শেষ আপডেট: 22nd September 2024 16:25
অমল সরকার
আরজি করের শিক্ষার্থী ছাত্রীর ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তাররা অবশেষে শনিবার থেকে আংশিকভাবে কাজে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, আন্দোলনও পাশাপাশি চলবে। অনেকেই ডাক্তারদের ঘোষণামনিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সিদ্ধান্তটা ক’দিন আগে নিলে মহাভারত অশুদ্ধ হত কি?
প্রশ্নটি ন্যায্য। কারণ, রাজ্য সরকার আন্দোলনকারীদের প্রায় নব্বই ভাগ দাবিই দিন ছয়েক আগে মেনে নিয়েছিল।
আমাদের দেশে দাবিদাওয়া আদায়ের প্রচলিত ব্যবস্থা হল, বন্দুকের লাইসেন্স পেতে কামানের জন্য দরখাস্ত করতে হয়। অনেক দরকষাকষির পর শেষে বড়জোর দেশি বন্দুকের লাইসেন্স মেলে।
সেই প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় রেখে বলা যায়, আরজি করের ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারদের অর্জন বিপুল এবং বিগত কয়েক দশকে এমন নজির নেই। ফলে বাকি দাবিগুলির ব্যাপারে একটু পিছু হটলেও তাঁদের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো বিজয়ের গরিমা ক্ষুন্ন হত না। বঙ্গ রাজনীতিতে আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠা নেত্রীকে এই প্রথম গণ আন্দোলনের দাবির কাছে মাথা নেয়াতে হল।
আর একটি দিক হল, ডাক্তার ছাড়া জীবন অচল। তার উপর জমানা নির্বিশেষ সরকারি হাসপাতালগুলি শিক্ষানবিশ চিকিৎসক নির্ভর। জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মস্থলে না থাকলে রোগী ও পরিজনের দুর্ভোগ অবশ্যম্ভাবী। তাছাড়া বেশ কিছু জেলা বন্যার কবলে। সুতরাং, ডাক্তাররা আরও আগে কর্মক্ষেত্রে ফিরলে ভাল হত।
সমস্যা হল উল্টো দিক থেকে ধেয়ে আসা প্রশ্নটি। রাজ্য সরকার যখন পুলিশ কমিশনার, ডিসি নর্থ এবং দুই স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে সরাবেই তখন ৩৮ দিন অপেক্ষা কেন করল? এক মাস আট দিন ধরে জুনিয়র ডাক্তারদের হাসপাতালে না থাকার দায় চিকিৎসদের নাকি, প্রশাসনের?
আসলে দাবিদাওয়ার প্রশ্নে বিবদমান দু’পক্ষের পিছনে সর্বদা এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়ে যায়। কার্যক্ষেত্রে পরিস্থিতি এত দূর গড়ায় যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও কোনও পক্ষই আপোস মীমাংসায় পৌঁছাতে পারে না। প্রশ্ন হল, এইক্ষেত্রে বিবদমান এক পক্ষ রাজ্য সরকারের গোড়ার আপোসহীন মনোভাব কি ন্যায্য ছিল। প্রশাসন সচল রাখার প্রাথমিক দায় কিন্তু সরকারের।
আরজি করের ঘটনার গুরুত্বটাই প্রশাসন বোঝনি, গোড়াতেই তা বোঝা গিয়েছিল। ভারতে ধর্ষণ-সহ নারীর প্রতি যৌন লাঞ্ছনার ঘটনা পথ দুর্ঘটনাকে ছাপিয়ে যেতে বসলেও বলব, বিগত তিন-চার দশকেও এ দেশে আরজি করের মতো ধর্ষণ-খুনের ঘটনা ঘটেনি। এমনকী দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডও নয়।
কলকাতার মতো শহরে একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, যেখানে বলতে গেলে সূর্যদয়-সূর্যাস্তের বালাই নেই, ৩৬৫ দিন ২৪X৭ আলো ঝলমল করে, সেখানে শিক্ষার্থী চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুন প্রমাণ করে নৈরাজ্য কোন পর্যায়ে গিয়েছে। হাসপাতাল প্রশাসনের একাংশ আপদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অশুভ চক্রের শরিক না হলে এমন ঘটনা সম্ভব নয়। অনাচারের স্বঘোষিত সাক্ষী শান্তনু সেন আশা করব, স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এবার সিবিআইয়ের মুখোমুখি হবেন। জুনিয়র ডাক্তারদের সম্পর্কেও একই কথা বলব। তাঁরাই হাসপাতালের চোখ-কান-মুখ। অনাচারের ঘটনার তাঁরা প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁরা কেন তদন্তকারীদের সব খুলে বলছেন না!
