শেষ আপডেট: 10th December 2023 16:49
আগামী ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অযোধ্যায় নতুন রাম মন্দিরের উদ্বোধন করবেন। বিজেপি-সহ গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের একাংশ ওই দিনটিকে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, এমনকী স্বাধীনতা দিবসের থেকেও বেশি মর্যাদাপূর্ণ হিসাবে তুলে ধরতে তৎপর।
একটু তলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হবে, এমন ভাবনা শুধু গেরুয়াবাদীরাই নন, ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের বহু নেতা-নেত্রী-সাধারণজনের মধ্যেও আছে। সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগড়ে কংগ্রেসের প্রচার অন্তত সে কথাই বলে।
শতাব্দী প্রাচীন দলটি প্রচার করে, রাম মন্দির নির্মাণের কৃতিত্ব বিজেপির নয়, হিন্দুত্বের প্রশ্নে কংগ্রেস মোটেই বিজেপির থেকে পিছিয়ে নেই। এই দাবি অনেকাংশে সত্য। সদ্য বিদায় নেওয়া কংগ্রেস সরকারগুলির বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তারা মোটা টাকা মন্দির সংস্কার আর নির্মাণে ব্যয় করেছে।
পাঁচ রাজ্যের ভোটের আগে ‘দ্য ওয়াল’-এ আমি লিখেছিলাম, তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, ছত্তীসগড় এবং মধ্যপ্রদেশে লড়াই হতে যাচ্ছে মূলত বিজেপির হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে কংগ্রেস এবং বিআরএসের মন্দির রাজনীতির অগ্নিপরীক্ষা। সেই কারণে বিধানসভার এই নির্বাচন ছিল অন্য সব ভোটের থেকে আলাদা।
নির্বাচনী ফল বলছে, বিরোধীদের মন্দির রাজনীতি বা নরম হিন্দুত্ব বিজেপির হিন্দুত্বের কর্মসূচির কাছে পরাজিত হয়েছে। কমলনাথ, বাঘেলদের দেখাদেখি রাহুল গান্ধী, প্রিয়ঙ্কা গান্ধীরা যতই কপালে তিলক কেটে, অঙ্গবস্ত্র পরে মন্দিরে মাথা ঠুকুন না কেন, মানুষ মনে করেছে হিন্দুত্বের পেটেন্ট বিজেপির। হিন্দুত্বের প্রশ্নে বাছবিচারে তারা বিজেপি’কেই এখনও এগিয়ে রাখার পক্ষপাতী।
২০১৮-র বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে কংগ্রেস নরম হিন্দুত্বের পথ নিয়ে সফল হয়েছিল বটে, কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছর তাদের সরকারগুলি মন্দির নির্মাণ আর সংস্কার করে যেভাবে হিন্দুর ত্রাতা সাজতে চাইল, তা মানুষ গ্রহণ করেনি। হাত শিবিরের এবারের প্রচার সেই কারণে রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়োর সঙ্গে যাত্রার সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।
সেই যাত্রায় তিনি ঘৃণার বাজারে প্রেমের দোকান খোলার কথা বললেও হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে কংগ্রেস নেতারা কপালে তিলক কেটে মন্দির নির্মাণের সাফল্য কীর্তন করে গিয়েছেন। দীর্ঘ মেয়াদে যা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে, তাই-ই শুধু নয়, কংগ্রেসকে নিয়েও সংশয় দানা বেঁধেছে। কথাটা তৃণমূল কংগ্রেস-সহ বিজেপি ও কংগ্রেস বিরোধী দলগুলির সম্পর্কেও সত্যি।
কংগ্রেস ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিকরা দাবি করে থাকেন, বিজেপির সঙ্গে হাত শিবিরের ফারাক হল, শতাব্দী প্রাচীন দলটি সরকার মন্দির নির্মাণ, সংস্কার করলেও বিজেপির মতো মসজিদ ভাঙছে না বা চার্চে আগুন দিচ্ছে না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কংগ্রেসের এই নরম হিন্দুত্ব বা মন্দির রাজনীতি আসলে বিজেপি তথা গেরুয়াবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ। বরং কংগ্রেস ধারাবাহিকভাবে বিজেপির রাজনীতির বিরোধিতায় সৎ থাকলে দেশবাসীর বড় অংশ তাদের পাশে এসে দাঁড়াত। সেই পথে না হেঁটে তাঁরা একদিকে মানুষকে বোঝাচ্ছেন হিন্দুত্বের প্রশ্নে বিজেপির প্রথম প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে বর্তমানের আসমান-জমিন ফারাক, অন্যদিকে, তারাই ক্রমশ গায়ে গেরুয়া বস্ত্র চড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
