শেষ আপডেট: 11th August 2024 22:20
অমল সরকার
৮ অগস্ট, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান এবং শেখ হাসিনার দেশত্যাগ পরবর্তী ঘটনাবলীগুলিই বলে দেয় বাংলাদেশ আজ কাদের হাতে।
ঢাকার বঙ্গভবনে বহু বছর পর একটি শপথ অনুষ্ঠান হল যেখানে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারিত হয়নি। উচ্চারিত হয়নি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা, সে দেশের জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, মুহাম্মদ মনসুর আলির নাম। শপথ অনুষ্ঠানটি হয়েছে বঙ্গভবন অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে। সেখানে এই পাঁচ নেতার কোনও প্রতিকৃতি দেখা যায়নি।
হুসেইন মহম্মদ এরশাদের সময় থেকে বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম। কিন্তু হিন্দু-সহ বাকি ধর্মগুলিকেও সমান মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা আছে তাতে। সে দেশের যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের সূচনায় কোরান, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক থেকে পাঠ করা হত। মহম্মদ ইউনুসের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে শুধুই কোরান থেকে পাঠ করা হয়েছে। বিশেষ সংযোজন ছিল, মুক্তিযুদ্ধ এবং সদ্য সংঘঠিত ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন। যদিও হাসিনার দেশত্যাগ ও ইউনুসের শপথের মধ্যবর্তী তিন দিন যে শত শত মানুষ হিংস্র সাম্প্রদায়িক শক্তির হত্যার শিকার হয়েছেন, তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়নি।
শপথ নেওয়ার পরদিন প্রধান উপদেষ্টা ইউনুস সাভারে জাতীয় স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন। যতদূর জানি আন্তর্জাতির খ্যাতি সম্পন্ন ৮৪ বছরের এই বাংলাদেশি গত শুক্রবারই প্রথম দেশের জাতীয় স্মৃতি সৌধে গিয়েছিলেন। তবে ঢাকায় জাতির পিতার মূর্তিতে (অনেকগুলিই পথভ্রষ্ট জনতা ভেঙে ফেলেছে) শ্রদ্ধা জানাননি। সম্ভবত আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহিদ মিনারেও (ভাষা শহিদ) তিনি প্রথমবার শ্রদ্ধা জানাতে যাবেন।
চট্টগ্রামে শনিবার সংখ্যালঘুদের প্রতিবাদ সভা।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে দেশের স্বাধীনতার স্মারকগুলি, যেগুলি সাম্প্রদায়িক অপশত্তি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে, সেগুলির বিষয়ে বাংলাদেশের নয়া কর্ণধারও একেবারে সম্পর্ক বিচ্যুত মানুষ। হতে পারে দূনিয়া ঘুরে বেড়ানো ইউনুস দেশের জাতীয় সৌধগুলিতে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারেননি এতদিন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ৫ অগাস্ট দুপুরের পর প্রতিবাদীরা শত শত মূর্তি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। তারা একথা বললে অবাক হব না যে আর্থিকভাবে ধূঁকতে থাকা সরকারের ফুলমালার খরচ তারা খানিক কমিয়ে দিয়েছে। আর অর্থনীতির পণ্ডিত ইউনুসের মুখে হয়তো আগামী দিনে শুনতে হবে, তিনি সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলিতে ফুলমালার খরচেও লাগাম দিতে চান।
চারদিনের মাথায় ১৫ অগস্ট, বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবস। গোটা অগাস্টকে শোকের মাস হিসাবে পালন করা হত। ১৯৭৫-এর ওইদিন শেখ মুজিবুরকে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে সপরিবারে খুন করেছিল বিক্ষুব্ধ সেনারা, যে বাড়িটি এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এবার দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালিত হবে কি? ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়কের সঙ্গে আলোচনায় এই প্রসঙ্গ পেড়েছিলাম। জবাব পেয়েছি, আগামী বছর থেকে জুলাই-কেই (ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে) শোকের মাস হিসাবে পালন করা হবে।
