শেষ আপডেট: 26th August 2024 11:41
সাধারণ মানুষের গায়ে কোনও দলীয় রং থাকে না, তবু সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের জোর যে কতটা সেটা আশা করি সাধারণ মানুষই বুঝতে পারছেন। এটাও বুঝতে পারছেন নিশ্চয়, যে এত দিন একটা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বাঁচতাম যে আমরা একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বাস করি। ইদানীং চারদিকে এত ধমক-চমক দেখে-শুনে সবাই বুঝতে পারছি, কত বড় ভুল ধারণা ছিল আমাদের।
সাম্প্রতিক আরজি কর কাণ্ডের পরে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদই হোক বা স্কুল পড়ুয়াদের স্বতঃস্ফূর্ত সমবেত আবেগের বহিঃপ্রকাশ-- সবেতেই রাষ্ট্রশক্তির ভীষণ আপত্তি। তাই তাদের তরফ থেকে বিভিন্ন নোটিস, শোকজ জারি করে এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বন্ধ করার মরিয়া চেষ্টা চলছে। অব্যবস্থাটা এমনই, যে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতকে বলতে হচ্ছে, যে মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের উপরে যেন কোনও বল প্রয়োগ না করে প্রশাসন। তবুও এই ধমক চমক থামছে কি?
আমি অবশ্য এই ঘটনার অনেক আগেই ব্যক্তিগতভাবে এই অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছি। আমার এক আত্মীয় সরকারী কর্মচারী এবং একটি বিশেষ সংস্থার সিনিয়র অফিসার। তাঁর অনেক শারীরিক অসুবিধে থাকা সত্ত্বেও বাড়ি থেকে অনেক দূরবর্তী জায়গায় ট্রান্সফার করা হয়েছে, কারণ তাঁর স্ত্রী খুব সঙ্গত কারণে একটি সামাজিক বিষয়ে প্রতিবাদ করেন। একটি বিশিষ্ট সংবাদমাধ্যমের এক বর্ষীয়ান সাংবাদিক সেই প্রতিবাদের ঘটনার উপর একটি প্রতিবেদনও লেখেন। এর পরে প্রতিবাদের সুরাহা করা তো দূরের কথা, তার পুরো দায় তার স্বামীর ওপর চাপিয়ে ওই সরকারি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তার স্বামীকে শারীরিক সমস্যা সত্ত্বেও বাড়ি থেকে বহুদূরে বদলি করেন।
যদিও তড়িঘড়ি সেই বদলির সরকারি নাম 'রুটিন বদলি', কিন্তু আসলে সবাই জানেন, 'রুটিন'-এর মারপ্যাঁচে এটা 'বদলি'র আড়ালে 'বদলা'।
এটা ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়। মানে মানুষের প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করা এখন সিস্টেমেরই অংশ। আমার সেই আত্মীয় কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিক আবেদন করেন, অনুরোধ করেন তাঁর শারীরিক অসুবিধের কথা বিচার করে যেন তাঁর ট্রান্সফার অর্ডার পুনর্বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কিছুই শুনতে নারাজ। অগত্যা উপায়ন্তর না দেখে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে আবেদন করেন সেই অসহায় পরিবার। এর জেরে ওই সংস্থার কর্তৃপক্ষ, সেই ব্যক্তির মেডিক্যাল টেস্টের দায়িত্ব দেন স্বাস্থ্যভবনকে, এটা দেখার জন্য যে ব্যক্তি সত্যিই চাকরি করতে সক্ষম কিনা এবং তাঁর এই ট্রান্সফার অর্ডার পুনর্বিবেচনা করার আবেদন ঠিক কতটা সঙ্গত।
অনেক হয়রানির পরে স্বাস্থ্যভবনের ঠিক করে দেওয়া হাসপাতাল থেকে আমার সেই আত্মীয়ের মেডিকেল পরীক্ষা হয়। আর বিশিষ্ট ডাক্তারবাবুরা সেই ব্যক্তিকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, যে তাঁর পক্ষে কিছুতেই অত দূরে যাতায়াত করা সম্ভব নয় এবং তার যথাযথ রিপোর্টও স্বাস্থ্যভবন জানিয়ে দেন সংশ্লিষ্ট দফতরকে। কিন্তু কোথায় কী! ওই সরকারি সংস্থা খুব উদাসীনভাবে এই রিপোর্টকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে শারীরিক অসুবিধে সত্ত্বেও ওই ব্যক্তিকে ওই দূরবর্তী স্থানেই বহাল রাখেন। তাঁর পরিবার অনুরোধ করলে তাদের জানানো হয়, তাঁরা পরে বিবেচনা করে দেখবেন এবং তাদের এটাও জানানো হয়, যে 'মিডিয়াবাজি' করলে তার পরিণতি এমনটাই হবে।
ওই পরিবারটি এই নিয়ে সুবিচার চাইতে আর কোথাও যাননি, কারণ আর কোথাও অভিযোগ করে কি কোনও লাভ আছে? বিশেষত যখন এটাই এই সিস্টেমের স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর!
