শেষ আপডেট: 26th October 2024 16:05
বিশ্বকর্মা পুজো থেকেই শুরু হয়ে যায় বাঙালির বর্ণময় নানান সামাজিক উৎসবের মরশুম। এসময় অতিমাত্রায় লাউডস্পিকার ব্যবহার, বাজি পোড়ানো, দীর্ঘসময় ধরে একই জায়গায় উপচে-পড়া ভিড়, যানজট, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ও জলের ব্যবহার, বেশি পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি ইত্যাদি এক গভীর স্থানীয় পরিবেশ সমস্যা সৃষ্টি করে। কালীপুজো, দীপাবলি ও ছটপুজোয় বেলাগাম বাজি পোড়ে। দুর্গাঠাকুরের ভাসানের দিন থেকে এর মহড়া শুরু হয়ে যায়। এবছর মহালয়ার দিন ভোরবেলাতেই বেশ কিছু মফঃস্বলে বাজির শব্দ শুনতে পাওয়া গেছে। শব্দবাজি ও আতসবাজি সাধারণত এই দুরকমের বাজি পোড়ানো হয়। বাজি পুড়ে ভয়ানক বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ হয়।
বাজি-দূষণে শারীরিক ক্ষতি
বাজির ধোঁয়া ও ধোঁয়াশায় ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের সমস্যা হয়। ধোঁয়ায় মিশে থাকা অপেক্ষাকৃত বড় আকারের ধূলিকণাগুলি স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধা দেয়। চোখ, গলা ও মুখের মিউকাস পর্দায় এরা আটকে যায়। ফলে জ্বলুনি হয়। অনেক সময় মিউকাস পর্দা চিরেও যায়। ছোট কণাগুলি সরাসরি ফুসফুসে যায়। ফলে গলা-চোখ জ্বালা, কাশি, হাঁপানি বাড়ে। ফুসফুস থেকে রক্তের মাধ্যমে ছোট কণাগুলি মস্তিষ্কে পৌঁছায়। এতে বড় ক্ষতির ভয় থাকে। শব্দবাজির প্রাবল্যে মানুষ সহ পশুপাখির অস্বস্তি বাড়ে। অতি জোরালো শব্দে রক্তে শ্বেতকণিকার পরিমাণ বাড়ে। শর্করার মাত্রা বদলে যায় ও ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যায়। চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। আতসবাজির তীব্র আলোয় চোখ খারাপ হয়। স্নায়ুরোগ দেখা দেয়। শব্দবাজির উচ্চশব্দে গর্ভপাতও ঘটে। সদ্যোজাত শিশুর অঙ্গবিকৃতি ঘটতে পারে। সর্বোপরি ৯০ ডেসিবেলের বেশি শব্দে দীর্ঘক্ষণ কাটালে সাময়িক বা চিরকালীন বধিরতা দেখা দিতে পারে।
আইনি বেড়াজাল ও প্রায়োগিক শিথিলতা
২০১৮ সালে ভারতের মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত সুনির্দিষ্টভাবে বলেছিল যে, দীপাবলিতে রাত ৮টা থেকে ১০টা এই দুই ঘণ্টা বাজি পোড়ানো যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, শব্দবাজি সহ অন্যান্য বাজি সন্ধ্যা ৬টা থেকেই পুড়তে শুরু করে। সর্বোচ্চ আদালত আরও বলেছিল, বাজি পোড়ানোর এক নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করতে হবে। কিন্তু ২০১৮ থেকে এখনও অব্দি পশ্চিমবঙ্গে কোন নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক হয়নি যেখানে মানুষ বাজি পোড়াতে পারে। ফলে যেখানে-সেখানে বাজি পোড়ানোয় বায়ুদূষণ ঘটছে, শব্দযন্ত্রণা বাড়ছে।
মহামান্য জাতীয় পরিবেশ আদালত কেবল বৈধ কিউআর কোড সহ সবুজ-বাজি পোড়ানোর ছাড়পত্র দিয়েছেন। কিন্তু সর্বত্র যেসব বাজি বিক্রি হয়, তার বেশিরভাগই সবুজ-বাজি নয়। অথচ পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব বাজি দেদার বিকোয়। মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সবুজ-বাজিতে ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর শংসাপত্র থাকতে হবে। কী কী রাসায়নিক যৌগ দিয়ে এটি বানানো, তার উল্লেখ থাকবে। নিষিদ্ধ রাসায়নিক বেরিয়াম ব্যবহৃত হয়েছে কিনা তা-ও জানাতে হবে। কিন্তু বাজারচলতি বেশিরভাগ সবুজ-বাজিতে এসবের দেখা মেলা ভার।
