আরজি কর কাণ্ডে জুনিয়র ডাক্তারদের বিক্ষোভ।
শেষ আপডেট: 26th August 2024 12:42
ক্যালেন্ডারের হিসেবে শ্রাবণ মাস শেষ! তবু আজকাল আকাশ ভেঙে পড়ছে প্রায় রোজই। শহর তিলোত্তমার খানাখন্দগুলো বেরিয়ে পড়ছে জলের তোড়ে। কিন্তু বৃষ্টি মাথায় করেই সেই সব যেন ঢেকে দিয়েছে মানুষের কার্পেট। চারদিকে ছিটকে পড়ছে জনসমুদ্রের সাহসী ঢেউ। অজস্র মোমবাতি আর মশালকুচির শেষ আলোটুকু জোনাকির মতন ছড়িয়ে দিচ্ছে আপামর মানুষ। বৃষ্টির জলের মতোই তাঁদের কোনও বর্ণ নেই, ধর্ম নেই। কেবল আছে গণসঙ্গীতের সপ্তক, আছে প্রতিরোধের প্রবণতা আর আছে প্রতিকারের অদম্য প্রতিবাদ। কিন্তু এর শেষ কোথায়?
গল্পটা সবাই জানে। ৯ অগস্ট, ২০২৪। ভাইরাসের থেকেও দ্রুত সংক্রমিত হয়েছে এই দিনের ধারাবাহিক বিবরণ। পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।
আমারই প্রাক্তন হাসপাতাল থেকে এই খবর পেয়ে প্রথমটাই থমকে গিয়েছিলাম। জেনেছিলাম, কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করেছেন, এটি নিছক দুর্ঘটনা। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে নিকট অতীতে এমন আত্মহত্যার ঘটনা বিরল নয়। বরং কানাঘুষো শোনা যায়, পড়াশোনা জানা মেয়েদের সঙ্গে অমন একটুআধটু হয় বাপু!
তবে বেলা গড়াতেই খবর চাউর হয়, দুর্ঘটনা নয়, নয় আত্মহত্যাও। এ যে ধর্ষণ করে খুন! তখনই নড়ে যায় সকলে। কেঁপে যাই আমরা অর্থাৎ প্রাক্তনীরা। হাসপাতালের ভিতরে, ডিউটিরত অবস্থায় আমাদেরই জুনিয়র একটি মেয়ের এমন পরিণতি!
তবে এই কাঁপিয়ে দেওয়া কাণ্ডে কলকাতা পুলিশের তেমন তৎপরতা প্রথম থেকেই ছিল না। থাকার কথাও নয়, কারণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এমন 'বিছিন্ন' ও 'ছোট' ঘটনার এফআইআর করারই প্রয়োজন বোধ করেননি সারাদিন। আমরা প্রাক্তনীরা এতেও চমকাইনি। আমাদের যেন মনে হয়েছিল, এটাই এই কর্তৃপক্ষের কাছে 'প্রত্যাশিত'। মেয়েটির অভাগা বাপ-মা শেষবেলায় এফআইআর করেন। তাঁরা সকালে 'আত্মহত্যা'র খবর পেয়েছিলেন, পরে জানতে পারেন, আদতে কী ঘটে গিয়েছে তাঁদের আদরের মেয়ের সঙ্গে। ততক্ষণে, কোনও রকমে পোস্টমর্টেম সেরে, তড়িঘড়ি পঞ্চভূতে মিশে যায় মেয়েটির দেহ, ধর্ষণ-খুনের মতো অভিযোগে যা কিনা সবচেয়ে বড় 'প্রমাণ'।
কলকাতা পুলিশ অবশ্য নিজেদের অবস্থান সাততাড়াতাড়ি পরিষ্কার করে দেয় এক গোলে এগিয়ে যায়। আত্মহত্যা বলে জানানোর দায়ও তাঁদের নয়, দেহ তড়িঘড়ি করে সৎকার করার দায়ও তাঁদের নয়। বরং একদিনের মধ্যে ডিফেন্সচেরা পাসে আবারও গোল করল কলকাতা পুলিশের। 'হেডফোন' কানেক্ট করে কমিশনার সাহেব জানিয়ে দেন, ধরা পড়েছে অভিযুক্ত। সে ধনঞ্জয়ের মাসতুতো ভাই সঞ্জয়।
সঞ্জয়ের অপেক্ষাতেই ছিল এই গোটা পর্বের চাপানউতোর। হারকিউলিসের মতো ঘটনার যাবতীয় দায়ভার কাঁধে নিয়ে নেয় সে অবলীলায়। তবে দুর্ভাগ্য এই, যে ঘটনার সঙ্গে সঞ্জয়ের হেডফোন কানেক্ট হল বটে, তবে হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররা হোক বা শহরের সাধারণ মানুষ-- কেউ সে গল্পের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারল না!
