শেষ আপডেট: 14th April 2024 09:20
আজ পয়লা বৈশাখ। বঙ্গাব্দ ১৪৩১-এর প্রথম দিন। পশ্চিমবঙ্গে এবারের পয়লা বৈশাখের আলাদা তাৎপর্য হল, এ বার থেকে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি বাংলা দিবস হিসাবে পালিত হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত ৭৭টি বছর এ রাজ্যের কোনও জন্মদিন ছিল না। আজ কেন একটি দিনকে জন্মদিন বলে বাছতে হল, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত নই। কেন নই, সে ব্যাপারে নিজের কথা তুলে ধরা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
কিন্তু এটা মানতেই হবে, পয়লা বৈশাখ বলি, কিংবা রাজ্যের জন্মদিন, তা পালন মানে যা কিছু বাঙালির তার উদযাপন। আত্মপরিচয়ের উপাদানগুলির আরও বেশি করে চর্চা এবং নিজের মধ্য ধারণ করার সংকল্প গ্রহণ। ভাষা-নাচ-গান-কবিতা-সাহিত্য-পোশাক-খাবার এসবই একটা জাতির পরিচয়ের অংশ। মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটি তো আমাদের খাদ্য সংস্কৃতিকেই জানান দেয়। খাদ্যভাস গড়ে ওঠে প্রকৃতির নিয়মে। বাংলায় জলবায়ু, আবহাওয়া, বিপুল জলরাশির কারণে মাছ-ভাতই প্রধান খাবার হয়ে ওঠার কথা ছিল। বৈশাখ যদিও মাছের টানাটানির সময়। তবু বাঙালি মাত্রেই চেষ্টা করে বাংলা বছরের প্রথম দিনটি মাছ ভাত, মাংস ভাত খাওয়ার।
বাঙালির এমন একটা শুভক্ষণে সেই মাছ-মাংস নিয়ে বিতর্ক বাধিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। রামনবমীর সময় মাছ-মাংস খাওয়া নিয়েই একপ্রকার প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন তিনি। এ রাজ্যে বাঙালির সিংহভাগ হিন্দু। আজ পয়লা বৈশাখে আমরা কি মাছে ভাতে বাঙালি থাকব নাকি মাছ-মাংস বর্জন করে নিজেদের গর্বিত হিন্দু ঘোষণা করব? শুক্রবার জম্মু-কাশ্মীরের উধমপুরের সভায় নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ আমাদের এই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
সেই সভায় নাম করেননি, কিন্তু রাজনীতির ধারাবাহিক পরিদর্শকদের কাছে গোপন থাকেনি, তিনি রাহুল গান্ধী, লালুপ্রসাদ যাদব এবং তাঁর পুত্র তেজস্বীর রামনবমী এবং শ্রাবণ মাসে মাছ-মাংস খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, এঁরা সংখ্যাগুরু মানুষের ভাবাবেগে আঘাত করেছেন। মাছ-মাংস খাওয়ার ভিডিও প্রচার করে হিন্দুদের আঘাত করে সংখ্যালঘুদের তুষ্ট করতে চেয়েছেন।
ভিডিওগুলির বিষয়ে অনেকেই ওয়াকিবহাল। গত বছর শ্রাবন মাসে লালুপ্রসাদের দিল্লির বাড়িতে গিয়েছিলেন রাহুল। লালুপ্রসাদ তাঁকে নিজের হাতে মাংসের বিহারী পদ রান্না করে খাওয়ান। রান্না ভাল লাগায় রাহুল নিজেই বোন প্রিয়ঙ্কার জন্য মাংস চেয়ে নিয়ে যান। লালুপ্রসাদের বাড়িতে রান্না ও খাওয়ার ছবি পরে এক্স হ্যান্ডেলে দিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা।
অন্যদিকে, লালুপ্রসাদের ছোট ছেলে তেজস্বীর নিবাচনী প্রচারে হেলিকপ্টারে ওঠার আগে খাওয়াদাওয়ার ভিডিও কেউ পোস্ট করে। তাতে দেখা যায় তিনি মাছ খাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী ওই ভিডিও দুটির প্রসঙ্গ তুলে বিরোধী শিবিরের এই তিন নেতাকে মোগলদের সঙ্গে তুলনা করেন। বলেন, মোগলেরা শুধু এ দেশের হাজাদের ক্ষমতাচ্যুত করেই খুশি হত না। তারা হিন্দু মন্দির ভাঙত। প্রধানমন্ত্রী বলতে চেয়েছেন, লালু-রাহুল-তেজস্বীরা শুধু যে রামনবমী, শ্রাবন মাসে মাছ-মাংস খেয়েছেন তাই-ই নয়, সেই ছবি প্রচার করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাবাবেগকে আঘাত করেছেন।
নরেন্দ্র মোদীর কথাবার্তা প্রধানমন্ত্রী সুলভ নয়, এ কথা কারও জানতে বাকি নেই। এটাও অজানা নেই, ভোটের স্বার্থে পাড়ার নেতা হতেও তাঁর বাধে না। ভারতে নির্বাচন বহুকাল ধরেই ক্ষমতা দখলের নীতি-আদর্শহীন যুদ্ধে পর্যবসিত হয়েছে। যে কোনও উপায়ে ক্ষমতার কুর্সি দখলই লক্ষ্য। বিগত এক দশক, অর্থাৎ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জমানায় নির্বাচন আরও কুৎসিত চেহারা নিয়েছে। পরিচ্ছন্ন নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তৈরি করা গেলে এ দেশের স্থান হবে নীচের দিকে।
কারণ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে নির্বাচন হয়ে উঠেছে স্রেফ যুদ্ধ। যেমন করে সম্ভব প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই লক্ষ্য। দুর্ভাগ্যের হল, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও ভোট-রাজনীতির এই অপসংস্কৃতি মুক্ত নন। বরং এই ব্যাপারেও তিনিই দলের ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ। জম্মু-কাশ্মীরের উধমপুরের নির্বাচনী সভায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনে মনে হবে ‘অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’, ব্রিটিশ কবির এই স্মরণীয় লাইনকে ভোটের লড়াইয়ে আপ্তবাক্য করেছেন তিনি।
