শেষ আপডেট: 1st September 2024 16:36
অমল সরকার
মাস দুই আগে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নানা অবকাশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পা ছোঁয়ার ঘটনা রাজনীতিকে বেশ রসশিক্ত করে তুলেছিল। পাটনার এক সাংবাদিক বন্ধু কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘নীতীশ কুমারকে বিশ্বাস নেই। হতে পারে তিনি আসলে মোদীর ধূতি ধরে টান মারার প্র্যাকটিস করে নিচ্ছেন।’
ইদানীং নরেন্দ্র মোদীকে দেখে মনে হচ্ছে, পাটনার সাংবাদিক বন্ধু ভুল বলেননি, এনডিএ শরিকদের নিয়ে তিনি সত্যিই স্বস্তিতে নেই। শুধু নীতীশ কুমার নন, পাঁচ সাংসদের দল লোক জনশক্তি (রামবিলাস) পার্টির চিরাগ পাসোয়ানকে নিয়েও চিন্তায় আছেন প্রধানমন্ত্রী। চিরাগ বিহারের জনপ্রিয় হরিজন নেতা প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের পুত্র। রামবিলাসের নির্বাচনী কেন্দ্র হাজিপুরে বহু লোককে বলতে শুনেছি, ‘উপর মে আসমান, নিচে পাসোয়ান।’
বাবার নামে দল গড়া চিরাগ নিজেকে ‘মোদী ভক্ত হনুমান’ বলে ঘোষণা করেছেন। রাজনীতির প্রাথমিক পাঠ শেষ না করা সেই চিরাগ কেন্দ্রীয় সরকারে উচ্চপদে ল্যাটেরাল এন্ট্রির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফোঁস করতেই মোদী সরকার সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞপ্তিটি মাত্র পাঁচদিনের মাথায় প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যা নিয়ে প্রথম দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সমাজ মাধ্যমে সরব হয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। বিজ্ঞপ্তিটি নিয়ে আপত্তি তুলেছিল নীতীশের দলও। মোদীর আগের দুটি সরকারে এমন নজির নেই। তৃতীয় ইনিংসে তিনি বেশ সংযত, শরিক এবং বিরোধীদের কথা গ্রহণ এবং নিজের ভুল সিদ্ধান্ত বর্জন, দুইয়েরই কিছু নজির গড়েছেন।
শুধু ল্যাটেরাল এন্ট্রির সিদ্ধান্তই নয়, সাম্প্রতিক অতীতে একাধিক বিষয়ে পিছু হটেছেন নরেন্দ্র মোদী। বাজেটে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স চাপিয়েও বিরোধিতার মুখে সরে আসে তাঁর সরকার। ব্রডকাস্ট সার্ভিসেস (রেগুলেশন) বিলের খসড়া প্রত্যাহার করে নিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। তাতে সরকার বিরোধী মিডিয়ার কণ্ঠরোধের নানা আয়োজনের কথা বলা হয়েছিল।
ওয়াকফ বিল নিয়েও সরকার বীরদর্পে এগনোর চেষ্টা করছে না। বিলটি সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠিয়েছে। তাতে ওয়াকফ সম্পত্তিতে সরকার ও অমুসলিমদের হস্তক্ষেপের সুযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ। এই সরকারই তিন তালাক নিষিদ্ধ ঘোষণার বিলটি সংসদীয় কমিটিতে পাঠাতে অস্বীকার করেছিল। মাত্র পাঁচ বছরেই মুসলিম নারীরা বুঝে গিয়েছেন মোদী তাঁদের কত বড় ধোঁকা দিয়েছেন।
গত সপ্তাহে ওবিসি সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে দুই কংগ্রেস সাংসদ কাস্ট সেন্সাস নিয়ে আলোচনার দাবি জানালে তাতে সায় দেন নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ-র প্রতিনিধি। কমিটির চেয়ারম্যান বিজেপির মধ্যপ্রদেশের সাতনার সাংসদ দাবিটি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন।
মোদীর তৃতীয় সরকারের মেয়াদ এখনও তিনমাস পেরোয়নি। এরমধ্যেই এতগুলি বিষয়ে পিছু হটা দেখে মনে হচ্ছে গোটা মন্ত্রিসভা প্যানিক ডিজওর্ডার বা আতঙ্কের অসুখে ভুগছে। যদিও এইভাবে ফোবিয়া বা ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার মতো কোনও সংকট সরকারের সামনে নেই।