বাজি মজুত রাখার ব্যাপারেও বেশ কিছু সরকারি বিধিনিষেধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বাড়িতে কোনওভাবেই বাজি মজুত রাখা যাবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মাননীয় কলকাতা উচ্চ আদালতের শব্দদূষণ রোধে এক নির্দেশের প্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এক নির্দেশিকা জারি করে যে, বাজি ফাটানোর জায়গা থেকে পাঁচ মিটার দূরত্বে শব্দসীমা কখনোই ৯০ ডেসিবেল ছাড়াবে না। কিন্তু কী এক অজানা কারণে মানুষের নৈঃশব্দের অধিকার কেড়ে নিয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের গত বছরের ১৭ অক্টোবরের এক নির্দেশিকায় এই নিয়মটিকে শিথিল করে শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল করা হল, তার কোন সন্তোষজনক বিজ্ঞানসম্মত উত্তর রাজ্যবাসীর এখনও জানা নেই। উল্লেখ্য, ১২০ ডেসিবেলই হল অনুভূতিসম্পন্ন সহনশীল শব্দের শেষ ধাপ। এর পরেই শব্দের পীড়াদায়ক স্তর শুরু। এতে ধনী এলাকাগুলিতে এক উচ্চণ্ড শব্দ-দামামা সৃষ্টি হল। অর্থবান মানুষ নিষিদ্ধ বাজি পুড়িয়ে প্রমাণ করল তারা মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ মানে না। প্রশাসন চলে তাদের অঙ্গুলিহেলনে। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু গরিব মানুষের দামি এসব বাজি কেনার আর্থিক সামর্থ্য নেই। তাই তাদের দীপাবলির আনন্দও ফিকে। সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! একদিকে চলে আইন ভাঙা। অন্যদিকে দারিদ্রে ডুবে থাকে এক বিশাল অংশের মানুষ।
এখানে বলা জরুরি, কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক শিল্পসংস্থাগুলিকে তাদের ‘দূষণ সূচক’-এর (পিআই) মান অনুযায়ী চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। যেমন- ‘লাল শ্রেণি’ (পিআই মান ৬০-এর বেশি), ‘কমলা শ্রেণি’ (পিআই মান ৪১-৫৯), ‘সবুজ শ্রেণি’ (পিআই মান ২১-৪০) ও ‘সাদা শ্রেণি’ (পিআই মান ২০-এর কম)। চরম আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কোনরকম পিআই মানের উল্লেখ ছাড়াই সবুজ বাজিকে সাদা শ্রেণিভুক্ত করেছে। বাজির মতো মারাত্মক দূষণ-সৃষ্টিকারী এক শিল্পকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কেন এবং কীভাবে লাল শ্রেণি থেকে একেবারে কম-দূষণকারী সাদা শ্রেণিতে সরালো, তা বিস্ময়কর। উল্লেখ্য, ২০০৯ সাল থেকে রাজ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে প্রায় একশো মানুষের প্রাণ গেছে।
‘ন্যাশনাল অ্যামবিয়েন্ট এয়ার কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড’ অনুযায়ী বাতাসে ২.৫-১০ মাইক্রোগ্রাম আকারের ধূলিকণার সহনীয় মান ১০০ মাইক্রোগ্রাম/ঘন মিটার, ২.৫ মাইক্রোগ্রাম আকারের কম ধূলিকণার সহনীয় মান ৩০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার, সালফার ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইড-এর সহনীয় মান ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার। কিন্তু কালীপুজো, দীপাবলি ও ছটপুজোয় পশ্চিমবঙ্গের কোন শহরাঞ্চলেই উক্ত সহনীয় মাত্রাটি যে বজায় থাকে না, তা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইট দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
নিষিদ্ধ বাজির ব্যবস্থাপনা
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পুলিশ-প্রশাসন থেকে যে সব বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ বাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়, সেগুলির যথাযথ ব্যবস্থাপনা। আমরা এখনও ভুলে যাইনি, কয়েক বছর আগে উত্তর ২৪-পরগনার নৈহাটি অঞ্চলে বাজেয়াপ্ত বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ বাজি পুলিশ-প্রশাসন থেকে গঙ্গাতীরে আগুন লাগিয়ে নষ্ট করার সময় ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটে। এতে স্থানীয় অঞ্চলে বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল ধরে, এমনকি গঙ্গার বিপরীত পাড়ে চুঁচুড়া শহরের বেশ কিছু বাড়িতেও ফাটল ধরেছিল। তাই বেআইনি বাজি নষ্ট করার সময়েও যথাযথ সতর্কতার প্রয়োজন। উপরন্তু, খোলা আকাশের নিচে এভাবে আগুন দিয়ে নিষিদ্ধ বাজি নষ্ট করার সময়েও ভয়ানক বায়ুদূষণ ঘটে।
