মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শেষ আপডেট: 2nd March 2025 18:06
অমল সরকার
বিহারের ভোটের ময়দানে একটা সময় চালু কথা ছিল, ‘জিসকা লাঠি উসকা ভৈঁস’। কথাটি গোটা ভারতের জন্যই সত্যি। ভৈঁস বা মোষ কোথাও ঘোড়া, কোথাও গরু তো কোথাও ভেড়া। লাঠি অর্থাৎ টাকা ও পেশি শক্তি যাদের বেশি, জয় তাদের নিশ্চিত।
দু-আড়াই বছর আগে পর্যন্ত পেশি শক্তির যে আস্ফালন দেখা যেত এখন তা অনেক কম। উল্টো ছবি অর্থ শক্তিতে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে টাকার খেলা। এটাও সত্য নির্বাচন কমিশন ভোটে কালো টাকা এবং পেশি শক্তির ব্যবহার আটকাতে নজিরবিহীন পদক্ষেপ করেছে।
কিন্তু বিগত পাঁচ-সাত বছর যাবত সমস্যার অভিমুখ ঘুরে গিয়েছে। ভোটে অনিয়মের অভিযোগ স্বয়ং রেফারি অর্থাৎ কমিশনের বিরুদ্ধে, যা অতীতে কখনও শোনা যায়নি। অর্থাৎ ভোট পরিচালনার কাঠামোটিই এখন অনিয়মের অসুখে আক্রান্ত।
বিগত তিন-সাড়ে তিন দশক লোকসভা, বিধানসভা-সহ সব নির্বাচন কভার করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও পাঁচ-ছয়টি রাজ্যের ভোট কভার করেছি। নির্বাচনের মাঠ-ময়দানের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও কভার করেছি প্রায় তিন দশক। দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, গত ছয়-সাত ধরে নির্বাচন কমিশন শেসন জমানার উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছে। কমিশন হয়ে উঠেছে ভারত সরকারের একটি অফিস, নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লকের কর্তারা সরাসরি যে প্রতিষ্ঠানটিকে চালনা করছেন।
গত শতকের নয়ের দশকের গোড়ায় টিএন শেসন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর ভারতের নির্বাচন কমিশনের স্বাতন্ত্র ও মর্যাদা টের পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর সময়ে কমিশন ভারত সরকার বা কোনও দলের কথায় চলত না। শেসন তাই কোনও দল ও নেতার প্রিয় পাত্র ছিলেন না। ঘটনা হল, শেসনের পূর্বসুরিরা তাঁর মতো প্রতাপশালী না হলেও আজকের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, কমিশনারদের মতো সরকারি পুতুল ছিলেন না।
শেসন অবসর নেন ১৯৯৬-এর ডিসেম্বরে। তারপর ২০১৮-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত দু-দশক নির্বাচন কমিশন কম-বেশি চালিত হয়েছে শেসনের দেখানো পথে। ওই পর্যন্ত কমিশনের বিরুদ্ধে ভোটে রেফারির ভূমিকা পালনে অপেশাদারিত্বের অভিযোগ উঠলেও কখনও সরকার এবং শাসক দলের তাবেদারির জোরালো নালিশ শোনা যায়নি, যা ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে তৎকালীন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরার বিরুদ্ধে উঠেছিল। সেই ভোটে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের অভিযোগ পেয়েও তিনি ব্যবস্থা নিতে রাজি হননি। প্রতিবাদে নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে ইস্তফা দেন অশোক লাভাসা। তাঁর পদত্যাগ নজিরবিহীন থাকেনি পাঁচ বছরের মাথায় আর এক নির্বাচন কমিশনার অরুণ গোয়েল সরে যাওয়ায়। অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’জন নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ উড়িয়ে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের পূর্ণ ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকার কুক্ষিগত করাতে স্পষ্ট মোদী সরকার আনুগত্যের প্রত্যাশায় না থেকে প্রশ্নাতীতভাবে একান্ত অনুগতদের বেছে নিচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন যে রেফারির ভুমিকা পালনে আগ্রহী নয় তার জ্বলন্ত প্রমাণ মমতা বন্দ্যাপাধ্যায়ের অভিযোগ। দু’দিন আগে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় অভিযোগ করেন, বাংলায় ভোটার তালিকায় ভিন রাজ্যের নাগরিকদের নাম আছে। সেই অভিযোগের জবাবে রবিবার নির্বাচন কমিশন যে ব্যাখ্যা হাজির করেছে তাতে এটা স্পষ্ট তারা সমস্যাটির কথা জানত। এ প্রশ্ন সঙ্গত, এতদিন তারা তাহলে কেন তালিকা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়নি।
ব্যবস্থা নেয়নি বলেই গোটা সমস্যাটিকে ‘ক্ল্যারিক্যাল মিস্টেকস’ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। ভোটার তালিকায় অনেক গরমিলের নজির আমার জানা আছে। কিন্তু এক রাজ্যের তালিকায় আর এক রাজ্যের বাসিন্দার নাম থাকার অভিযোগ আগে শোনা যায়নি। কমিশন এখন বলছে তারা খতিয়ে দেখবে কী করে এই সমস্যা হল এবং এই ভিন রাজ্যের ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হবে।