আপাত দৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রী ওই তিন নেতাকে নিশানা করেছেন বলে মনে হলেও আসলে তিনিও আর পাঁচজন কট্টর আরএসএস-বিজেপি নেতার মতো পুজোপার্বণে আমিষ খাবারের উপর পরোক্ষে নিষেধাজ্ঞার পক্ষে সুর মিলিয়েছেন। যদিও বলেছেন, আইনে মাছ-মাংস খাওয়ার উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। তারপরও যা বলেছেন, তার অর্থ, আইন যাই বলুক না কেন, হিন্দুদের উৎসব অনুষ্ঠানের কথা বিবেচনায় রেখে খাবারদাবারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত করা দরকার বাকিদের।
দুর্গাপুজোর সময় নবরাত্রী, শ্রাবণ মাস এবং রামনবমীতে মাছ-মাংস না খেতে বিজেপি বিগত কয়েক বছর যাবত হুমকি, হুঁশিয়ারি দিয়ে চলেছে। গত বছর মধ্যপ্রদেশের নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে আমিষ খাবারের উপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিরোধিতার মুখে পিছু হঠেছে।
আমাদের দেশে মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মাবলনম্বীরা প্রায় সকলেই আমিষাশী। হিন্দুদের মধ্যে কোন পক্ষ সংখ্যায় ভারী বলা কঠিন। নিমামিষ খাবারের পক্ষে প্রচারের মধ্যেই দেশজুড়ে মাছ-মাংস-ডিমের পদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। হিন্দি বলয় তো বটেই, এমনকী গুজরাতও এই প্রবণতা থেকে মুক্ত নয়, যে রাজ্যটি সরকারিভাবে নিরামিষাশি। বাড়িতে নিরামিষাশী, বাইরে আমিষ ভক্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
এই প্রবণতা, বাস্তবতাকে অস্বীতার করে দুই ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের বাস বেশি, বিগত কয়েক বছরে বেছে বেছে সেই সব এলাকায় হিন্দুদের উৎসবের সময় মাছ-মাংস না খেতে অলিখিত ফতোয়া জারি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য গুজরাতের আমদাবাদ শহরে আমিষ খাবারের দোকানে হামলা হয়। বছর আড়াই দুই আগে দক্ষিণ দিল্লির তৎকালীন বিজেপি শাসিত পুর নিগমের মেয়র নবরাত্রীতে মাছ-মাংসের দোকান বন্ধ রাখার নিদান দেন। কয়েক কদম এগিয়ে রাজধানীর এক বিজেপি সাংসদ পরবেশ বার্মা দাবি করে বসেন, নবরাত্রিতে গোটা দেশেই মাছ-মাংসের দোকান বন্ধ রাখা হোক।
গো-হত্যা বন্ধের নামে গরুর মাংস বিক্রি, পরিবহণ এবং খাওয়ার উপর নানা বিধি জারি হয়েছে বিজেপি শাসিত একাধিক রাজ্যে। বহু নিরীহ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং নিম্নবর্গের হিন্দু, হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত রক্ষাকর্তারা হাতে আক্রান্ত হয়েছেন। পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বহুজনকে।
খাবার, পোশাককে ঘিরে ভারতে সাম্প্রদায়িক, জাতিগত অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘কাপড়া সে পাতা চল যাতা হ্যায়……। রামনবমী, মহরমের মিছিল ঘিরে অশান্তির মূলে আছে সহ-নাগরিকের ধর্মাচরণের অধিকারকে অস্বীকারের মানসিকতা। প্রধানমন্ত্রী রামনবমীর সময় মাছ-মাংস খাওয়ার ভিডিও প্রচার নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া কোনও হিংসার জন্ম দেবে না, এই প্রত্যাশা করার পাশাপাশি সেই মানুষগুলিতে নিয়ে চিন্তা থাকছেন, মাছ-মাংস বিক্রি যাদের পেশা, দিনের শেষে পাতে এক টুকরো মাছ কিংবা মাংসই যাদের খাবারে একমাত্র বিলাসিতা, তাদের কথা ভেবে। আমরা বাঙালিরা সেই তালিকার অগ্রভাগে।
প্রধানমন্ত্রী রামনবমী পালনের সময়ে মাছ-মাংস খাওয়াতে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাবাবেগে আঘাতের কথা বলেছেন। মুম্বইয়ের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ পপুলেশন সায়েন্সেস ভারত সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রকের অধীনে থাকা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বছর চার আগে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পঞ্চম রিপোর্ট তৈরির জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের করা সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে দেশের অর্ধেকের বেশি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের ৯০ ভাগ বাসিন্দা আমিষাশী। বাংলায় ৯৭ শতাংশ মানুষ মাছ খেতে পছন্দ করেন। মাংস ও ডিম পছন্দ ৯৬ শতাংশের। আসলে হিন্দি বলয়ের একাংশ এবং গুজরাতের মতো পশ্চিম ভারতের রাজ্যটি বাদে বাকি ভারত আমিষাশী। নিরামিষাশীরা আসলে সংখ্যালঘু। প্রধানমন্ত্রী ধর্মীয় পরিচয় টেনে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু বিতর্ক বাধালেও গর্ব করে বলি আমার সোনার বাংলা, আমি মাছ-ভাত ভালবাসী।