মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শেষ আপডেট: 20th October 2024 11:42
অমল সরকার
আরজি কর হাসপাতালের শিক্ষার্থী ছাত্রীর ধর্ষণ-খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জেগে ওঠা আন্দোলন কতটা ন্যায, কতটা-অন্যায্য, রাজ্যের ছয় কেন্দ্রের বিধানসভা নির্বাচনে আদৌ এর কোনও প্রভাব পড়বে কিনা, ২০২৬-এর বিধানসভা ভোট পর্যন্ত মানুষের প্রতিবাদের এই ধারা জারি থাকবে কি না, তৃণমূলের ক্ষমতায় ভিত তা নাড়িয়ে দিতে পারবে কি না, ইত্যাদি নানা প্রশ্ন বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমার উপলব্দি, রাজনীতির অবিরাম চর্চাই আম বাঙালির কাছে সবচেয়ে সস্তার বিনোদন। মোবাইল আসার পর এখন আর এ জন্য খবরের কাগজ কেনারও দরকার পড়ছে না। ফলে এই বিনোদন এখন আরও সস্তা। আমি বহুবার শশ্মানে অপেক্ষমান শ্মশানযাত্রীদের দেখেছি, মৃত মানুষটিকে নিয়ে আলোচনা ছাপিয়ে তারা মজে আছেন পাড়া-পলিটিক্সে। দেহটি চুল্লিতে তোলার পর সেই আলোচনা এতটাই উচ্চগ্রামে ওঠে যে ঝগড়াঝাটি, হাতাহাতিও বাদ থাকেনি কখনওসখনও।
যদিও রাজনৈতিক দলগুলির কর্মকাণ্ডের মান দেখে বোঝার উপায় নেই মাছ-ভাতের পরই আম বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় হল রাজনীতি। যেমন অভয়া আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। এই আন্দোলন যে তৃণমূল সরকারের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ তা নিয়ে শাসক শিবিরেও কোনও সংশয় নেই। কিন্তু এই সরকারের বিগত তেরো বছরের শাসনে বিরোধীদের লড়াই-সংগ্রাম থেকে স্পষ্ট তারাও গণক্ষোভ অনুমানে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের আন্দোলন তাই সীমাবদ্ধ থেকেছে দলীয় ঝাণ্ডার নিচেই। ক্ষুব্ধ গণ মানুষকে তারা তাদের লড়াই-আন্দোলনে শামিল করতে পারেননি। তাই বলে শাসক দল তৃণমূল এই সমস্যা থেকে মুক্ত, বলার অবকাশ নেই। তারাও রাজনীতিকে দলীয় গণ্ডির মধ্যে কুক্ষিগত করে রাখায় এ রাজ্যে ভোটের বাক্সে বিজেপির অগ্রগতি অব্যাহত। বামের ভোট রামে যাওয়াটা মুদ্রার একটি দিক। উল্টো দিকটি হল তৃণমূলের জমানাতেই বাংলায় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ মাত্রা ছাড়িয়েছে।
মূল প্রশ্নে ফিরে যাই; কেন রাজনৈতিক দলগুলি মানুষের ক্ষোভ-অসন্তোষ আঁচ করতে পারনি। অভয়া আন্দোলন ছিনিয়ে নিতে বিজেপি সমান্তরালে নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েও মাঝপথে থেমে গিয়েছে। কারণ, এক. এখানে ধর্ম গেলানোর সুযোগ ছিল না। দুই. সামাজিক আন্দোলনের অ-আ-ক-খ দলটির জানা নেই। বিজেপির আন্দোলন মানে ধর্মের নামে মানুষ খেপানো।
কিন্তু বামপন্থীরা? বিজেপির মতো সামাজিক আন্দোলন নিয়ে বোধশূন্য না হলেও তারাও মূলত নানা পেশার মানুষের আর্থির দাবিদাওয়ার আন্দোলন করেছেন। বাংলার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-যুব-সরকারি কর্মচারীর আন্দোলনের ঐতিহাসিক সাফল্য আছে সিপিএম-সহ বামদলগুলির। এখনও এ রাজ্যে বামদলগুলির যৌথ আন্দোলনের যে মঞ্চটি তুলনায় সক্রিয় সেটি কৃষকদের দাবিদাওয়ার লড়াই চালাচ্ছে। এমনকী নারীদের ইস্যুতেও বামেদের আন্দোলন বাকি ক্ষেত্রগুলির তুলনায় কম।
