শেষ আপডেট: 22nd September 2024 16:14
পুজোয় চাই নতুন জুতো।
বিজ্ঞাপনের এই ক্যাচলাইনের মধ্যেই হিন্দু বাঙালির শ্রেষ্ঠ পার্বণের সারসত্যটি লুকিয়ে রয়েছে। দুর্গাপুজোর বারোয়ারী আয়োজনে হিন্দুধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার উপাদান পুজোর তিন দিন মাইকে চণ্ডীপাঠ ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এছাড়া অষ্টমীতে উপোস করে পুষ্পাঞ্জলি, সন্ধিপুজোয় প্রদীপ জ্বালানো, সন্ধ্যায় ঢাকঢোলের তালে ধুনুচি নাচ, আরতি-- এমন কিছু আচার পালন ছাড়া দুর্গা পুজো মানে দিন চারেকের বাৎসরিক উৎসব। সামাজিক উৎসব। তাতে পুজো কম, আনন্দের উদযাপনই মুখ্য। জুতোর বিজ্ঞাপন দিয়ে যার আগমনী, :আসছে বছর আবার হবে' এমন আশাবাদের মধ্য দিয়ে সেই উৎসবের সমাপন হয়।
সংবৎসরের সাফল্য বেদনার নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা বঙ্গজীবনে পুজোর চারদিন, একটা আলাদা মাত্রা জুড়ে দেয়। সোনা গলানো রোদ্দুর আর উজ্জ্বল ঘন নীল চাঁদোয়ার পেঁজা তুলোর বাহারী আকাশ জানিয়ে দেয় বর্ষা বিদায়। পুজো আসছে।
বাঙালির বারো মাসে তেরো নয়, প্রকৃত অর্থে একটাই পার্বণ। দুর্গা পুজো। এ পুজো এমনই, যাতে ভক্তিরস নয়, প্রধান হয়ে ওঠে আনন্দোৎসব। নিষ্ঠাবান আস্তিক থেকে অবিশ্বাসী নাস্তিক সবাইকে এক উঠোনে হাজির করে হিন্দু বাঙালির এই বৃহত্তম পার্বণ।
সেই চেনা অনুভূতিটা এবারে কেমন যেন বিসদৃশ ঠেকছে। গত ৯ অগস্ট আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়া চিকিৎসক তিলোত্তমার হত্যাকাণ্ড ও তার বিচারের দাবি ঘিরে তোলপাড় রাজ্য। আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব আন্দোলন। নাগরিক সমাজের এমন ব্যাপৃত অংশগ্রহণ সত্যিই নজিরবিহীন। চল্লিশ দিন অতিক্রান্ত হয়েও আন্দোলনের তীব্রতা কমার লক্ষণ নেই। তিলোত্তমার বিচারের দাবি রাজপথে। মফস্বল থেকে গ্রামাঞ্চলে বিচ্ছিন্ন ভাবে কোথাও কোথাও তার রেশ পড়লেও মুখ্যত শহুরে 'প্রিভিলেজড' শ্রেণির দ্বারাই মাসাধিক চলমান এই আন্দোলন।
ধর্ষণ ও খুনের বিচার, দোষীর সাজা মনেপ্রানে চাইছে মানুষ। জনপরিসরে স্বাভাবিক কারণেই তিলোত্তমার প্রশ্নে তৈরি হয়েছে সুতীব্র আবেগ। ছাত্র, যুব সমাজের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রী থেকে আটপৌরে গৃহবধূ পর্যন্ত রাত জেগে মহানগরের রাস্তায়। অখ্যাত সহনাগরিকদের এই স্বতঃস্ফূর্তায় অস্থির হয়ে পথে নামতে দেরিতে হলেও বাধ্য হয়েছেন বিশিষ্টরা। গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা-- মায় গোটা টলিউড স্লোগান তুলেছে জাস্টিস ফর আরজি কর।
নতুন জামা-জুতোর পাশাপাশি পুজোর গান, সিনেমা থেকে শারদীয় পত্রপত্রিকা সব মিলিয়ে নির্মিত হয় বাঙালির পুজোর উপাচার। সেখানেই যেন খানিক তাল কাটছে। ব্যাজার মুখ পুজোর বাজারেও। তিলোত্তমার বিয়োগ ব্যথা থেকে জন্ম হওয়া বাঙালির এই দ্রোহকাল কি সেইসব 'মূঢ় ম্লান মুখে ' উৎসবের ভাষা দিতে পারবে না এবার?
