শেষ আপডেট: 27th October 2024 21:57
অমল সরকার
‘লড়াই এবার হাসিনা বনাম হাসের।’ এ বছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ভোট কভার করতে গিয়ে কথাটা প্রথম শুনি ঢাকার এক রিকশ চালকের মুখে। এরপর ভোটের দিন যত এগিয়েছে, রাজনীতিক, আমলা, সাংবাদিক থেকে আমআদমি— সকলের কথাতেই রিকশ চালকের ওই মতটিই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বিএনপি ও তাদের সহযোগী দলগুলি ভোট বয়কট করায় এমনীতেই নির্বাচন এবার একপেশে ছিল।
হাস মানে পিটার হাস, যিনি তখন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। নির্বাচনের দেড়-দু বছর আগের বাংলাদেশে ফিরে গেলে দেখা যাবে, টিভির পর্দা-খবরের কাগজ-পাড়া-অফিস-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-ট্রেন-বাস-মেট্রো—সর্বত্র আলোচনায় ছিলেন ওই মার্কিনি কূটনীতিক। সেই সব দিনে তিনি এবেলা কোনও দলের অফিসে গিয়ে বৈঠক করছেন তো ওবেলা আর এক পার্টির নেতাদের নিজের দফতরে ডেকে পাঠাচ্ছেন। তাঁরই তৎপরতার অংশ হিসাবে কিছু মার্কিনি আমলা-কূটনীতিক বলতে গেলে ওয়াশিংটন-ঢাকা ডেইলি প্যাসেঞ্জারি শুরু করেন। তাঁরা কেউ বলতেন মানবাধিকার বিপন্ন, কারও হুঁশিয়ারি গণতন্ত্র নেই। বাংলাদেশের ভোটের ভাগ্য নির্ধারণে তাঁরা এবেলা-ওবেলা রাজনৈতিক দলের অফিসে ছোটাছুটি করছেন। দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, সেই ভোটের সময় বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের তিন কর্তাও পিটার হাসের মতো ছোটাছুটি করেননি।
রাষ্ট্রদূত হাস ছিলেন ভোটের বাংলাদেশে বাইডেন প্রশাসনের হয়ে ময়দানে সবচেয়ে সক্রিয়, ঢাকার রিকশ চালকেরও যা নজর এড়ায়নি। বছর দশেক আগে ঢাকায় প্রথমবার রিকশ চড়ার সময় থেকেই সে দেশের দিন আনি দিন খাই মানুষগুলি সম্পর্কে আমরা ধারণা, তাঁরা এক ভিন্ন প্রজাতি। যাঁদের অনেকেই স্কুলের গণ্ডি পেরোননি। কিন্তু রাজনীতিতে প্রায় সকলেই পিএইচডি।
সেই হাসের দেশ আমেরিকায় আর দশ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ভোট নেওয়া হবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসলে গোটা বিশ্বের ভোট। শুধু মার্কিনিরা নন, গোটা বিশ্ব পাঁচ বছরে একবার রিপাবলিকান আর ডেমোরক্র্যাটদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। এমনকী ভারতের মতো বহু দেশ আছে, যেখানে মার্কিন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘরোয়া রাজনীতিও ভাগ হয়ে যায় দুই শিবিরে। মুখে বলুন চাই না বলুন, মোদ্দা কথা হল, নরেন্দ্র মোদী মনে প্রাণে চান তাঁর পরম প্রিয় ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও একবার হোয়াইট হাউসে ফিরে আসুন। অন্যদিকে, রাহুল গান্ধীর ইচ্ছা হোয়াইট হাউসের মালিক হোন কমলা হ্যারিস। সেটা ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা ভারতীয় বংশোদ্ভুত বলে নয়। পছন্দ, প্রত্যাশা পুরোপুরি রাজনৈতিক। কে জিতবেন, দায়িত্ব নিয়ে বলা কঠিন। তাই সব সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখেই বাকি দেশগুলি পদক্ষেপ করছে।
নরেন্দ্র মোদীর হঠাৎ করেই রাশিয়ার কাজান শহরে ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, সীমান্তে নজরদারি নিয়ে দুই দেশের বোঝাপড়ায় নয়া দিল্লির সায় দেওয়াকে অনেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আলোকে দেখছেন।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করার পিছনে মার্কিন ষড়যন্ত্র এখন আর গোপন নেই। কতিপয় মার্কিন কর্তার সে দেশে একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের বাসনা পূর্ণ হয়েছে। তাঁরা এখন মনে করছেন, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে বঙ্গোপসাগরের উপর থাকা সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি হাতে পেতে আর তেমন বেগ পেতে হবে না।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ মন্ত্রকের ওই দ্বীপ নিয়ে অতিসক্রিয়, দৃশ্যমান পদক্ষেপ পরিবেশবাদীদেরও সন্দেহের কারণ হয়ে উঠেছে। পরিবেশ রক্ষার নামে সেখানে পর্যটন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্বভাবতই ভাতে টান পড়েছে দ্বীপবাসীর। এইভাবে দ্বীপটিকে জনমানব শূন্য করে তোলার প্রচেষ্টার পিছনে অনেকেই মার্কিন যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছেন। কতিপয় মার্কিন কর্তার বাসনা সেখানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা। মুখে চিনকে মোকাবিলার কথা বলা হলেও এই তল্লাটে মার্কিন সামরিক কৌশলের অংশ ভারতও। চিনের পাশাপাশি তারা ভারতকেও চাপে রাখতে চায়।