গত কয়েকদিন ধরে একাধিক সংবাদমাধ্যমে আরজি করের প্রাক্তন সুপার, ডাক্তার আখতার আলির ইন্টারভিউ দেখতে দেখতে এই ধরনের বিষয়গুলো থেকে আস্তে আস্তে যেন পর্দা উঠে যাচ্ছিল। ওঁর দৃঢ় শিরদাঁড়া দেখে সত্যিই অবাক হলাম। এত হয়রানির পরেও উনি যে এই নিরন্তর লড়াই করে চলেছেন, তাতে ওঁকে কুর্নিশ জানাই। আশা করব, ওঁর এই লড়াই সুবিচার পাক। শুধুমাত্র হাসপাতালেই নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার প্রদর্শন চলছে। যখনই কোনও দুর্ভাগা সিস্টেমের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন তুলেছে, তার কপালে জুটেছে হয়রানি। সে পড়েছে ক্ষমতাবানের রোষানলে।
এসবের মধ্যে বাস করেও, যতই চোখ বন্ধ করে নিজের সংসার, নিজের কর্মক্ষেত্র-- এগুলো নিয়ে ভাবার চেষ্টা করি না কেন, ৯ আগস্ট, ২০২৪ থেকে জীবনটা অদ্ভুত ভাবে বদলে গেছে। কী যেন একটা অজানা আশঙ্কা আর একটা অস্বস্তি কাজ করছে সর্বক্ষণ। কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না, সবসময় আরজি করের নির্যাতিতার মৃত্যু রহস্যের সমাধানের গতি প্রকৃতির দিকে নজর রাখার তাগিদ অনুভব করছি। জানি না আদৌ সিবিআই এই রহস্যের সমাধান করে এই নৃশংস হত্যার প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারবে কিনা! কত তদন্তই তো তারা আগেও করেছে, কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির মনে পড়ে না।
তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের স্মৃতি বড়ই দুর্বল। সামনেই পুজো আসছে। আমরা আবার হয়তো মেতে উঠব উৎসবে, আনন্দে। মেতে উঠব অসুরদলনীর আরাধনায়। অসুরদের পায়ের তলায় প্রতি মুহূর্তে দলিত হতে হতেও ভাবব, এটাই তো স্বাভাবিক! এটাই তো গণ-উৎসবতান্ত্রিক সিস্টেমের স্বাভাবিক আচরণ। তাই এই জনজাগরণের আবহে রাষ্ট্রশক্তির দণ্ডমুণ্ডের কর্তাকর্ত্রী যাঁরা আছেন তাদের একটাই অনুরোধ করছি, ঘুম ভেঙে একটু চারপাশে তাকিয়ে দেখুন। ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করুন। ক্ষমতার এক মাদকতা আছে। তাই যে শাসকই আসুক না কেন তাকে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাচারী করে তোলে। আর এই উন্মত্ত স্বেচ্ছাচারের রক্তচক্ষু দেখে সাধারণ মানুষ হিসেবে সত্যিই আতঙ্কে ভুগছি! একটাই প্রশ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছে, সুবিচারের আশায় কার কাছে যাব?