
সময়, সবুজ ডাইনি
গরিব মানুষদের মেয়েদের একটা অংশ কিন্তু খুবই খারাপ আছেন। দুশ্চিন্তায় আছেন সময়ের সঙ্গে এই যুদ্ধে। টিভিতে দেখছিলাম কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল বানানো এক বৃদ্ধাকে। তিনি বলছিলেন, “এমনিতেই মাসে রোজকার দেড়হাজার টাকা। এখন তাও নেই। খাব কী?” কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর?
অংশুমান কর
সময়ের সঙ্গে যেন একটা যুদ্ধ চলেছে। দিন যেন আর কাটতেই চায় না। আর কতদিন এই ঘরবন্দি? ক্যালেন্ডার দেখছেন অনেকেই। অনেকে ঘড়ির কাঁটার ঘোরা দেখছেন। ঘড়ি বলতেই মনে পড়ল যে, আমাদের ঘরের দু-দুটো ঘড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল ক’দিন আগে। মানে এই অন্তরিন দশা শুরু হওয়ার পরে-পরেই। তার একটি ঘড়ি রাখা থাকত বাথরুমে। স্নান যেন ঠিক সময়ে হয়, যেন ঠিক সময়ে ক্লাসে ঢোকা যায় (এই বদ অভ্যেসটি ছাড়তে পারলে ঘড়ির ওপর অতখানি নির্ভরশীল না হলেও চলত বটে)–- তাই এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। আর একটি ঘড়ি আমার বাবা কিনেছিলেন, সেই কত কত বছর আগে। সেই ঘড়িটি রাখা আছে ডাইনিং স্পেসে। বয়সে সব ঘড়িগুলির চেয়ে অনেক অনেক বড় দাদামশাই এই ঘড়িটিই আমাদের ঘরের বড়বাবু। সব কিছুর ওপর তার কড়া নজর। তিনি অচল হলে মহা মুশকিলে পড়ি আমরা। কিন্তু, একই সঙ্গে কোন জাদুমন্ত্রবলে কে জানে, দু’টি ঘড়িই অচল হল। কারণ, মনে হল, তুচ্ছ। ব্যাটারির মেয়াদ, মনে হল, শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু, ব্যাটারি পাই কোথায়? বাড়ি থেকে তো প্রায় বেরোচ্ছিই না। একদিন বেরিয়ে বাজার করার সময় দু’টি মুদিখানায় খোঁজ নিলাম। নেই। ব্যাটারি শেষ! দু’টি ঘড়ির কোনওটিরই কাঁটা ঘুরল না!
এই অন্তরিন অবস্থায় ঘড়ির কাঁটা সবার অবশ্য সমান জোরে ছুটছে না। প্রথম দিকে অনেক মিম বেরিয়ে গিয়েছিল এই সময় কাটানোর কঠিন চ্যালেঞ্জটিকে নিয়ে। কেউ কেউ বিস্কুটের ফুটো গুনছেন। গোটা ঘরের জানলার শিক গুনছেন কেউ কেউ–- এইসব আর কী! পরে দেখা গেল যে, না, এটা সবার জীবন নয়। চাকরি চলে গেছে ইতিমধ্যেই অনেকেরই। তারা এই বিলাসিতা দেখানোর জায়গাতেই নেই। চাকরি যাদের এখনও আছে, তাদের অনেকেই চাকরি বাঁচাতে মরিয়া। কর্পোরেটও এই সুযোগে নিঙড়ে নিচ্ছে তাদের। কারও কারও তো চব্বিশ ঘণ্টাই ওয়ার্ক ফ্রম হোম। না, আমি সেইসব চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আশাকর্মী, পুলিশকর্মী, টেলিকমকর্মী, বিদ্যুৎকর্মী, ব্যাঙ্ককর্মী, সাংবাদিক বা অন্যান্য জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কথা বলছি না। এঁরা লকডাউনের প্রথমদিন থেকেই জানতেন যে, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সমানতালে তাল মিলিয়ে ছুটতে হবে তাঁদের। ছুটেছেনও বটে তাঁরা। প্রাণকে বাজি রেখে। এখনও ছুটছেন। এঁদের বাইরে যারা অন্যান্য নানা সংস্থায় কাজ করেন, তাদেরও শুরু হয়ে গেছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। আমি তাদের কথা বলছি। এদের অনেকেরই নাভিশ্বাস অবস্থা। নির্মমভাবে এরা শোষিতই হচ্ছেন। হ্যাঁ, সচেতনভাবেই ‘শোষিত’ শব্দটি লিখলাম। অনেক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও শুরু হয়ে গেছে অনলাইন ক্লাস। ক্লাস-টাস নিয়ে, লেখালেখি আর আরও সব টুকটাক কাজটাজ সামলে সন্ধের দিকে আমিই এক একদিন বেদম হয়ে পড়ছি। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল রাখা হয়ে পড়ছে মুশকিল!