২০১৮-তে ছত্তীসগড়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশে বাজিমাৎ করেছিল কংগ্রেস। রাহুলের সেই রাজনৈতিক প্যাকেজের নাম ছিল নরম হিন্দুত্ব। সেবার তিনি যত না সভা করেন, প্রচারে গিয়ে মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়েছেন বেশি। কংগ্রেসের পোস্টার, ব্যানার, হোর্ডিং জুড়ে ছিল পুজারি রাহুলের ছবি।
তারপর নর্মদা, মহানদী, চম্বল, কৃষ্ণা, গোদাবরী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। এক বছরের মাথায় কংগ্রেসের বিধায়ক ভাঙিয়ে মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় ফেরে বিজেপি। সেই থেকে দিন যত গড়িয়েছে, শুধু মধ্যপ্রদেশ নয়, বাকি তিন রাজ্যেও বিজেপির মন্দির রাজনীতিই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কংগ্রেসের হাত ধরে। তেলেঙ্গানায় সেই রাজনীতির কারিগর ছিলেন কে চন্দ্রশেখর রাও।
নরম হিন্দুত্বের প্রধান কর্মসূচি এখন মন্দির নির্মাণ ও সংস্কার। যেমন মোদীর হাত ধরে বদলে গিয়েছে কাশী বিশ্বনাথ-কেদারনাথ-বদ্রিনাথ-মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নীর মহাকাল মন্দির কমপ্লেক্স-গুজরাতের কালিমাতা মন্দিরের মতো প্রাচীন হিন্দু তীর্থ ক্ষেত্রের। দুর্গম পাহাড় কিংবা গভীর জঙ্গলে অনাদরে পড়ে থাকা মন্দিরকে তীর্থক্ষেত্র হিসাবে গড়ে দিয়েছেন।
বলাই বাহুল্য, তাতে মসজিদ, গির্জার স্থান হয়নি। এই কর্মসূচির জন্য বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক দল বলা হলে কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ বলা যেতে পারে, আমার তা বোধগম্য নয়। বিজেপি একক শক্তিতে ১২টি রাজ্যে ক্ষমতায়। বিরোধী দল শাসিত বাকি ১৬টি রাজ্যের কাজকর্মের চুলচেরা বিচার করলে দেখা যাবে তাদের কর্মধারার সঙ্গে গেরুয়াবাদী শিবিরের মৌলিক ফারাক কম। উল্টে মন্দির তৈরি ও সংস্কারে সহমত তৈরি হয়েছে বিজেপি ও বিজেপি বিরোধী সরকারগুলির মধ্যে।
প্রশ্ন হল, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সরকারি টাকায় উপাসনাস্থল নির্মাণ, সংস্কার কতটা গ্রহণযোগ্য। ছত্তীসগড়, রাজস্থানের কংগ্রেস এবং তেলেঙ্গানার বিআরএস সরকার বাজেটেরও মোটা অঙ্ক ব্যয় করেছে রাজ্যের নানা প্রাচীন মন্দির সংস্কারের কাজে। এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, দিল্লি, পাঞ্জাব— কোন রাজ্য নেই!
এর ফলে ছত্তীসগড়, রাজস্থানে আদিবাসীরা কংগ্রেসের থেকে সরে গিয়েছে। বিকল্পের সন্ধানে তারা বিজেপির রাজনীতির ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হয়েছে। দলটি আদিবাসীদের হিন্দু সমাজের অংশ বলে দেখাতে তৎপর। অন্যদিকে, আদিবাসীদের মত, তারা দেবদেবী নয়, সনাতন ধর্ম তথা প্রকৃতির পূজারি।
রাজস্থানে অশোক গেহলট সরকার পুষ্করের জগৎপিতা ব্রহ্মা মন্দিরের রূপ বদলের কাজে হাত দিয়েছিল। অযোধ্যায় নির্মীয়মাণ রাম মন্দির কমপ্লেক্সের আদলে গড়ে তোলা হচ্ছে মরুরাজ্যের মন্দিরটি।
মধ্যপ্রদেশে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি কমলনাথ দলকে দিয়ে নবরাত্রি পালন, রাম নবমীর মিছিল করিয়েছেন। কপালে তিলক কেটে অঙ্গবস্ত্র পরে মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম ঠুকছেন।
মন্দির রাজনীতিতে পিছিয়ে ছিল না তেলেঙ্গানার বিআরএস সরকারও। মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও রাজ্যের একাধিক মন্দিরকে গুজরাতের সোমনাথ মন্দিরে আদলে গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছিলেন কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে। কিন্তু মোদী ও তাঁর গেরুয়া বাহিনীর আগ্রাসী হিন্দুত্বের কাছে হার মেনেছে বিরোধীদের মন্দির রাজনীতি।
কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা যে যুক্তিতে অর্থাৎ মসজিদ, গির্জা না ভেঙে মন্দির নির্মাণের কর্মসূচিকে নরম হিন্দুত্বের পথ বলছেন, সেই যুক্তিতে বিজেপিও একই কথা দাবি করতে পারে। ভোটের স্বার্থেই মোদী সরকার এবং বিজেপি পছমন্দা বা আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মুসলিমদের কাছে টানার কাজ শুরু করেছে। এই কর্মসূচির জন্য বিজেপিকে কি ধর্মনিরপেক্ষ দল বলা যাবে?
হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্য পরাজয়ের পর রাহুল গান্ধী এক্স হ্যান্ডেলে বলেছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে নীতির লড়াই চলবে। বাস্তবে আমরা কি সেই লড়াই দেখতে পাচ্ছি? রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রার দ্বিতীয় পর্বের কী হল? নরেন্দ্র মোদীর মতো নেতার মোকাবিলায় কংগ্রেসের কৌশল এবং উদ্যম, দুইয়েরই অভাব।
১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বিগত তিন দশকে ভারতের রাজনীতির ডিএনএ বদলে গিয়েছে। বাবরি ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সংবিধানের মূল ভাবনা এবং স্তম্ভটিকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে।
বলতে গেলে সেদিন থেকেই হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ার পথে যাত্রা শুরু এ দেশের। তিন দশক পর, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের ফারাক এখন সংবিধানের ঘোষণাপত্রে। বাস্তবে ওরা ঘোষিতভাবেই ইসলামিক রিপাবলিক, আমরা অঘোষিত হিন্দু রিপাবলিক।
এর কৃতিত্ব বা দায় কোনওটাই পুরোপুরি বিজেপির নয়। আসলে বেশিরভাগ দলই বিজেপি বিরোধিতায় গেরুয়া রাজনীতির সংস্কৃতিকেই আঁকড়ে ধরছে। ফলে নরেন্দ্র মোদীর দল আজ ১২টি রাজ্যে ক্ষমতাসীন হলেও তাদের রাজনীতির বিস্তার ঘটেছে অনেক বেশি। ভোটের বাক্সে বিজেপির সাফল্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাবকে মাপা যাবে না।
২০২৫-এ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের শতবর্ষ। তার আগে ভারত সরকারিভাবে হিন্দু রাষ্ট্র হবে কিনা তা নির্ভর করবে ২০২৪-এ নরেন্দ্র মোদীর ভাগ্যে কী লেখা আছে তার উপর। ‘বাবরি ধ্বংসের তিন দশক এবং ষড়যন্ত্র ও সুবিধাবাদের আখ্যান’ বইয়ে আমি বিস্তর নথিপত্র দিয়ে দেখিয়েছি, আরএসএস স্বাধীনতা পরবর্তী সব সরকারের সঙ্গেই সু-সম্পর্ক রেখে কাজ করার চেষ্টা করেছে। একমাত্র জওহরলাল নেহরু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীরা বাদে আর কোনও প্রধানমন্ত্রী এই সংগঠনের কাজকর্মে বড় কোনও বাধা হননি। এমনকী ইন্দিরা গান্ধীও নন, যিনি এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। লক্ষণীয়, সঙ্ঘ পরিবার সেই ইন্দিরার প্রধানমন্ত্রিত্বকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়ে রেখেছে। আরএসএসের মতোই দেশে আজ বিজেপি বিরোধীদের একাংশ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চায়। রাজনৈতিক কারণে কাজটা তাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাঁরা চান মোদীর হাত ধরে বাকি কাজটা সারা হয়ে যাক।
তাদের কাছে উদাহরণ বাংলাদেশ। শেখ মুজিবুরের হাত ধরে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম এখন ইসলাম। নয়া সংবিধান শুরুই হচ্ছে ‘বিস্মিল্লাহির-রহ্মানির রহিম বা দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে/ পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’ শপথ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। এই বদলের নায়ক সেনা প্রশাসক হুসেইন মহম্মদ এরশাদ। তারপর একাধিক নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হলেও সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত ঘোষণার বদল ঘটেনি। হিন্দুত্ববাদীদের বিভাজন রাজনীতির মোকাবিলার পরিবর্তে তাদের প্রতি আত্মসমর্পণ দেখে আমার মনে হয় এ দেশেও তেমনটি হওয়া অসম্ভব নয়।