দীর্ঘদিন আমি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে খবর করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তৃণমূল জমানায় স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে উন্নতি ও অনাচার দুই-ই সমানতালে বেড়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে আরও বলতে পারি, জুনিয়র ডাক্তারদের আরজি করের ঘটনার তদন্তে অনেক কিছু ফাঁস করার আছে। শুধু নির্ভয়ার বিচার চেয়ে ধরনা দিয়ে তাঁদের কথা দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
অন্যদিকে, সরকারের করণীয় ছিল, কর্তব্যে গাফিলতির দায়ে হাসপাতালের প্রিন্সিপ্যাল, সুপার-সহ পদস্থ কর্তাদের সবচেয়ে আগে শো-কজ করা। ঘটনার পর পুলিশ কমিশনার কালবিলম্ব না করে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সিবিআই প্রমাণ লোপাট, বিলম্বে এফআইআর, দ্বিতীয়বার ময়না তদন্তের দাবি না মানার অভিযোগে টালা থানার ওসি-কে গ্রেফতার করেছে। প্রশ্ন হল, ওসি-র এই গাফিলতি কেন পুলিশ কমিশনার, ডিসি নর্থ, জয়েন্ট সিপি ক্রাইমের মতো পদস্থ অফিসারদের নজরে এল না? তাঁরা তো সকলেই মনিটরিং অফিসার। ওসিকে গাইড করাই ছিল তাঁদের কর্তব্য। এত সব গাফিলতি সত্ত্বেও মর্মান্তিক ধর্ষণ-মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ কমিশনার-সহ পদস্থ আধিকারিক এবং স্বাস্থ্য অধিকর্তাদের অপসারণের দাবি কি অযাচিত ছিল? নৈতিক দায় তো কাউকে নিতেই হবে। এ রাজ্যে তো লাঠি পেটার কারণেও পুলিশ বদলির দৃষ্টান্ত রয়েছে।
জুনিয়র জাক্তাররা পুলিশ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেনি। তারা পদস্থ কর্তাদের অপসারণ দাবি করেছিল। যা ন্যুমতম এবং ন্যায্য।
সরকার কেন যথাসময়ে সেই দাবি মানেনি? আসলে সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পিঠ ঠেকেছিল ইগো আর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের দেওয়ালে।কারণ, তারা পুলিশ দিয়ে রাজনৈতিক দলের আন্দোলন মোকাবিলায় পারদর্শী। ঝাণ্ডাবিহীন অহিংস আন্দোলনের শক্তিকে সামাল দিতে শেখেননি।
ঠিক দশ বছর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের 'হোক কলরব' তেমন আন্দোলনের আভাস দিয়েছিল। কী আশ্চর্য সমাপতন, শিক্ষাকে লাটে তুলে দিয়ে যাদবপুরের উপাচার্যকে সরাতেও সরকার ছয় মাস সময় নিয়েছিল।
সেদিক থেকে আরজি করের আন্দোলনকারীদের কাছে সরকার অনেক আগে মাথা নোয়ালো বলা চলে। তারপরও ৩৮ দিনের অচলাবস্থা অন্যতম কারণ জুনিয়র ডাক্তারদের পিঠ ঠেকেছিল প্রতিবাদী সাধারণ মানুষের প্রাচীরে।
জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন নতুন নয়। তবে এবারের মতো কখনও তাঁদের সিনিয়র তথা পাকা চাকরিরত চিকিৎসকেরা পাশে দাঁড়াননি। সরকারি হাসপাতাল তেমন অচল হয়নি সিনিয়র চিকিৎসকেরা বাড়তি সময় থেকে জুনিয়রদের আন্দোলনের পাশে থাকায়।
গত রবিবার বিকালে সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ক থেকে ডাক্তারদের ডাকে অনুষ্ঠিত মিছিলে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকেরা সংখ্যায় হারিয়ে গিয়েছিলেন অচিকিৎসক মানুষের ভিড়ে। রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে গিয়েছিলেন ডাক্তারদের মিছিল সফল করতে।
সোমবার রাতে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা চলাকালে কলকাতার বহু রাস্তায় সাধারণ মানুষ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল আলোচনার পরিণতি জানতে। ডাক্তাররা আপোস করলে পথে থাকা মানুষ কী করত বলা মুশকিল। অভিজ্ঞতা ভাল হত না বলেই বহুজনের ধারণা। সবাই মনে করেছে, একটা ন্যায্য আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘদিন অনাচার সহ্য করে মুখ বুঝে থাকার ভুল ঝেড়ে ফেলে প্রতিবাদের ঋণ পরিশোধ করি। দেশের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ও সম্ভবত উপলব্ধি করেছেন, এই মামলায় গোটা দেশে দেশ নজর আছে শীর্ষ আদালতের দিকেও।
আরজি করের ঘটনার পাঁচদিনের মাথায় ১৪ অগাস্ট রাত দখলের কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্রী রিমঝিম সিনহা। তাঁর ঘোষণায় কারও পদত্যাগ, কারও অপসারণের দাবি ছিল না। তিনি পিতৃতান্ত্রিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর সেই ফেসবুক পোস্টের ঘোষণা যে এত মানুষকে নাড়া দেবে, কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন?
