শেষ আপডেট: 18th August 2024 17:14
অমল সরকার
আরজি কর হাসপাতালের ঘটনায় আদালতের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত হচ্ছে। আশা করব তারা আরজি করে কর্তব্যরত চিকিৎসক ছাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পিছনে আরও কোন অপরাধীরা যুক্ত থাকলে তাদের চিহ্নিত এবং ধর্ষণ-খুনের মতো নৃশংস হত্যার কারণ উন্মোচন করবে।
আরজি করের ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেশের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। শনিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ফোনে বললেন, ‘আমরা দেড়-দু’মাসের লড়াইয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছি। কলকাতা থেকে প্রেরণা পেয়ে শুক্রবার রাতে ঢাকার মেয়েরা রাত দখলের ডাক দিয়েছিল। আমরা পুরুষেরাও সেখানে শামিল হয়ে অঙ্গীকার করেছি, নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের অন্যতম লক্ষ্য।’ আসলে নির্ভয়া কাণ্ডকেও ছাপিয়ে গিয়েছে আরজি করের ঘটনার জন-প্রতিক্রিয়া।
প্রবল শক্তিধর সামাজিক মাধ্যম যেমন অপপ্রচার, কুৎসা রটনায় সিদ্ধহস্ত, তেমনই এক-দেড় দশক আগে দেশে দেশে শুরু হওয়া পরিবর্তনের আরব বসন্তের যে ঢেউ মানুষকে উদ্বেলিত করছে সেই সাফল্যের পিছনেও আছে এই মানব-বান্ধব প্রযুক্তি, যেখানে কমনম্যান সাড়া দিচ্ছে অর্ডিনারি পিপলের ডাকে।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্রী রিমঝিম সিনহা এর আগেও বহু সামাজিক ইস্যুতে আন্দোলন সংঘঠিত করেছেন। যদিও এই ব্যাপারে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালের বাকি পড়ুয়াদের দূরবস্থা নিয়ে দু-চার কথা না বললেই নয়। নকশাল আন্দোলনের কথা ছেড়েই দিলাম, বছর বিশ-বাইশ আগেও এই ক্যাম্পাস থেকে দেশ-বিদেশের নানা অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে যেভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা আওয়াজ তুলত তা আজ বিরল। রিমঝিমকে তাই একাই রাত দখলের ডাক দিতে হয়েছিল।
প্রেসিডেন্সির পড়ুয়ারা অতীতের দিকে চাইবে কি না, ভবিষ্যৎ বলবে। শুধু জানিয়ে রাখি বাংলাদেশে সদ্য সংঘঠিত গণ অভ্যুত্থানের পিছনে এই প্রথম দেশটির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও সমানভাবে অংশ নিয়েছিলেন, সরকারি চাকরি পাওয়া যাদের লক্ষ্য নয়। তারা বহুজাতিক এনজিও, বেসরকারি সংস্থা এবং বিদেশের চাকরি জোটাতে মোটা টাকা ব্যয় করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন সেই ক্যারিয়ারমুখী তরুণ-তরুণীদেরও ছুঁয়ে গিয়েছিল।
রাত দখলের ডাক দেওয়া প্রেসিডেন্সির সেই তরুণী কোনও নেত্রী নয়, নন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার। তবু তাঁর ডাকে কোটি কোটি মানুষ যে সাড়া দিলেন তার রসায়নটা কী? সেটা এটাই যে, মানুষ নানা কারণে ক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট। আরজি করের ঘটনায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল। একটা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভিতরে কর্তব্যরত চিকিৎসককে যদি সেমিনার হলের মতো মুক্ত মঞ্চে কেউ ধর্ষণ-খুন করার সাহস ধরে তাহলে বুঝতে হবে অসুখটা ক্যান্সারের মতো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোর অনেক গভীরে পৌঁছে গিয়েছে। নির্ভয়া কাণ্ডের সময়টা স্মরণ করলে বোঝা যাবে, আর্থিক সংকট, বেকারি, মূলবৃদ্ধি এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে হাঁসফাস অবস্থাই মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল সরকারি বাসে তরুণীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা।