দিনের শেষে হয়তো দেখা যাবে অভিযোগ বা সমস্যা যাই বলি না কেন, তা বড় কিছু নয়। আমার ধারণা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও তা জানেন। তিনি তালিকায় ভূতুড়ে ভোটার বাছাইয়ের ডাক দিয়ে এই সুযোগে দলকে ভোটমুখী করে দিলেন। তৃণমূলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, মারামারি, খুনোখুনি সম্বৎসরের ব্যাপার। আবার বরাবরই ভোটের সময় দলের সব গোষ্ঠী এক হয়ে গিয়েছে। তৃণমূল নেত্রীর হয়তো কোন্দল থামাতে দলকে ভোট নিয়ে ভয় দেখানো জরুরি ছিল।
তাছাড়া, গুচ্ছ দুর্নীতি এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার স্বাভাবিক নিয়মে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের ভোটের ফারাক এখন কতটা তার তাজা হিসাব আগামী বছরের বিধানসভা ভোটের আগে পাওয়া সম্ভব নয়। যদিও এটাও সত্য যে, এত কিছুর পরও সাংগঠনিক শক্তিতে বিজেপির তুলনায় তৃণমূল অনেক এগিয়ে। সিপিএম যে কৌশলে নিবিড় ভোট মেশিনারি গড়ে তুলেছিল তা এখন তৃণমূলের আয়ত্বে। ফলে মহারাষ্ট্রে, দিল্লিতে যেভাবে ভোটার তালিকায় কারচুপি করে, ভোটের আগে লাখ লাখ নাম তালিকায় তুলে বিজেপি বাজিমাত করেছে, পশ্চিমবঙ্গে তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু কে না বোঝে সাবধানের মার নেই। অভিযোগ, সমস্যা কতটা বড় সেই বিতর্কে না ঢুকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটার তালিকায় নজরদারির কাজ দিয়ে বিরোধীদের আগে নিজের দলকে ময়দানে নামিয়ে দিলেন। হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের পর দিল্লির ভোটে বিজেপিপ জয়ের যে ‘ভিতরের খবর’ বাইরে আসছে তা ভয়ঙ্কর। ফলে সাবধানের সত্যিই মার নেই। মহারাষ্ট্রে স্মরণকালের মধ্যে গত নভেম্বরের বিধানসভা ভোটে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ে। ছয় মাস আগে লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপির ভরাডুবি হয়। ৪৮ আসনের মধ্যে বিরোধীরা ৩০টি দখল করে। অথচ বিধানসভা ভোটে ২৮৮ আসনের মধ্যে বিজেপি একাই পায় ১৩২টি আসন। এখন জানা যাচ্ছে, বিধানসভা ভোটের আগে ৪৮ লাখ নতুন ভোটারের নাম তোলা হয় মহারাষ্ট্রে। এই অস্বাভাবিক ভোটার বৃদ্ধি নিয়ে কমিশনের নীরবতার একমাত্র কারণ হতে পারে যা হওয়ার তাদের জ্ঞাতসারেই হয়েছে।
হরিয়ানায় বিজেপির ক্ষমতায় ফেরা এতটাই অনিশ্চিত ছিল যে হার হবে ধরে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্র চারটি করে সভা করেন। তাঁদের ছবিও পোস্টার-ব্যানারে ছিল না। ভোটের তিন মাস আগে দু’বারের মুখ্যমন্ত্রীকে সরানোতেই বোঝা গিয়েছিল বিজেপির দশ বছরের শাসন নিয়ে জনমনে কী পরিমাণ ক্ষোভ জমা হয়েছে। সেই হরিয়ানায় বিজেপির টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার পিছনে কোন জাদু কাজ করেছে তা নিয়ে তদন্ত, গবেষণা জরুরি। এই দুই রাজ্যেই পেশি ও অর্থ শক্তির সেভাবে প্রভাব অন্তত দৃশ্যমান ছিল না। প্রশ্ন হল, তাহলে বিজেপি কীভাবে হারা গেম জিতে নিল।
বাংলায় গত বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপির দিল্লির এক নেতা একান্ত আলোচনায় জোরের সঙ্গে দাবি করেছিলেন, ‘কুছ ভি হো যায়, জিত তো হামারি হোগি।’ ফল প্রকাশের পর বলেছিলেন, ‘আগলি বার (মানে ২০২৬-এ) জরুর হোগি।’ শনিবার একটি সর্ব ভারতীয় চ্যানেলের আলোচনায় সহ বক্তা মহারাষ্ট্রের এক সাংবাদিক জানালেন, সেখানে বিধানসভা ভোটের আগে একমাত্র বিজেপি নেতারাই জোর দিয়ে দাবি করছিলেন, ‘জিত তো হামারি হোগি।’
জয়ের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত না হলে কোনও নেতা এই কথা বলতে পারেন না। তারপরও বলব, মহারাষ্ট্রে, হরিয়ানায় কংগ্রেস প্রধান প্রতিপক্ষ হওয়ায় বিজেপি যে সুবিধা পেয়েছে, বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস সে সুযোগ দেবে না। কিন্তু ২০২১-এ তারা বিফল হলেও ২০২৬-এ ক্ষমতা দখলে পদ্ম পার্টি কী কৌশল নেবে কেউ জানে না।
সবচেয়ে বড় বিপদ তথা সমস্যা রেফারি অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের পর থেকে কমিশন পদ্ম পার্টির গোল কিপারের ভূমিকা নিয়েছে। তাদের কাজ হয়েছে, বিরোধীরা যাতে বিজেপির জালে বল ঠেলতে না পারে সেই চেষ্টা করা। ফলে দলের ভোট এবং বুথ রক্ষার ভার এখন আর কমিশনের হাতে ছেড়ে রাখার অবকাশ নেই। ‘সেফ বুথ, সেভ ভোট’ মন্ত্র জপ করা বিজেপি বিরোধী সব দলের জন্য সময়ের দাবি।