অমর একুশে বইমেলা।
শেষ আপডেট: 11th February 2025 10:35
যে-বইমেলা একসময় ছিল মুক্তচিন্তা প্রকাশের পরিসর, সেখানেই একটি স্টলে হামলা চালানো হল। ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশের বইমেলায়, যা মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিদিন ধরে চলা বইমেলা। এক মাস ধরে পৃথিবীর আর কোথাও বইমেলা সংঘটিত হয় বলে আমার জানা নেই। চরিত্রে এবং ব্যাপ্তিতে অনন্য এই গ্রন্থমেলায় যেভাবে তসলিমা নাসরিনের বই রাখার কারণে সব্যসাচী প্রকাশনার স্টলটি বন্ধ করে দেওয়া হল তা অত্যন্ত চিন্তার এবং নিন্দনীয়। পশ্চিমবঙ্গের একটি সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে যে, সাময়িকভাবে বন্ধ থাকার পর স্টলটি পুনরায় খোলা হয়েছে। তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে, তা খানিকটা স্বস্তির তো বটেই। কিন্তু এই ঘটনা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একাধিক প্রশ্নচিহ্নের জন্ম দিয়ে যায়।
বাংলাদেশের এই অমর একুশে বইমেলার সূচনা হয়েছিল একক উদ্যোগে। ১৯৭২ সালে চিত্তরঞ্জন সাহা একটি চাটাই করে নিজের প্রকাশনা মুক্তধারার বই নিয়ে বসে পড়েন বাংলা একাডেমি চত্বরে। এই প্রচেষ্টাটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, ধীরে ধীরে অন্যান্য প্রকাশকরাও যোগ দেন চিত্তরঞ্জন সাহার সঙ্গে, গড়ে ওঠে বইমেলা। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে এই বইমেলার দায়িত্ব নেয় আর ১৯৮৪ সালে এই বইমেলার নতুন নাম দেওয়া হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ব্যক্তিগত ভাবে নিজে এই বইমেলায় অংশ নিয়ে দেখেছি নানা মতের, নানা ধরনের বই প্রকাশ পেত এই মেলায়। হত আড্ডা, বিতর্কও। ভিন্নমতকে সম্মান জানানোর একটি সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র হিসেবে ক্রমশ নিজেকে চিহ্নিত করেছিল অমর একুশে বইমেলা। গতকাল যে-ঘটনাটি ঘটেছে অমর একুশে বইমেলায়, তারপর একুশে বইমেলার এই চরিত্রটি অক্ষত থাকবে কিনা, সেই প্রশ্নই উঠে গেছে।
নানা ধরনের ভিডিও এবং মতামত ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে। তাতে একপক্ষ যে-অনভিপ্রেত ঘটনাটি ঘটেছে সব্যসাচীর স্টলে তার দায় চাপিয়ে দিতে চাইছেন সব্যসাচী প্রকাশনার শতাব্দী ভবর ওপরে। তিনি নাকি নানা ধরনের স্লোগান দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছেন। হতে পারে। যে-স্লোগানগুলি নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে কতগুলি ফেসবুক পোস্টে, সেগুলি হল ‘জয় বাংলা’ ও ‘মৌলবাদ নিপাত যাক’। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন যা তাতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তুললে সমস্যা তৈরি হতে পারে এ কথা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ‘মৌলবাদ নিপাত যাক’ও কি একটি আপত্তিকর স্লোগান? জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নায়ক এবং সেনারা কি চাইছেন না বাংলাদেশ থেকে মৌলবাদ নিপাত যাক? তাঁরা কি দেশটাকে মৌলবাদীদের হাতে সঁপে দিতে চাইছেন? সারা পৃথিবী জুড়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভাল বার্তা গেল তো এই ঘটনাটিতে?