তবে সমাজ যে কী নির্মমভাবে পুরুষতান্ত্রিক, এই অন্তরিন অবস্থা তা দেখিয়ে দিয়েছে। চাপ পড়েছে মেয়েদের ওপর সবচেয়ে বেশি। রান্নার লোক নেই, কাজের মাসি নেই। রান্নাবান্না, ঘর ঝাঁট দেওয়া, মোছা, বাসনমাজা সব একা হাতেই করতে হচ্ছে অধিকাংশ মহিলাকে। ঘড়ির কাঁটা তাদের জন্য একটু বেশি জোরেই ছুটছে! হ্যাঁ, সবার অবশ্য একই অবস্থা নয়। কারও কারও বাড়িতে কাজের লোকেরা এখনও আসছেন। আমাদের বাড়িতেই একদিন মাসি এসে হাজির। তার আর নাকি বাড়িতে থাকতে ভাল লাগছে না। তাছাড়া তিনি (গুজব) শুনেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী নাকি আকাশ থেকে কী একটা ওষুধ স্প্রে করে দিয়েছেন, এইবার করোনাসুর বধ হল বলে! তাই তিনি সশরীরে এসে উপস্থিত। তাকে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাড়ি পাঠানো হল প্রায় এই প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়ে যে, লকডাউন না উঠলে তিনি আর আসবেন না। দেখা যাক, তিনি প্রতিজ্ঞারক্ষা করেন কি না! তো, সেইসব বাড়িতে যেখানে এভাবে কাজের মাসিরা স্বেচ্ছায় আসছেন বা আসতে বাধ্যই হচ্ছেন (দুর্ভাগ্যজনকভাবে) এখনও, সেই বাড়িগুলির গিন্নিরা একটু শান্তিতে আছেন বইকী! তারা হয়তো সত্যিই ভাবছেন কত আর সিরিয়ালের পুরনো এপিসোডগুলো ঘুরেফিরে দেখা যায়! অবশ্য বাড়িতে বাচ্চা থাকলে এদের শান্তিও উধাও! তবে ভাবুন তো একবার সেইসব মহিলাদের কথা, যারা রান্নাবান্না, বাসন ধোওয়া, ঘর মোছার কাজও করছেন আবার ওয়ার্ক ফ্রম হোমও করছেন। হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জীবনসঙ্গীরা তাদের সাহায্য করছেন বটে। তবে তার সংখ্যা কি খুব বেশি হবে? কে জানে! এই বিষয়টি নিয়ে একটি চমৎকার হিন্দি গানের ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরছে। অন্তরিন দিনগুলিতে ‘ডালভাত’ বানানোয় যেন লিঙ্গসাম্য থাকে সেই আবেদন নিয়ে বানানো ভিডিও। কেউ না-দেখে থাকলে, দেখে নিতে পারেন।
কাজে যে মাসিরা আসছেন না, তাদের নিয়েও হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরছে অডিও, ভিডিও। তারা নাকি খুব শান্তিতে আছেন। কে জানে! গরিব মানুষদের মেয়েদের একটা অংশ কিন্তু খুবই খারাপ আছেন। দুশ্চিন্তায় আছেন সময়ের সঙ্গে এই যুদ্ধে। টিভিতে দেখছিলাম কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল বানানো এক বৃদ্ধাকে। তিনি বলছিলেন, “এমনিতেই মাসে রোজকার দেড়হাজার টাকা। এখন তাও নেই। খাব কী?” কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর?
