শেষ আপডেট: 16th February 2025 17:45
অমল সরকার
বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার অন্যতম কারিগর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের রাজনৈতিক দলের নাম, নীতি-আদর্শ ইত্যাদি চলতি মাসেই ঘোষণা হওয়ার কথা। এই বিষয়ে ঢাকার এক প্রথমসারির সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, যিনি ছাত্রদের হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের তুমুল সমর্থক ছিলেন। ছাত্রদের দল ঘোষণা নিয়ে তাঁর গলায় হঠাৎ হতাশার সুর। বললেন, ‘ওরা আম আদমি পার্টিকে অনুসরণ করে এগতে চাইছে।’ আমি বললাম, তাতে সমস্যা কোথায়? তিনি বললেন, ‘আপ ভণ্ডদের দল। কেজরিওয়ালের মুখে দুর্নীতির বিরোধিতা, সুশাসনের প্রতিশ্রুতি ছিল স্রেফ ভাঁওতাবাজি। দিল্লির মানুষ অবশেষে আপকে উচিত জবাব দিয়েছে।’
বাংলাদেশে জন্ম নিতে যাওয়া দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে মন্তব্য করার সময় আসেনি। কিন্তু ঢাকার সাংবাদিক বন্ধুর কথায় স্পষ্ট আপকে তাঁরা কী চোখে দেখেন। তাঁর কথা আমার পছন্দ হল, কারণ ইতিপূর্বে অনেকবার আপ সম্পর্কে এসব কথা লিখেছি, টেলিভিশনের আলোচনায় বলেছি। যে কারণে আপের প্রশ্নে ঘনিষ্ঠবৃত্তে আমি ছিলাম সংখ্যালঘু। বাকিরা মনে করতেন, আম আদমি পার্টির সরকার উপকৃতদের যে ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করেছে তারাই আপকে ভোট বৈতরণী পার করে দেবে। বস্তুত সেটাই গত দশ-বারো বছর হয়ে এসেছে। কিন্তু এবার সে সম্ভাবনা কম, তা বোঝা গিয়েছিল, আবগারি কেলেঙ্কারির পরিণতি থেকে।
বাংলাদেশে ছাত্রদের জন্ম নিতে চলা দলটির সঙ্গে আম আদমি পার্টির একটি বিষয়ে অদ্ভুত মিল আছে। ২০১০-’১১ সালে দিল্লিতে আপের উত্থানের পিছনে ছিল আরএসএসের হাত। তারা রাজধানীর ক্ষমতা থেকে কংগ্রেসকে সরাতে চেয়েছিল। কিন্তু বিজেপিকে দিয়ে সেটা তখন সম্ভব হবে না বুঝেই নতুন একটি রাজনৈতিক শক্তির তারা জন্ম দেয়। হাতিয়ার করে কেন্দ্র ও দিল্লি প্রদেশের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির অভিযোগগুলিকে।
বফর্স কামান কেলেঙ্কারির পর জাতীয় রাজনীতিতে দুর্নীতির ইস্যুতে আর নির্বাচন হয়নি যেমনটা হয়েছিল ১৯৮৯-এর লোকসভা ভোটে। সেবার ক্ষমতা হারান রাজীব গান্ধী। ২০১৩-র দিল্লি বিধানসভা ভোটের মতোও আর কোনও রাজ্যে দুর্নীতির একক ইস্যুতে ভোট হয়নি। দুই ক্ষেত্রেই একেবারে তৃণমূল স্তরে দুনীতির বিরুদ্ধে প্রচারের কারিগর ছিল আরএসএস।
বফর্স কামান কেলেঙ্কারিতে রাজীব গান্ধীর যুক্ত থাকার অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। যদিও বিরোধীরা বাজিমাত করেছিল একটি স্লোগানকে হাতিয়ার করে, ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়।’ আম আদমি পার্টি এবং বিজেপির কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার ও দিল্লির কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে তোলা দুর্নীতির বেশিরভাগ অভিযোগও কিন্তু পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়নি।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে হটাতে ছাত্রদের সামনে রেখে গণ অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। পাকা মাথা না থাকলে আনকোরা ছাত্রদের পক্ষে সরকার উৎখাতের এমন আন্দোলন দাঁড় করানো কঠিন ছিল। বিশেষ করে বিএনপি-র মতো দল যখন দেশব্যাপী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল তখন কোনও যাদুমন্ত্রেই ছাত্রদের এমন সফল বিপ্লব সম্ভব ছিল না, যদি না পিছনে পাকা মাথা থাকত। ছাত্রদের দল আত্মপ্রকাশের পর অন্তরালের শক্তির চরিত্র স্পষ্ট হবে।