শেখ হাসিনা, শফিকুর রহমান ও খালেদা জিয়া।
শেষ আপডেট: 12th January 2025 15:54
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া দিন কয়েক হল লন্ডনে চিকিৎসাধীন। অন্যদিকে, ৫ অগাস্ট থেকে দিল্লিতে আছেন শেখ হাসিনা। খালেদা লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রার করার পর বাংলাদেশে এই প্রশ্ন এখন ভাইরাল—তাহলে বহুচর্চিত ‘মাইনাস-টু’ প্রত্যাশীদের প্রত্যাশা অবশেষে পূর্ণ হল? বিদেশ থেকে দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্বদেশে প্রত্যাবর্তণ সম্ভব কিনা তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। বলাইবাহুল্য প্রধান প্রতিপক্ষ দুই শিবিরকে মিলিয়ে দিয়েছে নেত্রীদের নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা।
শীর্ষস্থানীয় এই দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার যে চেষ্টা দেড়-পৌনে দু-দশক আগে শুরু হয়েছিল ২০২৫-এ তা সম্ভব কি না সে বিষয়ে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। তাঁরা এমন সম্ভাবনার কথা প্রায় উডি়য়ে দিয়েও শেষে বলেছেন, ‘রাজনীতিতে কিছুই অসম্ভব নয়।’
উল্টোটা অর্থাৎ রাজনীতিতে আপাত অসম্ভবও যে ঘোর বাস্তব হতে পারে তার দৃষ্টান্ত হাসিনা ও তাঁর দলের পরিণতি নিয়ে বিএনপি সুপ্রিমো খালেদা জিয়ার প্রতিক্রিয়া, পুত্র তারেক-সহ বিএনপি-র শীর্ষ নেতৃত্বের উদারতা এবং পরিপক্ক রাজনীতি। পরিচিত মহলে আমি অনেকদিন থেকে কথাটি বলছিলাম; এখন আওয়ামী লিগের বহু নেতাও খন সহমত যে গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী অস্থির পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এক নজিরবিহীন ভূমিকা পালন করেছেন। শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্য তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে টিভিতে প্রত্যক্ষ করেছন। শত অনুরোধেও যে হাসিনা তাঁকে বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার অনুমতি দেননি, তাই-ই শুধু নয়, তাঁর অসুস্থতা নিয়ে নানা সময়ে সন্দেহ প্রকাশ, এমনকী উপহাস করেছেন।
সেই হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিএনপি-র হাজার হাজার নেতা-কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে খালেদা ৫ অগাস্টই গণঅভ্যুত্থানে গদিচ্যুত আওয়ামী লিগ নেত্রীর মুণ্ডপাত করলে দেশে এমন গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাওয়া অসম্ভব ছিল না যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মোকাবিলা করতে পারত, জাতিসংঘের শান্তি সেনা তলব তখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ত। সে পথে না বিএনপি নেত্রী বলেছেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।’
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বদলের আভাস দিয়েছেন হাসিনাও। পনেরো বছর সরকারের বিরোধিতা করলেও গণঅভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র নিয়ে তিনি, তাঁর দল দল আওয়ামী লিগ নেতৃত্ব জোরালোভাবে বিএনপি-র দিকে আঙুল তোলেননি। শেখ হাসিনা ভার্চুয়াল সভার ভাষণে ইউনুস, জামাতের মুণ্ডপাত করলেও বিএনপি সম্পর্কে ততটা রুঢ় নন বরং একপ্রকার নীরব।
কারণ গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে রাজনীতির যে জল গড়িয়েছে তার চরিত্র ভিন্ন, বলা ভাল ভয়ানক। ৫ অগাস্টের পর আওয়ামী লিগের যে নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা দেশে থেকেই মৃত্যু ও সেনা-পুলিশের থাবা এড়াতে পেরেছেন, তাঁদের জীবন ধারণ এখন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী মাস খানেকের হত্যাযজ্ঞের ছবিগুলি মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে যা চার বছর আগে আফগানিস্তানে তালিবানের প্রত্যাবর্তণের সময় প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল।
সেই হত্যাযজ্ঞে একেবারে মধুচন্দ্রিমার মেজাজে সামিল হয়েছিল জামাত-বিএনপি। যদিও জামাতের শীর্ষ নেতৃত্বের তাতে পূর্ণ মদত থাকলেও বিএনপি-র প্রথমসারির নেতৃবৃন্দ সে পথে হাঁটেননি। তারেক রহমান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীররা জাতীয় ঐক্য রক্ষার ডাক দিয়েছেন। শেখ মুজিবের প্রতি অসম্মান, তাঁর মূর্তি ভাঙার নিন্দা করেছেন।
