে। কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই তাঁরা বাজারে যাচ্ছেন।
অংশুমান কর
বাজারে যেতে ভয় করে এখন। অথচ না গিয়েও উপায় নেই! লকডাউনের এই পর্বে এখনও পর্যন্ত বাজারে গিয়েছি মোটে তিনদিন। ভাবছেন যে, প্রচুর জিনিস কিনে রেখে দিয়েছি ফ্রিজে আর তাই দিয়েই চালিয়ে নিচ্ছি। তাই তো? না, মোটেই তা নয়। অত বড় ফ্রিজই নেই আমাদের বাড়িতে! তাহলে চলছে কী করে? বলছি ধীরে।
প্রথম দিন বাজারে গিয়েই যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছি একটি দৈনিক সংবাদপত্রে। অনেকেই সেই লেখাটি ইতিমধ্যেই পড়েও নিয়েছেন। তাই সেই অভিজ্ঞতার আর পুনরাবৃত্তি করছি না। লকডাউনের প্রথম দু-একদিন বাজারের যে ছবি দেখা গিয়েছিল তাতে অনেকেই তো বিষম ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মানার কোনও ব্যাপারই ছিল না প্রথম দু-একদিন আমাদের রাজ্যের বেশ কয়েকটি বড় বড় বাজারে। ঘাবড়ে গিয়ে অনেকেই এই কথা বলতে শুরু করেছিলেন যে, বাজারই বন্ধ করে দেওয়া হোক। এইটে কিন্তু আমার কক্ষনো মনে হয়নি। আমার বরং মনে হয়েছিল যে, মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে আর পুলিশকে বাড়াতে হবে নজরদারি। সেই কাজ খানিকটা হলেও হয়েছে। হাতের কাছে কোনও পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু যেটুকু ছবি সোশ্যাল মিডিয়া আর খবরের কাগজের দৌলতে সামনে এসেছে তাতে কেন জানি না আমার মনে হয়েছে যে, গ্রামের মানুষেরা এই বাজার-হাটে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটু বেশিই সচেতনতা দেখিয়েছেন। সুন্দরবনের একটি ছবি অনেকেই হোয়াটসঅ্যাপে দেখেছেন। কী চমৎকারভাবে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে কেনাকাটা করছেন লোকজন। আমার গ্রাম বেলিয়াতোড়েও একটি জায়গাতেই বসত যে হাট তাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামেরই নানা প্রান্তে। যাতে করে এক জায়গায় একাধিক মানুষের জমায়েত আটকানো যায়। এটি খুবই জরুরি একটি আয়োজন। আমাদের রাজ্যে পুলিশও এখন অনেক সচেতন হয়ে বাজারে এই ভিড় আটকানোর চেষ্টা করছে। দেখাই যাচ্ছে তা টিভিতে আর সোশ্যাল মিডিয়ায়। তবে পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা ভাল হবে যখন মনে হচ্ছিল তখনই ফুলের বাজার খুলতেই গোলমাল পেকেছে। পুলিশ মাইক নিয়ে প্রচার করছে। বিক্রেতারা মাস্ক পরে ক্রেতাদের দূরত্ব বজায় রাখতে কাতর অনুরোধ করছেন। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! কে শোনে কার কথা! আমরা নিজেরাই যদি লকডাউনের এতগুলো দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও না মানি নিয়ম, তাহলে লকডাউন ওঠানোই বা যাবে কীভাবে?
কথায় কথায় কোথায় চলে গেল লেখা। দেখছি, এই অন্তরিন অবস্থায় অনেকের মতো অন্যকে দোষারোপ করার স্বভাব আমাকেও পেয়ে বসছে! ফিরে যাই গোড়ার কথায়। বাজারে না গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছি কী করে? আমরা থাকি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনে। তারাবাগ এই জায়গাটির নাম। সুরক্ষিত ক্যাম্পাস। তাই প্রথম দিনে ভয় ছিল যে, সবজিওয়ালারা যাঁরা নিয়মিত আসতেন আমাদের ক্যাম্পাসে আনাজপত্র বিক্রি করতে, তাঁরা বোধহয় আর আসবেন না। প্রথম দু’দিন তাঁদের দেখাও পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে তাঁরা কিন্তু রোজ আসছেন। আমরা ভাগ্যবান। এই রকম সুরক্ষিত ক্যাম্পাসে যাঁরা আছেন, তাঁরা অনেকেই ভাগ্যবান। বাজার আজ বাড়ির দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাড়িতে কাঁচা সবজি, মাছ পৌঁছে দিচ্ছে বলে শুনেছি। কিন্তু সকলের এই সৌভাগ্য হয়নি। তাঁদের বাজারে যেতেই হচ্ছে। কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই তাঁরা বাজারে যাচ্ছেন। যারা এখন সবজি বিক্রি করছেন, তাঁদের কেউ কেউ ঈর্ষাও করছে কিন্তু! ইন্টিরিয়র ডেকরেশনের কাজ করেন এক ভদ্রলোক। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কাজ নেই তাঁর। হাতে থাকা কাজগুলি সব বন্ধ। তাঁর সঙ্গে দিন-আনি-দিন-খাই ভিত্তিতে কাজ করেন যাঁরা, তাঁদেরও রোজকারপাতি নেই। তিনি বললেন, “এখন ভাল আছেন শুধু সবজিবিক্রেতারা। ওদেরই বাজার। কিন্তু, দাদা, বলুন তো, এই বয়সে কি আর ঠেলা নিয়ে সবজি বিক্রি করা পোষায়? আর কোনও কাজ নেই এখন, সবাই কি তবে সবজিই বিক্রি করবে?” কী বলব জানি না। ওই আবার জীবন নাকি জীবিকা–- কোনটি আগে সেই প্রশ্ন। অবস্থা শাঁখের করাতের মতো। তবে আমাদের রাজ্যে ধীরে ধীরে বেশকিছু কর্মক্ষেত্রকে নিরীক্ষামূলকভাবে উন্মুক্ত করা হচ্ছে–- এইটা একটা আশার কথা।
মাঝে মাঝে ভাবছি তাঁদের কথা বাজার করা যাঁদের নেশা। যেমন আমার বন্ধু রজতেন্দ্র। রোজই ভাবি ওকে জিজ্ঞেস করব যে, বাজারে না গিয়ে কেমন আছে ও? বা রোজই কি কোনও একটা ছুতোয় যাচ্ছে বাজারে? ওর সঙ্গে ফোনে কথা হল দু’দিন। লেখাপত্র নিয়েই কথা হল বেশি। বাজারের প্রসঙ্গটি তুলতেই ভুলে গেলাম। ওর মতোই যাঁদের কচি লাউয়ের গায়ে লেগে থাকা দু-এক ফোঁটা শিশিরকে মনে হয় অমূল্য মুক্তোর দানা, তাঁরা কি একটু মুষড়ে আছেন এখন? এই পরিস্থিতি কেমন থাকতেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-– ভাবছি সেকথাও। বাজার করা তো ছিল ওঁদেরও নেশা। না, ঠিক নেশা নয়। নেশার অতিরিক্ত কিছু। আমার বাবাও বাজারে যেতে খুব ভালবাসতেন। ওঁর পেছনে পেছনে সঙ্গী হিসেবে যেত সাধন, সেই সাধন যাঁকে নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখেছি বছর দুয়েক আগে। বাবা নেই অনেকদিন। এখন সাধনও নেই। দেখছেন, বাজারের কথা বলতে বলতে কোথায় আবার চলে গেলাম!
অনেকেই হয়তো ভাবছেন যে, বাজার নিয়ে এত যে কথা বলছি, আমি কি বাজার করি নিয়মিত? অনেকেই দেখেছি এমনটা ভাবেন যে, যাঁরা আঁকেন, লেখেন, সিনেমা বানান, তাঁরা বোধহয় বাজার করেন না! আমি প্রায় না করারই দলে। তবে মাঝে মাঝে বাজারে যাই বইকি! মনে আছে একদিন আমার এক ছাত্র আমাকে বাজারে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, “স্যার, আপনি বাজারও করেন?” আমি তাকে পাল্টা বলেছিলাম, “শুধু ডালভাত রোজ রোজ খেতে পারি না বলে মাঝে মাঝে করি।’’
তবে রজতেন্দ্রর মতো অনেক কবিই কিন্তু রীতিমতো ভালবাসেন বাজার করতে। মনে পড়ছে অকালপ্রয়াত কবি সুব্রত চক্রবর্তীর কথা। আমাদের এই বর্ধমান শহরেই থাকতেন তিনি। অধ্যাপনা করতেন বর্ধমান রাজ কলেজে। আমি শহরে আসার অনেক আগেই বাংলা কবিতার এই এক চিরস্থায়ী নক্ষত্র কিছুদিন ‘রোদে-জলে/ জোৎস্নালোকে থেকে’ গোলাপ ঝরে যেতে দুঃখ পায় কি না এই প্রশ্ন কবিতায় তুলে নিজেই ঝরে গিয়েছিলেন। বাজারের অনুষঙ্গ মিশে আছে ওঁর একটি কবিতায়। কবিতাটির নাম “কবির ঘর-গেরস্থালি”। সেই কবিতায় সুব্রত চক্রবর্তী লিখেছিলেন:
‘কবি তো সন্ন্যাসী নয়, ঘর-গেরস্থালি করে,
টাটকা মাছ কেনে প্রতিদিন–
আর লক্ষ পচা-শব্দ, খুদে লাল পিঁপড়ের মতন
কবির মগজ খুঁড়ে চলে যায় অন্ধকারে,
বেলা-অবেলায়’।
এখন বোধহয় বাজারকেই নিজেদের প্রেমিকা মনে করেন যে কবিরা তাঁরাও আর রোজ টাটকা মাছ কিনতে পারছেন না। এই অন্তরিন অবস্থায় তাঁদের মাথার মধ্যে শুধু ওই খুদে লাল পিঁপড়ের মতো লক্ষ পচা শব্দ সরু সরু পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে তারা কুটুস করে কামড় দিচ্ছে কবিদের মাথায় আর জিজ্ঞেস করছে, সবাই কি তাহলে সবজিই বিক্রি করবে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনই আমাদের কাছে নেই। শুধু প্রশ্নটা আছে। লাল পিঁপড়ের কামড়টা আছে। আর লাল পিঁপড়ের কামড়ের যে কী জ্বালা, যাঁরা সেই কামড় একবার খেয়েছেন, তাঁরা জানেন।
আগের পর্বগুলি…
দূরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়, ডাকলে দরজায় আসে না কেউ
আমি কি এ হাতে কোনও পাপ করতে পারি?