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল গঠন এবং ক্ষমতা দখলের পিছনে অন্তরালের শক্তি আরএসএস-ই এবার তাদের খেদাতে রাস্তায় নেমেছিল। মদ কেলেঙ্কারির বিষয়টি জানাজানি হতেই সঙ্ঘের লোকজন প্রচারে নেমে পড়ে যাতে বিজেপির প্রত্যাবর্তন সহজ হয়। হলও তাই। ফলে আরএসএসের আসল উদ্দেশ্য সাধিত হল। দিল্লিতে বিজেপির বিপুল জয় শততম বর্ষে আরএসএসের জন্য বিরাট প্রাপ্তি সন্দেহ নেই। কংগ্রেসকে তারা আগেই নির্মূল করে দিতে পেরেছে। এবার আপকেও খতম করল।
কাজটা সহজ করে দিয়েছিলেন অরবিন্দ কেজিরিওয়াল স্বয়ং যিনি দেড় দশক আগে উপমহাদেশের রাজনীতিতে দুর্নীতি বিরোধিতার ‘পোস্টার বয়’ হয়ে উঠেছিলেন।
কেজরিওয়াল এবং আপের পরিণতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে একটু ওডিশা প্রসঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া যাক। গত বছর নবীন পট্টনায়েয়েকের একচ্ছত্র শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে বিজেপি। অনেকেই মনে করেন নবীনের অসুস্থতা এর কারণ। কারণটা মোটেই তা নয়। সমস্যা হল, পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়া বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম নিয়ে যতটা আগ্রহী, ওড়িশা নিয়ে ততটা নয়। অথচ, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের মতোই ওডিশায় বিজু জনতা দলের সরকারও একদিকে সুবিধা বিলিয়ে টিকে ছিল, অন্যদিকে, দুর্নীতির গুচ্ছ অভিযোগ ঘিরে ক্ষোভ বাড়ছিল রাজ্যবাসীর। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই নবীনের বিরুদ্ধেও ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ ছিল না। কিন্তু তাঁর দলের সর্বস্তরের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনাচারের অভিযোগ একটু একটু করে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল গত বছর বিধানসভার ভোটে। টানা ক্ষমতায় থাকার রেকর্ডটি স্পর্শ করার মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন নবীন।
আম আদমি পার্টিকে নিয়ে তুলনায় অনেক বেশি অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল জনমনে। কেজরিওয়ালের মুখ থেকে দুর্নীতি বিরোধিতার মুখোসটি খসে পড়েছিল আপ ক্ষমতা দখলের পর পরই। একদা সঙ্গীদের অনেকেই যে কারণে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারেননি। দূরে সরে গিয়ে সমর্থন প্রতাহার করে নিয়েছিলেন অন্না হাজারেও। তারপরও আম আদমির সমর্থন ধরে রাখতে পেরেছিল আপ। তার কারণ, মূল ধারার রাজনীতির বাইরে ক্ষমতার এই নয়া স্রোতধারাকে বয়ে নিয়ে যেতে পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল নব্য সুবিধাবাদীরা।
আমি একাধিক লেখায় লিখেছি, আপ হল বিজেপির বি-টিম। বিজেপির হিন্দত্ব তাদের আরাধ্য। ফারাক শুধু তারা গেরুয়া শিবিরের মতো কথায় কথায় মুসলমানদের প্রতি খড়্গহস্ত নয়। আবার সংখ্যালঘুদের বিপন্নতায় পাশে দাঁড়ায় না। দিল্লির দাঙ্গার সময় রাজধানীর শাসক দল হাত গুটিয়ে ছিল। কৃষক আন্দোনের প্রতিও আপের সহমর্মী হওয়ার তেমন নজির নেই। যদিও কেজরিওয়ালের হিতোপদেশ থেমে থাকেনি।
আবগারি কেলেঙ্কারি সামনে আসতে আস্তে আস্তে তাঁর মুখোসটি খুলে পড়তে শুরু করে। মদ কেলেঙ্কারির অভিযোগটি ছিল কংগ্রেসের। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহেরা সিবিআই-ইডিকে নামিয়ে দিয়ে আপকে বধ করতে কালক্ষেপ করেনি।