তবে হতাশ হলে তো চলবে না। সময় তো চিরকাল মানুষকে বারেবারে এইভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ঘড়ির সঙ্গে মানুষের লড়াই তো আজকের নয়, ঘড়ি আবিষ্কার হওয়ার আগে থেকেই ঘড়ির সঙ্গে মানুষের এই লড়াই চলছে। এই কথা লিখতে লিখতেই মনে পড়ছে রণজিৎ দাশের একটি কবিতার কথা। “সময়, সবুজ ডাইনি”। আসুন, পড়া যাক সেই কবিতার কয়েক ছত্র:
‘সময়, সবুজ ডাইনি
পৃথিবীর উপকন্ঠে থাকো।
নাবিকের হাড় দিয়ে
সন্ধ্যার উঠোনে তুমি
ভাঙা জাহাজের ছবি আঁকো।
এ ছবি ডিঙিয়ে যারা ঘরে ফেরে
তারাই তোমার
অনন্ত ক্রোধের লক্ষ্য, প্রধান শিকার।
যারা ঘরে ফেরে তারা শক্তিমান’।
সময়ের উত্তাল ঢেউ সবুজ ডাইনির মতো মাঝেসাজে সভ্যতার জাহাজ উল্টে দিয়ে এক-দু’জন নাবিকের ঘাড় মটকে দেয়, কিন্তু সকলকে কাবু করতে পারে না। অনেকেই ওই ভাঙা জাহাজের ছবির পাশ দিয়ে প্রকৃত শক্তিমানের মতো ঘরে ফেরে। আমরাও ফিরব। মানুষ ঘরে ফিরবেই।
ফুটনোট: শুরু করেছিলাম এই তথ্য জানিয়ে যে, আমাদের ঘরের দু’টি ঘড়িই অচল হয়ে গেছে। জানাই যে, তারা আবার চলছে। আমরা যে ক্যাম্পাসে থাকি সেই ক্যাম্পাসে একটি ছোট্ট কো-অপারেটিভ স্টোর চালান মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনিই আমাদের দুধও দেন। তার স্টোরটি একটি ছোটখাট মুদিখানাও বটে। তাই তার দোকানটি দিনের কিছুটা সময় খোলাই থাকছে। তিনি এই বিপদের দিনে দেবদূতের মতো মাঝেমাঝেই আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিচ্ছেন। বিপত্তারণ এই মোয়াজ্জেম ভাইকেই জানালাম সমস্যার কথা। ব্যাস! ঘরে এসে হাজির হল প্ল্যাস্টিক প্যাকেটে মোড়া নতুন লাজুক বউয়ের মতো ছোটখাট দু’টি ব্যাটারি। তাদের তিনদিন অবশ্য ঘরে ঢুকতে দিইনি। ফেলে রেখেছিলাম দরজার পাশে। আজ তাদের স্যানিটাইজারে মুছে, দিয়েছি ঘড়ি দু’টির সঙ্গে জুড়ে। নতুন বউয়ের শক্তিতে, যত্নে, জবুথবু দাদামশাই বড়বাবু আবার নড়েচড়ে বসেছেন। কাঁটা ঘুরতে শুরু করেছে। খেলাও কি ঘুরবে না?
আরও দিন অন্তরিন…
দূরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়, ডাকলে দরজায় আসে না কেউ