শব্দশহিদ বাড়ছে, হুঁশ ফিরছে কই
রাজ্যে কোথায় সবুজ-বাজির কারখানা আছে, বা এটি কীরকম দেখতে, তা সবার কাছে স্পষ্ট নয়। এক তথ্যসূত্রে (০৩.০৯.২৩) জানা গেছে, আমাদের রাজ্যে মাত্র ৭টি সবুজ-বাজি তৈরির কারখানা আছে। বিপরীতে বেআইনি বাজি কারখানা আছে ৫৫৫৬টি। এই কয়টি মাত্র সবুজ-বাজি কারখানা থেকে রাজ্যের বিপুল পরিমাণ বাজির চাহিদা কীভাবে মিটবে, তা নিয়ে প্রশাসন ও বাজি-বিক্রেতারা ফাঁপড়ে। চাহিদার জোগান দিতে সেক্ষেত্রে আড়ালে নিষিদ্ধ-বাজি বিক্রি হবে নাতো? গত বছরে আমাদের অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, বাজারে সবুজ-বাজির প্যাকেটের কিউআর কোড অ্যান্ড্রয়েড ফোনে স্ক্যান করলেও কোনও ধরনের শংসাপত্র বা এগুলি কী দিয়ে বানানো, তার কোনও তথ্যই পাওয়া যায়নি। এবারেও একই ঘটনা ঘটবে না তো?
তাই আগামী কালীপুজো, দীপাবলি ও ছটপুজোয় কীভাবে নিষিদ্ধ শব্দবাজি মানুষের হাতে আসা বন্ধ করা যাবে, সেটাই এখন বিভিন্ন পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ও প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে এক চরম অগ্নিপরীক্ষা। আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, বাজি পোড়ানোর পর যে বর্জ্যের সৃষ্টি হয়, তা-ও বিপজ্জনক। বাজি তৈরি থেকে পুড়ে বর্জ্য হওয়া পর্যন্ত পুরো পর্বটাই বিপজ্জনক ও দূষণ-সৃষ্টিকারী। তাই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমস্ত মানুষের কাছে আবেদন, যেকোনও ধরনের বাজি পোড়ানো থেকে দূরে থাকুন। দীপাবলি আলোর উৎসব। শব্দ ও দূষণের নয়। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, একজনের আনন্দ যেন কখনোই অন্যের দুঃখের কারণ না হয়।
শব্দবাজির দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে পশ্চিমবঙ্গে ১৪ জন মানুষ শব্দশহিদ হয়েছেন। ২০০০ সালে ভারতের মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরা শব্দবাজির বিরুদ্ধে এক রায় দিতে গিয়ে এক ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। তাঁরা জানিয়েছিলেন, খোদ দিল্লি-র বুকেই যখন এক নারী ধর্ষিতা হচ্ছিলেন, তখন সেখানে এমন উচ্চণ্ড শব্দে শব্দবাজি ফাটছিল যে, ধর্ষিতার চিৎকার সেই আওয়াজে চাপা পড়ে গেছিল।
৯ অগাস্ট, ২০২৪, অভিশপ্ত রাতে আরজি কর হাসপাতালে কর্মরতা একজন তরুণী চিকিৎসকের নারকীয় মৃত্যু হল। কোনও শব্দবন্ধই এই বীভৎসা বর্ণনা করতে অনুপযুক্ত। এই মৃত্যুর বিচার চেয়ে ১০ তারিখ থেকেই সমাজের সর্বস্তরের মানুষ পথে নামল। নেই কোন দলীয় ঝান্ডা। যেসব মা-বোনেরা জীবনে কখনও রাস্তার মিছিলে যোগ দেননি, তাঁরাও এসে মোমবাতি হাতে রাস্তায় দাঁড়ালেন। রাত দখল করলেন। একটাই দাবি। আশেপাশে ঘটে চলা অসংখ্য দুর্নীতি, অপরাধ, শ্লীলতাহানি -- সবকিছুর শেষ চাই। চাই সুবিচার। অত্যন্ত ন্যায্য নাগরিক দাবি। কিন্তু উল্টোদিকে, যাঁরা শব্দবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, মানুষের নৈঃশব্দের অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের সুবিচার চেয়ে রাস্তায় আমরা ক’জন নেমেছি! তাঁদের মৃত্যু অন্ধকারেই চাপা পড়ে গেছে। এই শব্দশহিদদের জন্য আজও জ্বলেনি একটাও মোমবাতি।
লেখকেরা পরিবেশ ও সমাজকর্মী। মতামত ব্যক্তিগত।