শেষ আপডেট: 5th January 2025 19:41
৮ জানুয়ারি বুধবার আজমীর শরিফে খাজা মইনুদ্দিন চিশতির উরস অর্থাৎ ওই সুফি সাধকের মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হবে। বিগত কয়েক বছর ধরে এই সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তরফে তাঁর সমাধিতে চাদর চড়ানো হয়।
উরস উপলক্ষে ধর্ম নির্বিশেষে গোটা উপমহাদেশের মানুষ সেখানে মিলিত হন। সারা বছরও এই দরগায় ভিড় লেগে থাকে। সেই দরগায় প্রধানমন্ত্রীর তরফে এবার চাদর চড়ানোর সিদ্ধান্ত বাড়তি মাত্রা পেয়েছে হিন্দুত্ববাদীদের নয়া দাবি ঘিরে। দীর্ঘদিনের দাবি আদায়ে গেরুয়া শিবির এবার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। হিন্দুসেনার জাতীয় সভাপতি বিষ্ণু গুপ্তা দাবি তুলেছেন, দরগার নীচে হিন্দু মন্দির রয়েছে।
হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ প্রধানমন্ত্রীর তরফে দরগায় চাদর চড়ানো নিয়ে তাই আপত্তি তুলেছে। তাঁদের বক্তব্য, আজমীরের ওই বিতর্কিত ধাঁচা দরগা না মন্দির, এই প্রশ্নের মীমাংসা হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর তরফে চাদর চড়ানো সঠিক কাজ হয়নি।
শুক্রবার কেন্দ্রের সংখ্যালঘু কল্যাণ মন্ত্রী কিরেন রিজিজু এবং বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার জাতীয় সভাপতি জামাল সিদ্দিকি প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো চাদর মাজারে চড়ান। পাঠ করেন প্রধানমন্ত্রীর বার্তা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যুগ যুগ ধরে আমাদের পীর, ফকির, আধ্যত্মিক গুরুরা তাদের পরোপকারী মূল্যবোধ দিয়ে জীবনকে আলোকিত করে গিয়েছেন। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে রেখে গিয়েছেন সেবা, মমতা এবং মানবতার অমোঘ নির্দশন।’
‘গরিব নওয়াজ’ বা দুঃস্থের বন্ধু নামে খ্যাত সুফি সাধক মইনুদ্দিন চিশতিকে বহু ঐতিহাসিক ‘সাম্যবাদী’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মাজারে ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রবেশাধিকার আছে। ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির এক বিরল পীঠস্থান এই দরগা।
এবার সেখানে উরস পালনের মুখে আরও কয়েকটি মসজিদের পাশাপাশি এই দরগাকে মন্দির দাবি করে শোরগোল ফেলে দিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর পরই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ঘোষণা করেছিল, ‘এ তো সিরফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী, মথুরা বাকি হ্যা।’ সেই স্লোগান বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে আগেই।
কাশী তথা বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরার শাহি ইদগা মসজিদ নিয়ে আদালতে ঝাঁকাঝাঁকি শুরুর পর তালিকা ক্রমশ দীর্ঘায়িত করছে হিন্দুত্ববাদীদের। তাদের বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট মসজিদগুলি হিন্দু মন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছিল।
মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরির ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে মুসলিম সমাজেও বিরোধিতা নেই। আপত্তি হল শত শত বছর আগের কোনও সুলতান, নবাবের অপকর্মের বদলা নেওয়ার কর্মসূচি। গেরুয়াবাদীরা দাবি তুলেছে মসজিদ ভেঙে অথবা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে মন্দিরের জায়গা ফিরিয়ে দিতে হবে।