আমজনতা ততদিনে বুঝে গেছে, এই ধর্ষণ-রোগের কোনও প্রতিষেধক হয়তো নেই, কিন্তু শিরদাঁড়া তো আছে মানুষের! সে তো মাতৃগর্ভের তৃতীয়-চতুর্থ সপ্তাহ থেকেই তৈরি হতে শুরু হয়। সেই শিরদাঁড়ার দায় নিতেই হয়তো লক্ষ লক্ষ জোনাকি জ্যোৎস্না হয়ে ঝরে পড়ল শহরতলির রাজপথে। মোবাইল ওয়ালপেপারে স্বাধীনতার তারিখ আসতে না আসতেই হাল্লারাজার সেনারা ব্যারিকেড কুচিয়ে ঢুকে পড়ে তিলোত্তমার হাসপাতালের ভেতর। খালি হাতে হাসপাতালে ঢুকে কোনও অদৃশ্য জাদুবলে পেয়ে যায় স্টিলের রড। গুঁড়িয়ে দেয় এমার্জেন্সি, তার ওপরের ফ্লোর। নষ্ট হয় লক্ষাধিক টাকার ওষুধ।
কলকাতা পুলিশ চুপ! নার্সদিদিদের টয়লেটে লুকিয়ে ১০৮ বার হনুমান চল্লিশা পড়ে, কোনওরকমে বিপদ থেকে রেহাই পায় তারা।
এর পর বল পাস হল সিবিআইয়ের দিকে। ততক্ষণে অবশ্য হাতুড়ির আর ক্ষমতার বারবার ঠোক্করে চুরমার হয়ে গেছে আরজি করের সেই সেমিনার রুম সংশ্লিষ্ট নানা এলাকা। ক্রাইম সিনের আশপাশটায় অনেক বদল এসেছে রাতারাতি। দুষ্টু লোকের মতোই দুষ্টু ঘর, দুষ্টু দেওয়াল ভ্যানিশ!