চিকিৎসক ছাত্রীর মৃত্যু ঘিরে বিরোধী দলগুলি পথে নেমেছে। পথে নেমেছে শাসক দলও। তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বাধীনতা দিবসের সকালে আগের রাতে আরজি কর হাসপাতালে দুষ্কৃতী হামলার ঘটনা নিয়ে প্রতিক্রিয়াটি লক্ষণীয়। তিনি দল নির্বিশেষে অপরাধীদের গ্রেফতারের পাশাপাশি ডাক্তারদের আন্দোলনকে সমর্থন করে এক্স হ্যান্ডেলে মন্তব্য করেন, ‘নিরাপত্তা চাওয়াটা তাঁদের ন্যূনতম চাহিদা, যা সরকারের কাছ থেকে তাঁরা প্রত্যাশা করতেই পারেন। তাঁদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা পাওয়াটা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।’ ছাত্রী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরও তিনি অভিযুক্তদের কঠোর সাজা চেয়ে সরব হয়েছিলেন।
আরজি কর হাসপাতালে মাঝরাতে দুষ্কৃতী হামলার খবর আগাম না পাওয়া এবং তা ঠেকানোর মতো বাহিনীর অনুপস্থিতির মতো কলকাতা পুলিশের ব্যর্থতার নজির স্মরণকালের মধ্যে নেই। হামলার ধরণ থেকে স্পষ্ট দুষ্কৃতীদের উদ্দেশ্য ছিল অপরাধের প্রমাণ লোপাট এবং সিসিটিভির ফুটেজগুলি নষ্ট করা। ২৫জন গ্রেফতার করার পরও কারা তাদের পাঠিয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্রারীদের বিষয়ে পুলিশ চুপ। কাউকে আড়াল করা হচ্ছে না তো!
পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতার দায় সরকার ও শাসক দলের উপরই পড়ে। ফলে তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ পুলিশ ও হাসপাতাল প্রশাসনকে তারা কাঁধে বহন করবেন কিনা। অভিযুক্ত সিভিক পুলিশ কর্মী কোন কর্তার প্রশ্রয়ে ব্যারাকে থাকার জায়গা পেয়েছিল, রাত-বিরাতে বেরিয়ে পড়ত, সেই বিষয়টিও তদন্তের আওয়াত আসা দরকার।
অভিষেক তৃণমূলের প্রতিবাদ আন্দোলন থেকে দূরে থাকায় অনেকেই মনে করছেন, পুঞ্জিভূত ক্ষোভ জমা হয়েছে শাসক দলের অন্দরেও। দলের প্রবীণ নেতা তথা রাজ্যসভার সাংসদ ও পার্টির মুখমাত্র ‘জাগো বাংলা’র সম্পাদক সুখেন্দুশেখর রায়ের ভিন্ন সুরে ঘটনার প্রতিবাদও নজর এড়ায়নি।
যে কথা বলছিলাম, আরজি করের ঘটনার আড়ালে অন্য কিছু থেকে থাকলে সিবিআই আশা করব তা ফাঁস করবে। তবে যে পরিস্থিতির কারণে একটা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মতো সদা ব্যস্ত এলাকায় এমন ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘঠিত হতে পারল তার পরিবর্তন কে করবে?
কলকাতা হাই কোর্ট নির্দেশিত তদন্তের সূত্রে এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট রাজ্যের শিক্ষার কী বেহাল দশা। নিয়োগ দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার পর পরিচিত এক যুবা শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘স্কুলে পড়ানোর কথা এখন আর বলি না। কারণ, শিক্ষক পরিচয় দেওয়ার পর সামনে দাঁড়ানো মানুষটির চোখ-মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারি, তাঁকে এই প্রশ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছে, আমি নিজের যোগ্যতায়, নাকি টাকার জোরে চাকরি পেয়েছি।’
ইতিপূর্বে স্বাস্থ্য দফতরে চাকরিরও বহু প্যানেল বাতিল হয়েছে আদালতের নির্দেশে। সেটা অমিয়মের একটি দিক। বেশিরভাগ দফতরই এই দোষে দুষ্ট। তেমনই ব্যক্তিগত এবং পাঁচজনের প্রয়োজনে যাতায়াতের সুবাদে বলতে পারি, সরকারি হাসপাতালগুলি ভাল নেই। বিশেষ করে মেডিক্যাল কলেজ এবং জেলাস্তরের হাসপাতালগুলিতে অনিয়ম, অনাচার মাত্রা ছাড়িয়েছে।
বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের বিনিময়ে চিকিৎসা না করার অভিযোগ আগের তুলনায় কমে এসেছে। অথচ ওই কার্ড দেখিয়ে বহু সরকারি হাসপাতালেও বেডের জন্য মোটা টাকা গুণতে হয়? যে দরদী চিকিৎসকেরা রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাড়াতাড়ি ভর্তির ব্যবস্থা করতেন, অপারেশন করে দিতেন, বহু বছর হল তাঁরা হাত তুলে দিয়েছেন। কারণ, বেডের উপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ নেই।