আমার ধারণা, তারেক জিয়া ৫ অগাস্ট রাতে লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে এলে অনেক অঙ্ক বদলে যেতে পারত। বাংলাদেশে এতদিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে যেতেন। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব ক্ষমতায় ফিরতে তাড়াহুড়োর রাস্তায় হাঁটেননি। সেটা তাঁদের পরিছন্ন রাজনীতির দৃষ্টান্ত নাকি কৌশলগত ভুল তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে।
এই সুযোগে মহম্মদ ইউনুসের সরকারকে সামনে রেখে বিগত পাঁচ মাসে জামায়াতে ইসলামি, হিযবুত তাহেরীর মতো শক্তি বাংলাদেশের শাসন-প্রশাসন এবং সমাজজীবনে প্রভাব আরও বাড়িয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি একদা শরিক উগ্র ইসলামিক শক্তি জামাতের সঙ্গে বিএনপি-র দূরত্ব তৈরি এখন রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে (যিনি শেখ হাসিনার একান্ত পছন্দের মানুষ এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত) অপরাসরণ, আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা, ’৭২-এর সংবিধান বদলের মতো গুরুতর প্রস্তাবে সায় না দেওয়ায় জামাতের পাশাপাশি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব ও তাদের অঘোষিত রাজনৈতিক মঞ্চ জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে বিএনপি-র এখন সাপে-নেউলে সম্পর্ক।
ইউনুস প্রকাশ্যেই বলেছেন, আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ করার পথে তিনি এগতে পারেননি বিএনপি সায় না দেওয়ায়। জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মানুষ চাইলে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লিগকে ভোটে নির্মূল করে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সরকার সে কাজ করতে যাবে কেন? আসলে বিএনপি নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছেন, আজ আওয়ামী লিগের জন্য তৈরি হাড়িকাঠে তাদেরও গলা চেপে ধরা হতে পারে। এই কারণেই তারেক রহমান ও বিএনপির এই পর্বের রাজনীতি অবাক করা এবং সময়ের দাবি মেনে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। বিগত পাঁচ মাসে রাজনীতিতে ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ লাভবান হয়ে থাকেন তো তিনি তারেক হরমান—তাঁর ভাবমূতির কালো রং এখন ধবধবে সাদা।
স্বভাবতই ওই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লিগ ও বিএনপি-কে এক বন্ধনীতে রেখে আক্রমণ শানাচ্ছে গণ অভ্যুত্থানের কারিগর ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং জামাত। হাসিনা, খালেদার দলকে তারা দেশের জন্য অশুভ শক্তি হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে। ঠেকাতে চাইছে বিএনপির ক্ষমতায় ফেরার যাবতীয় সম্ভাবনা।
লক্ষণীয়, বিএনপি-র প্রতি এই আক্রমণ তীব্র হয়েছে খালেদা জিয়ার দল দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সরব হতে শুরু করার পর। কোনও সন্দেহ নেই, অবাধ ভোট হলেও আওয়ামী লিগের এত তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় ফেরা কঠিন। আমার ধারনা পরিচ্ছন্ন নির্বাচন হলে বিএনপি হেসেখেলে ক্ষমতায় ফিরবে। কারণ, অন্তবর্তী সরকারের পাঁচ পাঁচের কার্যকলাপ সাধারণ মানুষের কাছে গণ্য অভ্যুত্থানের প্রয়োজনীয়তাই এখন প্রশ্নের মুখে। রুটি-রুজি, আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক করার মতো আশু সমস্যার সমাধানের আগে রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে মেতে ওঠা ইউনুসের মস্ত বড় ভুল বলে আমার মনে হয়। এতদিনে তিনি হয়তো বুঝেছেন, পরামর্শদাতারা তাঁকে ভুল পথে চালিত করেছে। হয়তো সেই কারণেই ‘নিউ এজ’-এর সম্পাদক-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাজনৈতিক দলগুলিকে আক্রমণের রাস্তা ছেড়ে তিনি গোল পোস্ট বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলেন। অকপটে স্বীকার করেছেন সরকারের ভুল-ক্রটি-ব্যর্থতা। বিএনপি-র চাপের মুখে তিনি নির্বাচনের একটা রোড ম্যাপও মোটের উপর ঘোষণা করে দিয়েছেন।