খুব সহজে অবশ্য হয়নি তা। মিছিলের ব্যারিকেড করেছিল বহু মানুষ, বহু ডাক্তার। বলতে গেলে এই প্রথম এই লড়াইয়ে মানুষ আর ডাক্তার দুই যুযুধান হয়নি, হয়েছে সহখেলোয়াড়। তবে তাদের সে প্রতিরোধ ভেঙে, ভাঙচুরের পথ খুলে দেয় সেই উর্দি পরা সরকারি কাঠপুতুলের দল। কড়া ডিফেন্সের মুখে পড়ে, কড়া ট্যাকেলে রক্তারক্তিও হয় কিছু। রেফারির মুখ অবশ্য তখনও 'বিনীত'ভাবে অন্য দিকে ঘোরানো ছিল।
এসব দেখে ভিমরি খেয়ে যায় আম আদমি। আসলে এমন ম্যাজিকে অভ্যেস নেই তো মানুষের। এ কেমন ম্যাচ চলছে। কিছু বুঝতে না বুঝতেই রেফারি গোল দেয়। ওন গোল। সঙ্গে বাজায় বাঁশি। ম্যাচ শেষ।
তবে এর পরেই শুরু হয় আসল জনবিস্ফোরণ। প্রসঙ্গত, এর পরেও পশ্চিমবঙ্গের ৯৯% ভাগ হাসপাতালে এমার্জেন্সি আর ওপিডি খোলা থাকে। রোগী দেখেন সিনিয়র ডাক্তাররা। আমরা জুনিয়র ডাক্তাররা আর সাধারণ মানুষ গাঁটছড়া বেঁধে নামি আন্দোলনে। কারণ তিলোত্তমা আমাদের কারও বান্ধবী, কারও বোন, কারও দিদি। ১০ লাখের তোড়া ছুঁড়ে ফেলে মেরুদণ্ড বিক্রি নেই বলে বিস্ফোরক হন ওঁর মা-বাবাও।
এমন অবস্থায় শেষ চার বছরের সাদাকালো খেরোরখাতা নিয়ে সিবিআইয়ের মুখোমুখি বসেন ঘোষবাবু। বল ততক্ষণে সুপ্রিম কোর্টের হাতে। এই মন্দার বাজারে ডবল ডবল চাকরি পেয়ে ঘোষবাবু প্রমাণ করেন, পশ্চিমবঙ্গ মোটেও পিছিয়ে নেই! যারা চাকরি নেই বলে দু'গ্রাস ভাত বেশি খায়, তারা সব ষড়যন্ত্রী আর নেহাত ছেলেমানুষ! তাই প্রতিদিন ঘোষবাবুর অ্যাটেন্ডেন্স শুরু হয় সিজিও কমপ্লেক্সে। দীর্ঘ ডিউটি, ১২-১৩ ঘণ্টার।
এত দীর্ঘ আন্দোলনে আমরাও ধুঁকি, কিন্তু অনড় থাকি। কারণ, আমরা স্পষ্টতই মনে করি, শেষ তিন-চার বছর ধরে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে যে দুষ্ট চক্র তৈরি হয়েছে, তার মদতেই এই ঘটনা। এই যে যা-ইচ্ছে-তাই করলেও পার পাওয়া যায়, এই সাহসটা কে বা কারা জুগিয়েছে? এই তথ্য ভ্যানিশের দায় কার? আসল দোষী কে বা কারা? এত কিসের ভয় যেখানে বাঙালির আবেগ ডার্বিকেও নিরাপত্তার জন্য বন্ধ করে বিরাট পুলিশবাহিনী, র্যাফ নামিয়ে লাঠি চার্জ করতে হয়? পুরোটাই ম্যাচ ফিক্সিং?
এখনও অবধি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে কমিশনার সাহেব-- কেউই কোনও ঘটনার দায়ভার নেয়নি। সবেধন সঞ্জয় ছাড়া আর কোনও সন্দেহভাজনের পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি। সবার সব ক্ষমতা বহাল, পরিবর্তন বলতে কিছু ইধার কা মাল উধার হয়েছে। ঝকঝকে মেয়েটার নাম কাটা গেছে ডিউটি রস্টার থেকে। তার বাপ-মার জীবনটা মরুভূমি হয়ে গেছে। নরকের তাপে পুড়ছেন তাঁরা দিনরাত।
'বড়ি বড়ি শহরোমে ছোটি মোটি বাতে'... এসব শুনতে বলিউডি সিনেমায় বেশ লাগে। তবে আমরা কিনা ঋত্বিক ঘটকের দ্যাশের লোক! আমরা কিনা অযান্ত্রিক কিছু রক্তমাংসের মানুষ! তাই আমাদের বোনের যে স্বপ্ন রক্ত দিয়ে শেষ হয়েছে তার জন্য আমরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ব। কথা দিলাম।
বাঙালি পারে! এখনও পারে!
(লেখক বর্তমানে এসএসকেএম হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসক।)