উত্তর প্রদেশের সম্ভলের জামা মসজিদ নিয়ে অনুরূপ দাবি ঘিরে দাঙ্গায় চারজনের প্রাণ গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট রাম মন্দির-বাবরি মসজিদের সাড়ে পাঁচশো বছরের বিবাদ নিষ্পত্তি করে দেওয়ায় গেরুয়া শিবিরের লোকজন দলে দলে আদালতে ছুটছে। অযোধ্যা বিতর্কের মতো তারা প্রশাসনের কাছে দাবি পেশ করে সরকারকে বিপাকে ফেলছে না।
একের পর এক মন্দিরের নীচে মসজিদ খোঁজা শুরুর পর মুখ খুলেছেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। বছর দুই আগে জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে বিবাদ তুঙ্গে উঠলে ভাগবত জানিয়েছিলেন, এই কর্মসূচীর সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের সম্পর্ক নেই। তারপরও মসজিদ, মাজারের নীচে মন্দির খোঁজার অভিযানে ভাটা পড়েনি। উত্তর প্রদেশে সাতটি মসজিদ নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা যে দুর্বার গতিতে এগচ্ছে তাতে আদালতের রায় পক্ষে না গেলে সেগুলির বাবরির মতো পরিণতি হওয়া অসম্ভব নয়। অযোধ্যা মামলার রায় হিন্দুত্ববাদীদের ভরসা জুগিয়েছে আদালত তাদের পাশে আছে।
মন্দির-মসজিদ বিবাদকারীদের ইঙ্গিত করে ভাগবত বলেছেন, রাম মন্দির পুননির্মাণের পর কিছু মানুষ নিজেদের হিন্দুদের নেতা হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন। সঙ্ঘ প্রধান কথাটি কাদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন স্পষ্ট নয়। এক বছর আগে ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠান কভার করতে গিয়ে প্রত্যক্ষ্য করেছিলাম রাম জন্মভূমিকে কীভাবে ‘মোদী নগর’, ‘যোগী পীঠ’ করে তোলা হয়েছে। মন্দির দর্শনে যাওয়া রামভক্তদের অনেকেই এ নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে রাজনীতির শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র করে তোলায়।
ভাগবত বচন খণ্ডন করে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ইতিহাস, ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের কথা বলে মন্দির-মসজিদ বিবাদ চলমান রাখার পাল্টা বার্তা দিয়েছেন। আগেই বলেছি, যোগীর রাজ্যেই এই মুহূর্তে সাতটি মসজিদ নিয়ে বিবাদ চলছে, হিন্দুত্ববাদীরা যেগুলিকে মন্দির বলে দাবি তুলেছে। ভাগবতকে খণ্ডন করে বলা যোগীর কথায় তাল মিলিয়েছেন বহু সাধুসন্ত। পরিচিত অনেকেরই তাই ধারণা, আরএসএস, বিজেপি-সহ হিন্দুত্ববাদী শিবিরে বিভেদ শুরু হয়েছে। উগ্র হিন্দুত্বের লাইন থেকে সরতে আসতে চাইছেন ভাগবত।
আমার অবশ্য তা মনে হয় না। মনে রাখা দরকার চলতি বছরে শতবর্ষ পূর্ণ করবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ। এই অবকাশে মুসলিম-সহ অহিন্দু শিবিরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন আরএসএসের একটি সুচিন্তিত কৌশল বলেই আমার মনে হয়। সেই কৌশলের অংশ হিসাবেই বিগত দেড়-দু’ বছরে ভাগবত একাধিকবার বলেছেন, ভারতীয় মুসলিম ও হিন্দুরা ভাই-বোন। তাদের ডিএনএ অভিন্ন।
তাঁর এই বক্তব্য সম্প্রীতির অমোঘ বার্তা বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সঙ্ঘের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের বার্তা, যার মোদ্দা কথা হিন্দুত্ব। আসলে শতবর্ষে সঙ্ঘকে এ দেশে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে নিমায়ক বা নিয়ন্ত্রক সংগঠন হিসাবে তুলে ধরাই ভাগবতদের উদ্দেশ্য। সঙ্ঘ প্রধান কখনও আজমীর শরিফের দরগায় চাদর চড়িয়েছেন বলে শোনা যায়নি।