এবার কিন্তু ভাবতে হবে। প্রশাসন, ক্ষমতাসীন-বিরোধী নির্বিশেষে সব দল, নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব এবং সংবাদমাধ্যমকে ভাবতে হবে আরজি করের শিক্ষার্থী ছাত্রীর ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় এত মানুষ প্রতিবাদে পথে নামলেন কেন?
আসলে আন্দোলনরত চিকিৎসকেরা যে ‘থ্রেট কালচার’-এর কথা বারে বারে বলছেন, তা শুধু হাসপাতালের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। পেশাগত এবং সামাজিক জীবনের এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে ভয় দেখানো, ভয় পাওয়ানোর কালচার বিরাজ করছে না।
সমানতালে চলছে চুরি-দুর্নীতি-অনিয়ম-অনাচার। চাকরি চুরি, চাল-গম চুরি, গরু পাচার, কয়লা পাচারের ঘটনায় নেতা মন্ত্রীর জেল এ রাজ্যে নজিরবিহীন। বাংলার লজ্জা। সরকারি দফতরে স্পিড মানি নামক ঘুষের কারবার এখনকার মতো গেড়ে বসেনি কখনও। রামের কবিতা শ্যামের বলে মানতে কেউ বাধ্য করেনি। মানুষ তবু রা কাড়েনি। কেউ কেউ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে দায় সেরেছেন।
বদলের পক্ষে ভোটদানকারীরা নয়া শাসকের ভুল-ক্রটি মার্জনা গোাড়ায় মার্জনা করে দিয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ সপরিচয়ে, কেউ ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে ঢিল ছোড়ার চেষ্টা করেছেন। শাসক দল সে সব গায়ে মাখেনি, কারণ, এই আলগা প্রতিবাদ ভোটের বাক্সে প্রভাব ফেলে না। ভোট সংখ্যার খেলা। সরকারি সুবিধাভোগী দিন আনি দিন খাই মানুষ পাশে থাকলে কোনও প্রতিবাদ, সমালোচনাকেই শাসক ধর্তব্যের মধ্যে নেয় না।
দুর্ভাগ্যের হল, জমানা নির্বিশেষে এ রাজ্যে ভাল-মন্দ, ন্যায্য-অন্যায্য নির্ধারণে ভোটকেই মানদণ্ড করা হয়েছে। যেন যারা জিতেছে তাদের সাতখুন মাফ। অন্যায়-অবিচারের ঘটনায় বিচার পেতে একটা নির্বাচনের অপেক্ষা করাই যেন দস্তুর।
বিজেপির দ্রুত উত্থান এবং ততধিক গতিতে বামেদের পতনের জেরে তৃণমূলের অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করা মানুষকেও বুথে গিয়ে ভাবতে হয়েছে, ভোটটি কাকে দেবেন, কেন দেবেন। বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে রাজ্যটিকে মুক্ত রাখতে চাওয়া বহু মানুষ তৃণমূলকে বেছে নিয়েছেন বিকল্পের অভাবে। তৃণমূল মনে রাখল না, লোকসভা ভোটে ২৯ আসনে জয়ের অর্থ পার্থ, জ্যোতিপ্রিয়, অনুব্রতদের অপকর্ম মেনে নেওয়া নয়। মেনে নেওয়া নয় প্রশাসন ও শাসক দলের একাংশের অন্যায়, অবিচার। হতে পারে, আরজি করের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকা দুটি দফতর কাঠগড়ায় ওঠায় আন্দোলন নয়া মাত্রা পেয়েছে।
আসলে মানুষের পথে নামার পিছনে আরজি কর একটা স্ফুলিঙ্গ মাত্র। ক্ষোভের বারুদ জমা হয়েছে গত তেরো বছরে।
আমি ইতিপূর্বে একটি লেখায় বলেছি, পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশ নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও শেখ হাসিনা নন। অনাচার-অবিচারে আকাশ-পাতাল ফারাক আছে এপার-ওপারের। কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাবলী থেকে সব শাসকের শিক্ষা নেওয়ার আছে। সে দেশেও মানুষ পনেরো বছর মুখ বুঝে থেকে হাসিনার সরকারের দুর্নীতি, ভোটাধিকার, মানবাধিকার হরণ এবং একদলীয় শাসন কায়েমের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। এপারেও দেখা গেল, নীরবতা, প্রতিবাদ না করে হাত গুটিয়ে থাকা মানুষ আইলা-আপফানের মতো ঘূর্ণিঝড়ের মতো গর্জে উঠল। এই ঝড়ের পূর্বাভাসকে উপেক্ষা করাই সবচেয়ে মুর্খামি। সেই ঘূর্ণির মুখে কারও স্ট্যাম্প উল্টে যায় না তবে 'ক্ষমতালোভী নন', কষ্টার্জিত এই ভাবমূর্তি, শ্লাঘা বিসর্জন দিয়ে কোনওরকমে উইকেটে অর্থাৎ ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়।