হাসিনা-জমানার বিরোধিতায় অসংখ্য স্লোগান, গান রচিত হয়েছিল। ‘দেশটা কারও বাপের না’ গানটি বিএনপির সভা-সমাবেশে খুব বাজানো হত। এইভাবেই নিশানা করা হত, বাবা ও মেয়ে অর্থাৎ স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনাকে। ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে গানটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু শিবিরের মানুষের মনের কথা হয়ে উঠেছে। তারাও বলতে শুরু করেছেন ‘দেশটা কারও বাপের না।’ তারা বলছেন, দেশটা স্বাধীন করেছে আমাদের বাপ-ঠাকুরদা-দাদা-দিদিরাও। এ দেশ ছেড়ে যাব কেন? দেশটা কারও বাপের নাকি। মুখে না বললেও তাদের নিশানায় বিএনপি ও জামাত-ই-ইসলামী।
টানা মার খাওয়ার পর শনিবার থেকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা সংঘঠিত হতে শুরু করেছেন। ঢাকা, চট্টগ্রামে বিশাল মিছিল ও জমায়েত করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। আরও অনেক শহরে প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। একজন জানালেন, চট্টগ্রামের শনিবারের সমাবেশের হাজিরা ও মেজাজ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। চট্টগ্রামের মিছিল থেকে আওয়াজ উঠেছে, ‘আমার মাটি আমার মা, বাংলা ছেড়ে যাব না।’ তারা আরও বলেছেন, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত,’ ‘ভেসে যাবে অন্যায়, রক্তের বন্যায়।’ প্রশ্ন তুলেছেন, প্রশাসন নীরব কেন, জবাব চাই। জবাব দাও।’
অবশ্য বাংলাদেশে এই মুহূর্তে শুধু সংখ্যালঘুরাই বিপন্ন মনে করলে ভুল করা হবে। ধর্মীয় উস্কানির কারণে তারা বেশি আক্রান্ত হলেও বিপন্নদের অনেকেই মুসলিম। বিশেষ করে আওয়ামী লিগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নিরীহ কর্মী-সমর্থক, রাজনীতির র-এর সঙ্গে যোগ না থাকা ছোট ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পদ্যোগী, রপ্তানিকারক, প্রগতিশীল শিবিরের মানুষও আক্রমণ থেকে বাদ যাচ্ছেন না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নাগরিক, স্রেফ হাসিনার জমানায় পদে ছিলেন বা আছেন, এই অপরাধেও আক্রান্ত হয়েছেন। যেমন, জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ৭৫ বছর বয়সি অধ্যাপক আনোয়ার হুসেন। হাসিনার দেশত্যাগের দিন বিকালে ঢাকার প্রধান বিমানবন্দরের বাইরে তাঁর উপর প্রাণঘাতী হামলা চালানো হয়।
যদিও তিনি হাসিনা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়ে সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু জামাত-ই-ইসলামীর তাঁর উপর হামলা চালায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের বিচার ট্রাইব্যুনালের সামনে সাক্ষ্য দেওয়ায়। অধ্যাপক হুসেন বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ। তাঁর আর এক পরিচয় তিনি মুক্তিযোদ্ধা। আনোয়ার হোসেন মুক্তি যুদ্ধে এক পা হারানো কর্ণেল তাহেরের ছোট ভাই। তাহেরকে জিয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। তারা পুরো পরিবার মুক্তিযোদ্ধা।
তাঁর স্ত্রী আয়েশা হুসেইন সংবাদমাধ্যমে পাঠানো প্রেস বিবৃতিতে একটি ঘটনার কথা জানিয়েছে, যা বুঝিয়ে দেয়, মুক্তিযোদ্ধারা আজকের বাংলাদেশে কতটা বিপদসঙ্কুল অবস্থার মধ্যে আছেন। আয়েশা হুসেইন জানিয়েছেন, স্বামীকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর কর্তব্যরত নার্স পরিচয় জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের কথাও জানানো হয়। নার্স জবাবে অধ্যাপক হুসেইকে পরামর্শ দেন, ‘বাবা, এখন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের কথা কাউকে আর না বলাই ভাল।’
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা হাসিনার পদত্যাগ এবং পরবর্তী সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। শনিবার থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি প্রেস রিলিজ ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেটির দায় আন্দোলকারীরা অস্বীকার করেননি। তাতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা দেশের নামজাদা কয়েকজন সাংবাদিকদের নামের তালিকা প্রকাশ করে বলেছে, এঁরা আওয়ামী লিগের মদতদাতা এবং জাতীয় দুশমন। এঁদের সাংবাদিকতার অঙ্গনে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি।