ইলা মিত্র, কনক মুখোপাধ্যায়, গীতা মুখোপাধ্যায়দের মতো কিছু নেত্রী সামনের সারিতে থাকলেও বাম দলগুলিতে নারীরা সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। কয়েক বছর আগেও সিপিএমের মতো পার্টিতে মহিলাদের দেখা যেত দলের সভা-অনুষ্ঠানে লালপাড় শাড়ি পরে নেতাদের ফুল-মালা গিয়ে স্বাগত জানাতে। সেখানে অভয়া আন্দোলনে নারীরা পুরুষের তুলনায় সংখ্যায় ভারী। দ্রোহ কার্নিভালের ভিড়ে দেখলাম বহু মহিলা মোবাইলে স্লোগান লিখে এনেছেন। সেই স্লোগান মূহূর্তে গণ-স্লোগানে পরিণত হয়েছে। হাই কোর্ট দ্রোহ কার্নিভালের অনুমতি দিতেই বহু মহিলা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বিজয় উদযাপন করলেন। এমন দৃশ্য বছরে একবার, বিজয়া দশমীর দিনেই কোথাও কোথাও চোখে পড়ে। কোনও আন্দোলনে মহিলাদের এমন স্বতঃস্ফুর্ত ভূমিকায় দেখিনি।
এটা শুধুই এই কারণে নয় যে আন্দোলনের প্রধান ইস্যু পড়ুয়া চিকিৎসককে খুন-ধর্ষণের বিচার। আসলে সময়ের বদলটা রাজনৈতিক দলগুলি ধরতে পারেনি নাকি পুরুষ নেতৃত্ব সেই পরিবর্তনকে গুরুত্ব দেয়নি তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। আমার মতে, দ্বিতীয়টিই প্রধান কারণ। এখন সিপিএম মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, দীপ্সিতা ধরদের বাড়তি গুরুত্ব দিলেও তারা জন-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। আসলে তারা যে দলীয় রাজনীতির পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন যেখানে দলের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে বহু ক্ষেত্রেই এক-দু’জনের সিদ্ধান্তকে পার্টির অবস্থান বলে মেনে নিতে হয়। জন-আন্দোলন এই কমান্ড বা অনুশাসনের সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
তারপরও বলব, ডাক্তার এবং নাগরিক আন্দোলনকে যে চেহারায় দেখা যাচ্ছে, তার পিছনে বাম রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। অনশন এবং দ্রোহ ঘিরে ভিড়ে বামমনস্ক মানুষের উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব ছিল না, যাদের অনেকেই বিগত নির্বাচনগুলিতে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। তৃণমূল তাই বামেদের পিছনে আবার হাত ধুয়ে লেগে পড়েছে।
ডাক্তারদের পিছনে সিপিএম আছে বলে তৃণমূলের অভিযোগকে তর্কের খাতিরে সত্য ধরে নিয়েও বলতে হয়, বামদলগুলির পক্ষে খুব বেশি এগনো মুশকিল। কারণ, সিপিএমের নেতারা যেমন রাতারাতি নির্দেশ দেওয়া, এটা করা যাবে, ওটা করা যাবে না জাতীয় ফতোয়া জারির মানসিকতা ত্যাগ করতে পারবেন না, তেমনই এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যাদের যোগ এবং দায়বদ্ধতা নেই তাঁরা নেতাদের কথায় ওটাবসা করবেন না। বরং সমান্তরাল আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াই বামপন্থীদের জন্য সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে।