১৯৯৯ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীর জোট সরকাররের সংখ্যাগরিষ্ঠতার (২৭২ আসন) থেকে ৯০টি আসন কম ছিল। সেখানে মোদীর তৃতীয় সরকারে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে মাত্র ৩২টি আসন কম। বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের মোট আসনের (২৩৫) তুলনায় বিজেপির আসন (২৪০) বেশি। তার উপর সদ্য রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ফিরে পেয়েছে এনডিএ।
তারপরও আপত্তির মুখে একাধিক বিল ও সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছু হটেছেন মোদী। শুধু তাই নয়, মাত্র চারটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের অঙ্ক বিবেচনায় রেখে সারা দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের জন্য ইউনিফায়েড পেনশন স্কিমের নামে কার্যত পুরনো পেনশন ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। এরফলে যে পেনশন ব্যবস্থা বিদায় নিচে চলেছে সেই নিউ পেনশন স্কিম চালু করেছিল বাজপেয়ী সরকার।
একটু আগেই উল্লেখ করেছি, সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নে বাজপেয়ীকে অনেক কঠিন পরিস্থিতিতে সরকার চালাতে হয়েছে। জয়ললিতা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো আঞ্চলিক দলের নেত্রীদের দাবিদাওয়া বিবেচনায় রেখে চলতে হত তাঁকে। সবচেয়ে বড় কথা, বিজেপির কোনও এজেন্ডার কথাই বাজপেয়ী, আদবানীরা মুখে আনতে পারতেন না শরিকদের আপত্তির কারণে। তারপরও দুই নেতার চোখ-মুখে দুশ্চিন্তার লেশমাত্র ছিল না।
অন্যদিকে, মোদী এমন সময় জোট সরকার চালাচ্ছেন যখন আদালতের নির্দেশ অযোধ্যার মন্দির-মসজিদ বিবাদের নিষ্পত্তি হয়ে সেখানে রাম মন্দির তৈরি হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় মোদী সরকার সংবিধান থেকে কাশ্মীরের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে দিয়েছে। শরিকরা আপত্তি করেনি। তিন তালাক বিরোধী আইন একপ্রকার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বলবৎ করার শামিল। অর্থাৎ এমন সময় মোদী শরিক নির্ভর জোট সরকার চালাচ্ছেন যখন আরএসএস ও বিজেপির কোর এজেন্ডার প্রায় সবটাই বাস্তবায়িত করে ফেলেছেন তিনি।
তারপরও প্রধানমন্ত্রীকে এত বিচলিত লাগছে কেন? সভা অনুষ্ঠানে তাঁর ভাষণের সেই মেঠো সুর উধাও। একটি কারণ অবশ্যই জোট সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকা। বাজয়েপী, আদবানীরা শুধু জোট সরকার চালিয়েছেন তাই-ই নয়, তাঁদের রাজনীতির সফরটাই ছিল জোটধর্ম মেনে। দু’জনের কারও মুখ্যমন্ত্রিত্ব করার অভিজ্ঞতা ছিল না, যা মোদীর আছে। কিন্তু গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হতে মোদীকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার জন্যও নয়। তারমধ্যে ২০১৯-এ বিজেপি একাই তিনশো আসনে জয়লাভ করায় তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করার মতো দেশটাকেই গুজরাত ভাবতে শুরু করেছিলেন। সব বিষয়ে শেষ কথা হয়ে ওঠার সেই মেজাজ ঝেড়ে ফেলতে এখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করছেন।
কিন্তু মোদীর বিচলিত হওয়ার প্রধান কারণটি ভিন্ন। এতদিনে তিনি আসলে রাহুল গান্ধীকে ভয় পেতে শুরু করেছেন। বিরোধী দলনেতা হিসাবে লোকসভায় রাহুলের প্রথম ভাষণে শিবের ছবি তুলে ধরা এবং হিন্দুত্বের নয়া আখ্যানে প্রমাদ গোনেন মোদী। হিন্দুত্বের অস্ত্রে রাহুলের বিজেপিকে আক্রমণে দিশেহারা প্রধানমন্ত্রী কার্যত দিকভ্রান্ত হয়ে বিরোধী দলনেতাকে অযৌক্তিকভাবে আক্রমণ করে বসেন।