আর পাঁচটা সরকারের তুলনায় আপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগটি ছিল পৃথক চরিত্রের। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট মদ কেলেঙ্কারি নিয়ে আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে। ভারতে কোনও শাসক দলকে নিয়ে এমন নজির নেই। কেজরিওয়ালের ভণ্ডামির আরও এক নজির সরকারি টাকায় তাঁর সরকারি বাংলো সারাই। বেশ মনে আছে বছর কয়েক আগে বাড়ি সারাইয়ের খবর জানাজানি হতে কেজকিওয়াল মিডিয়ার কাছে গল্প ফেঁদেছিলেন, বর্ষার সময় বাড়ির ফুটো ছাদ দিয়ে জল পড়ে। ছাদের একাংশ খসে পড়েছে, ইত্যাদি।
সর্বদা অর্ডিনারি হাওয়াই শার্ট, ট্রাইজার, চপ্পল পরা মানুষটি কেমন ভোগ বিলাসী সংস্কার হওয়ার বাংলোটির চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। ফলে বার্তা স্পষ্ট, জুতো, পোশাককে সততার জার্সি করে নেওয়া নেতা-নেত্রীদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।
কেজরিওয়ালকে বিজেপির বিশেষভাবে টার্গেট করার আরও একটি কারণ হল আর কোনও হিন্দুত্ববাদী দল মাথা তুলুক পদ্ম শিবির তা চায়নি। আপকে নিকেশ করা তাই বিজেপির অন্যতম লক্ষ্য ছিল। স্বভাবতই কেজরিওয়াল বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হবেন এটাই ছিল স্বতঃসিদ্ধ। গেরুয়া বিরোদিতা কোনও আদর্শগত অবস্থান ছিল না।
লক্ষণীয় হল, পদ্ম বিরোধিতার ঝাণ্ডা তুলে ধরে দেদার দুর্নীতি, অনাচার করে গিয়েছে আপ। তারা মনে করেছিল, সুবিধাভোগী মানুষ বছরের পর বছর তাদের পাশে থাকবে। কে না জানে, দিল্লিতে সুবিধাভোগী সম্প্রদায় তৈরি সহজ। কারণ, সেখানকার সিংহভাগ মানুষ বহিরাগত। তারা মূলত সুদিনের আশায় নিজের রাজ্য ছেড়ে রাজধানীর স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। নীতি-নৈতিকতা তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম। রাজনৈতিক মতাদর্শবিহীন এই সুবিধাভোগী সম্প্রদায় সুযোগ বুঝে শিবির বদল করবে, এটাও স্বতঃসিদ্ধ ছিল।
প্রশ্ন হল, বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের কি আপের পরিণতি হতে পারে? বিশেষ করে তৃণমূল সরকারও যখন মূলত সুবিধা বিলিয়ে টিকে আছে এবং তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। আপের মতোই তৃণমূলও বিজেপি বিরোধিতার ঝাণ্ডা ধরে একের পর এক নির্বাচনে টিকে গিয়েছে। বাংলায় তিরিশ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট তাদের বড় ভরসা। যেমন দিল্লিতে দীর্ঘদিন কংগ্রেসের সঙ্গে থাকা সংখ্যালঘুরা বিজেপিকে ঠেকাতে আপকে ভোট দিত।
তারপরও ক্ষমতাচ্যুত আপ সরকারের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কিছু মৌলিক ফারাক আছে। এক. এখানে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির গ্রহণযোগ্য অভিযোগ নেই। দুই. তৃণমূল দল ও প্রশাসনের একাংশের বিরুদ্ধে চুরি-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও জোড়াফুল এখনও জনবিচ্ছিন্ন দল নয়। কার্যকর, শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকাতে তৃণমূলের দুর্নীতিও সেই কারণে নীচুতলায় পৌঁছে গিয়েছে। তিন. বাম-কংগ্রেস তো নয়ই, বিজেপিও এখনও পর্যন্ত তৃণমূলের বিকল্প হিসাবে জনমনে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
তবে এসবই ঘটমান বর্তমান। তা থেকে ভবিষ্যৎবাণী করা মুশকিল। তাছাড়া, দিল্লির ভোটের ফলে স্পষ্ট, শুধু সুবিধা বিলিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন। বিজেপির বিরোধিতার ঝাণ্ডা ধরে দুর্নীতির পাঁকে ডুব দিলে আপের মতো পরিণতি হতেই পারে।