কিন্তু তাঁকে সামনে রেখে যাঁরা দেশ চালাচ্ছেন তাঁদের মতলব সম্ভবত ভিন্ন এবং এতদিনে স্পষ্ট, গণ অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লিগকে উৎখাতের পর নির্বাচনের ময়দানে বিএনপি-কে নিশ্চিহ্ন করা। সেই লক্ষ্যেই ছাত্র নেতৃত্ব এবং জামায়াতে ইসলামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ছাত্র ইউনিয়ন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন সেরে নেওয়ার দাবি তুলেছে। দেশের ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে ক্যাম্পাস এবং নীচুতলার প্রশাসন কব্জা করা তাদের লক্ষ্য। এই ভাবে বিএনপি-কে ধাপে ধারে মাইনাস করার পরিকল্পনা নিয়ে এগনোর পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। সেনা-পুলিশ-আমলার মদতে আরও একটা লুটতরাজের ভোট করে বিএনপি-কে আটকে দেওয়ার চেষ্টা হবে।
একথা ঠিক জন্মের পর থেকে বাংলাদেশে কোনও সরকারই পপুলার ম্যানডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসেনি। কিন্তু অতীতের তুলনায় চলতি পরিস্থিতি অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। হাসিনা সরকারকে উৎখাত করার মধ্য দিয়ে মাথা তোলা নতুন শক্তি বাংলাদেশের অস্তিত্বই স্বীকার করে না। যে উগ্র মৌলবাদী ইসলামিক মতাদর্শে তারা বাংলাদেশকে চালিত করার কথা বলছে তা দেশটির জন্মকেই অস্বীকার করার নামান্তর। মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট একাধিক বিষয়ে অম্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ এবং সহযোগীদের আস্ফালন, কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, তারা যেন বলতে চাইছেন বাংলাদেশের জন্ম আল্লাহর ভুল।
আশ্চর্যের হল, আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লিগ নেতারা অনুগত ইউটিউবারদের বয়ান কতিপয় কর্মীর আবেগঘন পোস্ট দেখে মনে করছেন, কাল ভোট হলেও তারাই ক্ষমতায় ফিরবেন। অন্যদিকে, বিএনপি মনে করছে ভোট হলে তাদের ক্ষমতায় ফেরা কেউ আটকাতে পারবে না।
কাঁটাতারের বেড়ার এপার থেকে যে টুকু যা প্রত্যক্ষ করছি তাতে মনে হয় বাংলাদেশে রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তিকে খাটো চোখে দেখার বড় খেসারত দিতে হতে পারে দু’দলকেই এবং এই পরিস্থিতিতে দু-দলের কাছাকাছি আসা সময়ের দাবি।
একথা ঠিক বিএনপি ও আওয়ামী লিগের বৈরিতা উপমহাদেশে নজিরবিহীন। আওয়ামী লিগের অভিযোগ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যায় সেনা কর্তা জিয়াউর রহমানের হাত ছিল। তাই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ক্ষমা করে সরকারি পদে বসিয়েছিলেন। হাসিনার দলের আরও অভিযোগ, বঙ্গবন্ধুর পর তাঁর কন্যাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই খালেদা জিয়ার সময় গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল।
অন্যদিকে, বিএনপির অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকাকে আওয়ামী লিগ নসাৎ করেছে। শেখ মুজিব নন, স্বাধীনতার ঘোষণা জিয়া দিয়েছিলেন, দাবি বিএনপি-র। খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা করতে দিতে যেতে না দিয়ে আওয়ামী লিগ সরকার তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করতে চেয়েছিল, এমন অভিযোগও করে থাকে দলটি।
অতিরঞ্জন যেমন রাজনৈতিক অভিযোগের অনুষঙ্গ, সঙ্গে এটাও মনে রাখা জরুরি, দু-তরফের বক্তব্যেই কিছু সত্যতা আছে। স্বভাববই বিএনপি ও আওয়ামী লিগের হাত ধরাধরি সূর্য পশ্চিমে উদিত হয়ে পূবে অস্ত যাওয়ার মতো অকল্পনীয় ঠেকবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, একমাত্র রাজনীতিতেই তেল আর জল মিশ খায় এবং একের সঙ্গে এক যোগ করলে দুই নয়, যোগফল অনেক সময় এগারো হয়। বাংলাদেশকে বিপরীত মুখে চালিত করতে উদ্যত পতিপক্ষকে দেশের স্বার্থে আটকাতে চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের হাত ধরা সময়ের দাবি। একান্তই তা অসম্ভব ঠেকলে এরশাদ জমানার মতো পাশাপাশি হাঁটা যেতেই পারে। রাজনীতিতে কেউ স্থায়ী মিত্র বা শক্রু নয়।