সেই মুখগুলো তো সারা বছরের দৈনিন্দনতার মধ্যেও পুজোর চার দিনের অপেক্ষায় থাকে। এই অপেক্ষার বা স্বপ্নের নেপথ্যে রয়েছে এক কঠোর বাস্তবতা। ভারতের বণিক সভা বেশ কয়েক দশক আগে একটি সমীক্ষা করে দেখিয়েছিল, বাঙালির এই দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে যে বিপুল আর্থিক লেনদেন হয়, ভূভারতে তার কোনও নজির নেই। সেই আর্থিক কর্মকাণ্ডে সর্বাধিক উপকৃত হন যাঁরা ,তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই সমাজের প্রান্তবাসী। দারিদ্র্য আর বঞ্চনা তাঁদের নিত্যসঙ্গী। ইদানিং পুজোর আয়োজনকে কেন্দ্র করে সাজসজ্জা ও আনুষঙ্গিক প্রয়োজনে যে মোটা পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তার একটা বড় অংশ চুঁইয়ে চুঁইয়ে নিম্নবর্গীয় মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এই শারদ উৎসবের অর্থনৈতিক সার্থকতা সেখানেও।
বিচারের দাবিতে উৎসব প্রাঙ্গণে বিমর্ষতা ছায়া ফেললে অন্ধকার গাঢ়তর হবে ওইসব প্রান্তিক মানুষের সংসারে।
যে তারকা তিলোত্তমার বিচার চেয়ে রাস্তায় মিছিলে সরব, ঘটনাচক্রে পুজোয় তাঁর ছবি মুক্তি পাচ্ছে। পুজোর সিনেমা।।তিলোত্তমার আবেগ আর ছবির বিপণন সব মিলেমিশে একাকার। তবে বিচার তো মিছিলে নয়, মিলবে বিচারালয়ে। সেখানে আবেগ নয়, বস্তুনিষ্ঠ যুক্তি আর প্রতিযুক্তির ঠাসবুনোটে চলা সওয়াল-জবাবই একমাত্র বিচার্য। অর্থাৎ দোষী-নির্দোষ বিচার আদালতের এজলাসে। রাজপথে, মশাল মিছিল বা অবস্থান মঞ্চ-- সবটাই প্রতীকী। সেই কারণেই যিনি বা যাঁরা বিচার চাইছেন, অষ্টমীর সকালে নতুন পোশাকে তিনি বা তাঁরা সপরিবারে মণ্ডপে অঞ্জলি দেবেন। পুজোসংখ্যা তার আগেই হয়তো হকার বাড়িতে দিয়ে গিয়েছেন। যে নায়িকার সঙ্গে মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন, পুজোয় মুক্তি পাওয়া তাঁর অভিনীত ছবি দেখাটা তো তাঁর বা তাঁদের নৈতিক দায়, যা ছবির পক্ষে বাণিজ্যবান্ধব উপাদান। পাড়ায় পাড়ায় পুজো মণ্ডপের অদূরে লাল শালুর প্যান্ডেলে বইয়ের স্টল দেবে ঘোরতর নাস্তিককুল।
অথচ বিচার মেলার আগে উৎসব নয়, এমন ধারণা নির্মাণ করা হচ্ছে।
উৎসবের আঙিনায় সামিল হওয়ার সঙ্গে বিচারের দাবিতে স্থিত থাকার বিরোধ কোথায়?
পুজোর মরসুমি অনুভূতি তো স্রেফ অর্থনীতির অঙ্ক নয়, তার বাসা বঙ্গীয় সমাজ মানসে। আম আদমির মনস্তাত্বিক দুনিয়া থেকে এই শারদ উৎসবের মেজাজ উপড়ে ফেলা অসম্ভব।
আশ্বিনের শারদ প্রাতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অনণুকরণীয় মহিষাসুরমর্দিনী পাঠ, বাংলায় আবালবৃদ্ধবনিতার ধমনীতে উৎসবের স্রোত বয়ে নিয়ে যায়। অশুভ শক্তির হননে নারীশক্তির অনিবার্য বিজয়। তিলোত্তমা বা অভয়া যে নামেই ডাকি না কেন, তার বিচার প্রার্থনার সঙ্গে সর্বভূতেষু মাতৃরূপার বিজয় উৎসবের বিরোধ কোথায়?
উৎসবে ফিরতে বলায়, যে সামাজিক বয়ান নির্মাণের প্রয়াস লক্ষ্য করা গিয়েছে, তাতে ভাবের ঘরে চুরির লক্ষণ প্রকট। তা না হলে, আদালতের বিচার প্রক্রিয়া প্রলম্বিত অবশ্যম্ভাবী জেনেও, 'বিচার চায় অভয়া/ তবেই হবে মহালয়া'-- এমন স্লোগান কেন?
আবেগমথিত এমন স্লোগান যতই যুৎসই, শ্রুতিমধুর ও চমকপ্রদ হোক না কেন, বাস্তবের প্রেক্ষিতে তা আদ্যন্ত উৎসব বিমুখতার বার্তা চাপিয়ে দেওয়া অবিবেচনাসঙ্গত। বিচার চেয়ে পথে নামা যতটা স্বতস্ফূর্ত, পুজোকেন্দ্রিক উৎসব বয়কটের প্রচ্ছন্ন বার্তা ঠিক ততটাই সংগঠিত চাপ সৃষ্টি। সে বার্তা অভয়ার বিচার প্রার্থনার অছিলায় নিরন্তর ভিন্নতর কোনও অঙ্ক কষে চলেছে, যা আম নাগরিকের নয়, ক্ষমতার রাজনীতির কারসাজি।
সেই লক্ষ্যপূরণে উৎসব বয়কটের ডাক! গন্ধটা বড় সন্দেহজনক!
(লেখক প্রবীণ সাংবাদিক। মতামত তাঁর নিজস্ব।)