সংস্কার-পন্থী ছাত্ররা এরপর সাংবাদিকদের জন্য আচরণবিধি তৈরি করে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আফগানিস্তানে তালিবানদের এমন ফতোয়া মেনেই কাজ করতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। যদিও বাংলাদেশের মিডিয়া সংক্রাম্ত তথ্য অন্য কথা বলে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালেও সেখানে প্রথমসারির খবরের কাগজ ও টেলিভিশনের সিংহভাগের ছিল সরকার বিরোধী অবস্থান। সেটা অন্যায় বলা যাবে না। সেই অবস্থান তাদের অধিকারেরই অঙ্গ।
বাংলাদেশের চলতি গণ-অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে রবিরার ভারতের বহুল প্রচারিত সংবাদমাধ্যমের একাংশে খবর প্রচারিত হয়েছে, যে শেখ হাসিনা ঘনিষ্ট মহলে বলেছেন, তাঁকে উৎখাত আমেরিকা ও জামাতের চক্রান্ত। এই বিষয়টি অনেক আগেই ‘দ্য ওয়াল’-এ লেখা ও ভিডিও অনুষ্ঠানে বলা হয়েছিল।
যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর এবং সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণার বদলা নিয়ে জামাত-ই-ইসলামী বড় ছোবল মারবে, এটা জানাই ছিল। জানাই ছিল, আজ কিংবা কাল আমেরিকাও বদলা নেবে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা মামলায় ২০১৩ সালে আদালতে দোষী সাব্যস্তদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হাসিনাকে ফোন করে নিষেধ করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিনটন। হাসিনা মুখের উপর ‘না’ বলে দিয়েছিলেন।
এছাড়া সেন্ট মার্টিন দ্বীপ চেয়ে আমেরিকার প্রস্তাব, শ্রম আদালতে মহম্মদ ইউনুসের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা প্রত্যাহারের মার্কিন দাবি হাসিনা উড়িয়ে দিয়ে শুধু বাইডেন প্রশাসন নয়, গোটা ইউরোপিয় ইউনিয়নের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। সেই রাগ, রোষ টের পাওয়া যাচ্ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ খুঁটিনাটি বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের লাগাতার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায়। তাতে গারমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবির বিষটিও ছিল।
এটা এখন আর গোপন নেই যে, বছরের গোড়ায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিরোধী দল বিএনপির শেষ মুহূর্তে বয়কটের সিদ্ধান্ত ছিল আমেরিকার পরামর্শ, যাতে ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। একথা ঠিক, নির্বাচন অবাধ হয়নি। যদিও বিগত বহু নির্বাচনের তুলনায় অনেক বেশি নজরদারীতে ভোট হয়েছিল।
নয়াদিল্লির পরামর্শে শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশে সেই ভোট নিয়ে বড় ধরনের আপত্তি আর না করলেও আমেরিকা তাদের পুতুল সরকার বসানোর কর্মসূচি থেকে পিছিয়ে যায়নি। তাদের বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বলে পরিচিত জামাত-ই-ইসলামকে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক সংগঠন বলে স্বীকৃতি দেওয়ার পিছনের রহস্যটি কখনই গোপন ছিল না। মার্কিন মদতে সেই সংগঠনের গোটা বাংলাদেশের তরুণ-যুব সমাজের মন-মস্তিষ্কে উপনিবেশ কেন হাসিনা সরকার টের পায়নি তার ময়না তদন্ত রিপোর্ট নিশ্চয়ই আগামী দিনে প্রকাশ্যে আসবে।
প্রশ্ন আছে ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের নিয়েও। তাঁরাই বা পড়শি দেশে আমেরিকার একবড় ‘খেলা’ কেন টের পেলেন না? হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিগত দেড় দশকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল। এর কৃতিত্ব হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদীর। সেই প্রতিবেশী বন্ধু দেশের এত বড় পট-পরিবর্তনের আভাস ভারতের বৈদেশিক সূরক্ষার ভারপ্রাপ্ত কর্তাদের না পাওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁরা দেশের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। যে কারণে শেখ হাসিনার পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদীর জন্যও হালের ঘটনাবলী উদ্বেগের, উৎকণ্ঠার। ইউনুসের বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোন দিকে গড়ায় অচিরেই বোঝা যাবে। ভাল হলে ভাল, যদিও তেমন সম্ভাবনা কম।