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্ঘ প্রধানের বক্তব্য খণ্ডনের বিপরীতে খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগায় প্রধানমন্ত্রীর তরফে চাদর চড়ানোর সিদ্ধান্ত অবশ্যই ধর্মীয় সম্প্রীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা মেনে নিয়েও জানতে ইচ্ছে করে প্রধানমন্ত্রী সশরীরে আজমীর শরিফ যান না। কেন নিজেই দরগায় চাদর চড়ান না? কেন মন্দিরের নীচে মসজিদ খোঁজার অভিযান নিয়ে তিনি ও তাঁর সরকার নীরব? কেন ভারত সরকার ঘোষণা করছে না, যাবতীয় উপাসনাস্থল রক্ষায় সংশ্লিষ্ট আইনটি (প্লেসেস অফ অরশিপ অ্যাক্ট, ১৯৯১) সরকার অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে? দেশবাসী কিন্তু মোহন ভাগবতকে ভোটে নির্বাচিত করেননি। তাঁর কথায় সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, তাদের উপাসনাস্থল সুরক্ষিত থাকবে না। এর জন্য চাই সরকারের স্পষ্ট, শক্ত অবস্থান।
ফিরে আসি খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগার প্রসঙ্গে। ধর্ম নির্বিশেষে দেশবাসীর গন্তব্য এই দরগায় শুধু নরেন্দ্র মোদী কেন, হিন্দুত্ববাদীরা কে কবে গিয়েছেন বলে কঠিন। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম অটল বিহারী বাজপেয়ী।
আশ্চর্যের হল,আজকের প্রধানমন্ত্রী আরব দুনিয়ায় সফরে গিয়ে সেখানকার মসজিদে গেলেও দেশে তেমন নজির নেই। ২০১৫-তে সংযুক্ত আরব আমির শাহি সফরে তিনি শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদে গিয়েছিলেন। অথচ সে বছরই যাবেন বলেও কেরলের শতাব্দি প্রাচীন চেরামন জুমা মসজিদে যাননি হিন্দুত্ববাদীরা আপত্তি তোলায়। অথচ পরের বছর সৌদি আরব সফরে সৌদি রাজাকে ওই মসজিদেরই মডেল উপহার দেন মোদী। ২০১৮-তে ইন্দোনেশিয়া সফরে জাকার্তায় ইস্তিকাল মসজিদে যান প্রধানমন্ত্রী। ওই বছরই গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের চুলিয়া মসজিদে। ২০১৮-তেই যান ওমানের সুলতাম কুয়াবুশ মসজিদে। ২০২৩-এ গিয়েছিলেন ইজিপ্টে আল হাকিম মসজিদে।
কেন সেই তিনি দেশে মুসলিমদের উপাসনাস্থলে যান না. ‘সবকা সাথ’ স্লোগান দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর মুখে তাঁর বাল্যকালের বন্ধু আব্বাসের কথা আমরা শুনেছি। বলেছেন, অকালে বাবা মারা যাওয়ার পর আব্বাসকে নিজের বাড়িতে রেখে মানুষ করেন প্রধানমন্ত্রীর বাবা। আরও জানিয়েছেন ইদের সময় প্রধানমন্ত্রীর মা আব্বাসের পছন্দের খাবার তৈরি করে খাওয়াতেন।
মুসলিমদের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত বিদ্বেষ আছে তাই মনে করি না। কিন্তু দূরত্ব রক্ষার দলীয় রাজনীতির দায় আছে। মোদীকে তাড়া করে বেড়ায়, পাছে তার এবং দলের বিরুদ্ধেও সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ ওঠে। তাই সচেতনভাবেই দেশে মুসলিম সমাজের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করে চলেন। হিন্দুত্বের জাগরণে মুসলিম বিদ্বেষ-বিরোধিতা বিজেপির প্রধান অস্ত্র। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী, দুই ভূমিকাতেই নরেন্দ্র মোদী এই ব্যাপারে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের প্রচারে তিনি তো নিজের রেকর্ড ভেঙে নিজেকে অনেক নীচে নামিয়েছেন। তিনি যে ভারতের মতো ১৪০ কোটি মানুষের দেশের প্রধানমন্ত্রী, ভোটের মঞ্চে নরেন্দ্র মোদী সম্ভবত তা খেয়াল থাকে না।