২০১৭-তে কংগ্রেস সভাপতি হয়েই রাহুল নরম হিন্দুত্বের পথে হেঁটেছিলেন। কংগ্রেস নেতার সেই কর্মসূচির অঙ্গ ছিল মন্দির সফর, পূজাপাঠ। সেই রাহুল গান্ধীকে ধ্যানরত নরেন্দ্র মোদী কিংবা অযোধ্যার করসেবকপুরমের সাধুসন্তদের থেকে আলাদা করা যেত না।
রাহুল এবার তাঁর তৃতীয় কৌশল নিয়ে এগচ্ছেন। দ্বিতীয় কৌশলটি ছিল ভারত জোড়ো যাত্রা, যার মাধ্যমে এক ভারতের বার্তা দিয়ে কংগ্রেস নেতা বিজেপির উগ্র জাতিয়তাবাদকে কিছুটা হলেও রুখে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এবার গেরুয়া শিবিরের তথাকথিত হিন্দু ঐক্যের নামে গড়ে তোলা ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসাতে চাইছেন সনিয়া পুত্র।
উচ্চবর্ণের পার্টি বিজেপির বাজপেয়ী-আদবানীদের সময় থেকেই দলিত, জনজাতি, ওবিসিদের দলে হয়ে ওঠার চেষ্টা গোপন থাকেনি। তা না হলে রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে পারত না পদ্ম-শিবির। উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যে বিগত ৩৫ বছরে যোগী আদিত্যনাথ প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসীন। সেই বিজেপির হাত ধরেই দেশে এখন জনজাতি রাষ্ট্রপতি এবং ওবিসি প্রধানমন্ত্রী।
যদিও গত দশ বছরে দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বিজেপির দলিত, আদিবাসী, ওবিসি প্রেম আসলে একটি ছদ্মবেশ। মোদী সরকারের শিল্প-বাণিজ্য নীতি যেভাবে প্রকৃতি ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে আর যাই হোক এই রাজনৈতির শক্তিকে বনবাসী, জনজাতিদের বন্ধু বলা চলে না। কেন্দ্রীয় সরকারের সুবিধাভোগীদের তালিকাতেও স্পষ্ট মোদী-শাহের বিজেপি কর্পোরেট দুনিয়ার বন্ধু।
রাহুল গান্ধী লাগাতার এই বিজেপির খোলস ছাড়ানোর কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছেন। আর তাতেই পরোক্ষে মোদীর শরিকদের সঙ্গে কংগ্রেসের সেতুবন্ধনের কাজটি হচ্ছে। দলিত, পিছডে বর্গের স্বার্থ, কাস্ট সেন্সাসের মতো ইস্যুতে ইন্ডিয়া জোটে একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস বাদে বাকি শরিকেরা কংগ্রেসের পাশে। তার থেকেও বড় বিষয় মোদীর জোট সঙ্গীদের সিংহভাগও এই দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করে।
শরিক ভাঙিয়ে মোদী সরকারকে বিপাকে ফেলার বাসনা কংগ্রেসের বা ইন্ডিয়া জোটের আপাতত নেই। কিন্তু মোদী-শাহ’রা ভয় পাচ্ছেন, যেভাবে জোট শরিকেরা রাহুল গান্ধীর তোলা ইস্যুতে গলা মেলাতে শুরু করেছে তাতে অঘটন ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয়। স্মৃতি ইরানি সম্ভবত এই সব ঘটনাবলী দেখেই বলতে শুরু করেছেন, রাহুল গান্ধীকে ‘পাপ্প’, ‘ছেলেমানুষ’ বলে খাটো করা যাবে না। তিনি তাঁর রাজনীতিতে অবিচল।
এমন সংকটে মোদী-শাহ জুটিকে বিপাকে ফেলেছে তাঁদের বিগত দশ বছরের কৃতকর্ম। বাজপেয়ী-আদবানীদের সময় সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, প্রমোদ মহাজনেরা ছিলেন। শরিকদের মধ্যে ছিলেন জর্জ ফার্নান্ডেজের মতো নেতা বিজেপি যাঁকে এনডিএ-র আহ্বায়ক করেছিল। সংকটে তাঁরা শরিক এবং বিরোধী নেতাদের কথা শুনতেন। মোদী-শাহের বিজেপিতে তেমন কেউ নেই। রাজনাথ সিং, নীতিন গডকড়িরা থাকলেও তাঁদের সেই মর্যাদা এবং দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।