সংবাদমাধ্যমে আরও নানা ধরনের অনাচারের খবর সামনে এসেছে, ওষুধের মান থেকে মেডিক্যাল শিক্ষা, কোনও কিছুই বাদ নেই। আরজি কর কাণ্ডে যে চিকিৎসক নেতার পুত্রের কূ-কীর্তির কথা মুখে মুখে ঘুরছে এমবিবিএস পরীক্ষায় বই থেকে টোকার সময় তাঁকে হাতেনাতে ধরার পর সে সগর্বে মায়ের বয়সি শিক্ষিকাকে হল কাঁপানো গলায় বলেছিল, ‘জানেন আমি কার ছেলে?’ কিছুক্ষণ পর পুত্রের বাবা শিক্ষিকাকে ফোনে হুমকি দেন, তাঁর ছেলের ক্যারিয়ার নষ্ট করার চেষ্টার পরিণতি ভাল হবে না। আরজি কর কাণ্ডের পর জানা যাচ্ছে, এমবিবিএস-সহ মেডিক্যাল কোর্সগুলিতে টাকা দিয়ে পাশ করার নানা আয়োজনের কথা এবং সেই চক্রে প্রিন্সিপ্যাল, ভাইস প্রিন্সিপ্যালদের মতো শীর্ষস্থানীয় পদাধিকারীদের একাংশও যুক্ত বলে অভিযোগ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সরকারি হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা করে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিলেও মুদ্রার উল্টো পিঠের সত্যটা হল ডাক্তার-সহ চিকিৎসা পরিকাঠামোর সঙ্গে চাহিদার আজও বিপুল ফারাক। যদিও একথা মানতে হবে, চলতি জমানায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অনেক উন্নতি হয়েছে। এই ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিকতায় ঘাটতি নেই। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক অপর্যাপ্ত হওয়ার কারণে জুনিয়র ডাক্তারদের কখনও কখনও ৪৮ ঘণ্টাও ডিউটি করতে হচ্ছে। যা পুলিশ, সেনা, আধা সেনাকেও করতে হয় না। যদিও দিনরাত রোগী দেখা শিক্ষার্থী চিকিৎসকদের কাজ নয়। প্রধান কাজ পড়াশুনোর পাশাপাশি হাতে-কলমে চিকিৎসা শেখা।
আরজি করের ঘটনা ইঙ্গিত করে গোটা সিস্টেমের মধ্যে ঘুণ ধরে গিয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটি উপায় হতে পারে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পর্যালোচনায় সরকারের বাইরে থাকা উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠন। বছর বিশ-বাইশ আগে পিজি হাসপাতালে এক তরুণীর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনার প্রেক্ষিতে বিস্তর অভিযোগের মুখে সদ্য প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অর্থাৎ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বোম্বে হাই কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়কে চেয়ারম্যান করে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গড়েছিলেন। সেই কমিটি সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক ফাঁকফোকড় সরকারের সামনে হাজির করেছিল। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র নিষ্ঠার সঙ্গে ফাঁকগুলি পূরণের চেষ্টা করেছিলেন। পুরোপুরি সফল হয়েছিলেন বলা যাবে না। তবে চেষ্টার ক্রুটি ছিল না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রভূত পরিবর্তন এসেছে। অনেক বেশি মানুষ সরকারি হাসাপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন। কিছু প্রথম পাঁচ-সাত বছর যে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলি দৃশ্যমান ছিল, সেগুলি অনেকটাই আড়ালে চলে গিয়েছে। আরজি করের ঘটনা এসএসএসকেএম-এ তরুণীর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর থেকে শতগুণ মর্মান্তিক এবং উদ্বেগের। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অসুখগুলি খুঁজে বের করার জন্য আর কোনও আরজি কর কাণ্ডের অপেক্ষা না করাই ভাল। সরকার পুলিশ এবং ডাক্তার, নার্স-সহ হাসপাতাল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত সকলকে মোটা টাকা বেতন দেয়। তাঁদের অপদার্থতা, অপকর্মের দায় সরকার কেন নিচ্ছে? তাঁদের জবাবদিহিতার মুখে ফেলাই বরং সঠিক পদক্ষেপ হবে।