এবার আসা যাক, ভোটের বাক্সে প্রতিফলনের প্রশ্নে। আগামী মাসে ছয় বিধানসভা আসনের উপ নির্বাচনের ফলাফলে অভয়া আন্দোলন কোনও প্রভাব ফেলবে কিনা, সঙ্গত কারণেই এই প্রশ্ন উঠেছে। আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি বলে, তেমন প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম। সেই সঙ্গে বলা দরকার, ভোটের ফলাফল দিয়ে একটা জন-আন্দোলনের ভালমন্দ, সাফল্য-ব্যর্থতা মাপতে যাওয়াটাই ভুল। বহু সাড়া ফেলে দেওয়া আন্দোলনেরই ভোটের বাক্সে প্রভাব পড়েনি। দু বছর আগে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের সময় কৃষক আন্দোলন তুঙ্গে থাকা সত্ত্বেও যোগী আদিত্যনাথ বিগত ৩৫ বছরের মধ্যে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছেন। লোকসভা ভোটেও তেমন দাগ কাটতে পারেনি ওই নির্বাচন। কৃষক আন্দোলনের পরও হরিয়ানার বিধানসভা ভোটে বিজেপি জিতল। রাহুল গান্ধী বারে বারে কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেও পাঞ্জাবে কংগ্রেস ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। তারমানে কি কৃষক আন্দোলন ভুল এবং ব্যর্থ? ওই আন্দোলনের ধাক্কায় তিন বিতর্কিত কৃষি আইন নরেন্দ্র মোদীকে প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছিল।
বাংলায় তৃণমূলের ভোট-গাছের শিকড় এখন বেশ গভীরে। তার মূখ্যত কারণ, গরিব মানুষের কল্যাণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলি। চুরি-দুর্নীতি সত্ত্বেও মানুষ মোটের উপর সেগুলির সুবিধা আগের সরকারের তুলনায় বেশি পাচ্ছে। আবার অভয়া আন্দোলনকে ঘিরে চর্চায় আশা থ্রেট কালচার সেই গরিব মানুষের কাছেই সবচেয়ে বড় বিপদ। যদিও থ্রেট কালচার থেকে মুক্ত নয় সমাজের কোনও অংশই। পড়ুয়া চিকিৎসকের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় সমাজের নানা পেশার মানুষ স্ব স্ব ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম, থ্রেট কালচার নিয়ে মুখ খুলেছেন। আমার মনে হয়, এই আন্দোলনের সর্বজনীন ইস্যুটি হল থ্রেট কালচার, বুকে হাত দিয়ে কারও বলার সাহস হবে না যে তিনি এই বিপদ থেকে মুক্ত।
আসি ২০২৬-এর প্রসঙ্গে। রাজনীতির হাওয়া কখন কোন দিকে মোড় নেবে বলা মুশকিল। যদি আজকের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রেখে বলতে পারি, তৃণমূলের রাতের ঘুম চলে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তার একাধিক কারণের অন্যতম হল, বিরোধীরা গত তেরো বছরে মমতা বন্দোপাধ্যায়, এমনকী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ও টেক্কা দেওয়ার মতো কোনও মুখ হাজির করতে পারেনি। জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়—বিগত ৪৭ বছর ধরে বহমান এই সংস্কৃতি অর্থাৎ ব্যক্তিকে ঘিরে প্রত্যাশা নির্মাণের এই ধারায় পরিবর্তন আনার মতো কোনও মুখ বিরোধী শিবিরে এখনও নেই। আগামী দু-বছরে তৈরি হওয়া কঠিন। ২০১১-য় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে যে কারণে সফল হয়েছিলেন তার সবগুলিই এখন অনুপস্থিত। পরিবর্তনের সেই ভোটে সিপিএম সরকারকে হটাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে প্রত্যক্ষভাবে কংগ্রেস, এসইউসি, পরোক্ষে বিজেপি, একাধিক অতি বামশক্তি, নাগরিক সমাজ, এমনকী তলে তলে বামফ্রন্টের কিছু শরিক দলও।