বলা হচ্ছে বটে শতাব্দী ভবই এই অনভিব্রত ঘটনাটি পরিকল্পিতভাবে ঘটিয়ে তুলেছেন। ছাত্রদের নাকি তাঁর স্টল থেকে ‘জঙ্গি’ বলা হয়েছে। এই ঘটনা ঘটে থাকলে, অন্যায় হয়েছে। কিন্তু, আসল ঘটনার সূত্রপাত তো অনেক আগে। যা হয়েছে, তা, একদিক থেকে, অনিবার্য ছিল নাকি? আমরা তো সকলেই জানি শেষ কিছু দিন ধরে সব্যসাচী প্রকাশনার স্টলে তসলিমা নাসরিনের 'চুম্বন' গ্রন্থটি রাখা যাবে না এই ফতোয়া জারি করে প্রকাশককে হুমকি দিচ্ছিল বেশ কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি। প্রশ্ন ওঠে, হুমকির কথা জানা সত্ত্বেও প্রশাসন সব্যসাচী প্রকাশনা নিরাপত্তার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল? মব একটি স্টলকে ঘিরে ফেলল কীভাবে? আরও আশ্চর্যের এই যে, ঘটনাটি ঘটার পর হামলাকারীদের কাউকে গ্রেফতার না করে, পুলিশ গ্রেফতার করেছে শতাব্দী ভবকেই।
গতকালের হামলার পর কেউ কেউ তসলিমাকে ‘জঙ্গিও’ বলেছেন। তসলিমা নাসরিনের নানা অবস্থানের সঙ্গে অনেক সময় আমার নিজের অবস্থান মেলে না। কিন্তু তাকে ‘জঙ্গি’ বলা হবে কোন যুক্তিতে? 'চুম্বন' গ্রন্থটির মধ্যে এমন কী আছে যে, বইমেলায় সেই বইটি রাখা যাবে না এই ফতোয়ার কাছে বাংলা একাডেমিকে মাথা নত করতে হল? যে কোনো ধরনের বই নিষিদ্ধকরণের আমি বিরুদ্ধে। কিন্তু তবু যদি কখনও কোনো বইকে রাষ্ট্র কিছু যুক্তি দিয়ে নিষিদ্ধ করে তার একটা মানে হয়। বোঝা যায় যে, রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট ভাবনা থেকে একটি বইয়ের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু, যা জানা গেছে তাতে 'চুম্বন' এখনও সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ নয়। তাহলে আসল ভয় তসলিমাকেই। তসলিমাকে এতখানি ভয় পাওয়ার কারণ কী? তিনি মুক্তচিন্তার কথা বলে চলেছেন বলে এই ভয়? তিনি মৌলবাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত বলে এই ভয়? ঘটনাটির মধ্যে আবার অনেকে দেখলাম ভারতের ষড়যন্ত্র লক্ষ করেছেন। তসলিমাকে দিয়ে কি ভারতীয় রাষ্ট্র বা ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা এই বইটি লিখিয়ে নিয়েছেন যাতে করে বাংলাদেশে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়? এও হয়? হতে পারে?
আরও একটি কথা স্পষ্ট করে বলা ভালো। সব্যসাচী প্রকাশনার স্টলে যা ঘটেছে সেই ঘটনাটিকে আমি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দেখছি না। কারণ খবরে প্রকাশ যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা দাবি তুলেছে রংপুরের ‘বেগম রোকেয়া’ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে মুক্তচিন্তার কথা যাঁরাই বলে গিয়েছেন, তাঁরাই আজ চক্ষুশূল হয়ে পড়ছেন বাংলাদেশের একাংশের মানুষের। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান এই বাংলাদেশই গড়তে চেয়েছিল কি? জানতে ইচ্ছে করে, কাজী নজরুল ইসলামকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা আগামী দিনে কীভাবে গ্রহণ করবেন? মুক্তচিন্তায় তাঁর চেয়ে অগ্রবর্তী ইসলাম ধর্মাবলম্বী কবি-লেখকদের মধ্যে আর কেই বা ছিলেন তাঁর সময়ে? বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসের চিরকালীন সম্পদ অসামান্য কিছু শ্যামাসংগীত রচনা করেছিলেন নজরুল। লিখেছিলেন, “মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’, ‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!” মৌলবীদের স্পষ্ট করে মৌ-লোভী বলেছিলেন যে-নজরুল, সেই নজরুলকে আজকের বাংলাদেশ আগামী দিনে কীভাবে গ্রহণ করে দেখার ইচ্ছে রইল।
বার্টান্ড রাসেল তাঁর অতি বিখ্যাত গ্রন্থ 'ফ্রি থট অ্যান্ড অফিসিয়াল প্রোপাগান্ডা'য় বলেছিলেন যে, চিন্তা তখনই মুক্ত যখন নানা ধরনের ভাবনা একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পাবে, এই ভাবনাগুলির কোনো একটি অন্যগুলির তুলনায় বাড়তি আইনি বা আর্থিক সুবিধা বা অসুবিধা কিছুই পাবে না। এই পরিসরটাই আজকের বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া সচেতন এবং মানবতাবাদী কবি-লেখক-শিল্পীরা যদি মুক্তচিন্তার পরিসর তৈরি করতে এক্ষুনি তাঁদের ভূমিকা পালন না করেন, তাহলে আগামী দিনে বাংলাদেশ একটি বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হবে, বোঝাই যাচ্ছে।