বাংলাদেশ, মালদ্বীপে ভারতের বন্ধু সরকারগুলির পতনের পিছনে হোয়াইট হাউসের মদত এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের পর তারা বধ করেছে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারকে। বিগত তিন বছর যাবত গণতন্ত্র, মানবাধিকারের মতো ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনের হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবন্ধকতা তৈরির পিছনে লক্ষ্য শুধু বাংলাদেশ ছিল না, ছিল ভারতও। সম্ভবত সেই কারণেই নয়াদিল্লি উপলব্ধি করেছে, কূটনীতির ভারসাম্যের খেলায় টিকে থাকতে হলে চিনের সঙ্গে একতরফা দূরত্ব বাড়িয়ে যাওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বরং আমেরিকাকে চাপে রাখাও সমান জরুরি।
রাজনীতি ও কূটনীতি, দুই-ই আসলে সম্ভাবনার শিল্প। দুই ক্ষেত্রেই অসম্ভবকে সম্ভব করাকে সাফল্যের মাইল স্টোন ধরা হয়। শি-মোদী বৈঠক সম্ভব, ক’দিন আগেও অনেকে ভাবতে পারেননি। ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলে শি জিংপিন নিশ্চয়ই আর নরেন্দ্র মোদীর দিকে করমর্দনে বিশেষ আগ্রহ দেখাবেন না। কিন্তু ট্রাম্পই জিতবেন তার গ্যারান্টি কোথায়? পরিস্থিতি বুঝে মোদীও হয়তো তাঁর কূটনীতি বদলে নিলেন এবং নেবেন। মোদী ও ট্রাম্পের গলায় গলায় বন্ধুত্ব অজানা নয়।
অন্যদিকে, হাসিনা মুক্ত বাংলাদেশের বর্তমান শাসকেরা মনে মনে চাইছেন, হোয়াইট হাউসের মালিকানা ডেমোক্র্যাটদের হাতেই থাক। মহম্মদ ইউনুস ও তাঁর বাহিনীর আশা কমলা হ্যারিস মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণের কাজটি আরও দ্রুততার সঙ্গে করা যাবে। আওয়ামী লিগের মতো বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিতেও কোতল করা সম্ভব হবে এবং এ ভাবে আমেরিকাকে খুশি রাখতে পারলেই তাঁদের নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে আর কোনও বাধা থাকবে না। তারা আরও অন্তত পাঁচ বছর নির্ভাবনায় বাংলাদেশ শাসন করতে পারবেন। অন্যদিকে, আওয়ামী লিগের নেতা-কর্মী-সমর্থর্কদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যাচ্ছে, তাঁরা মনে করছে ট্রাম্প ফিরে এলেই ডেমোক্র্যাটদের প্রিয় পাত্র ইউনুসকে সায়েস্তা করা সহজ হয়ে যাবে। নৌকা আবার ভাসতে শুরু করবে। দুই শিবিরেই বোঝাপড়ায় অনেক গলতি আছে।
ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে ইউনুস বাহিনীর বিপুল আশা-ভরসার কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা স্বয়ং। ইউনুসের সঙ্গে সাবেক দুই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও বারাক ওবামা এবং প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিনটনের সম্পর্ক যেমন মধুর, তেমনই তিক্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে। সেই মধুর সম্পর্কের সুবাদে ইউনুসের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া এবং ২০০৬-’০৭ সালে তাঁকে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে বসাতে চেয়েছিলেন এই মার্কিন কর্তারা। অন্যদিকে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ লিজ দিতে না চাওয়া, মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধে যুক্ত অভিযুক্তদের সাজা রদে ক্লিনটন পত্নীর আর্জি পত্রপাঠ অগ্রাহ্য করে সেই একই মার্কিন কর্তাদের চক্ষুশূল হয়েছেন শেখ হাসিনা। তাই তাঁর সময়ে বাংলাদেশের উপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, পৃথক ভিসা নীতি চালু, মানবাধিকার হরণের অভিযোগে নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় কর্তার আমেরিকায় প্রবেশাধিকার আটকে দিয়ে আওয়ামী লিগের সরকারকে দেশে, দেশের বাইরে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা জারি রাখেন বাইডেন প্রশাসনের ওই কতিপয় কর্তা। বয়স এবং অসুস্থতার কারণে ন্যুব্জ জো বাইডেন এই সব বিষয়ে কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন, নিজে কতটা ভাবনাচিন্তা করতেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
তাছাড়া কূটনৈতিক মহল জানত, ওই পদক্ষেপগুলি কখনই মার্কিন বিদেশ নীতি নয়, ছিল ক্লিনটন দম্পতির বাংলাদেশ কৌশলের অংশ। আরও স্পষ্ট করে বললে হাসিনা-বধ নীতি। মানতেই হবে বাইডেনের ঘারে বন্দুক রেখে তাঁরই অফিসারদের কাজে লাগিয়ে ‘টিম ক্লিনটন’ এই কার্যসিদ্ধি করেছে। বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকদের অনেকেই ক্লিনটনের মন জুগিয়ে গিয়েছেন গত পাঁচ বছর।
বিল ক্লিনটনের সঙ্গে ইউনুসের বন্ধুত্ব বহুদিনের। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে মোটা টাকা অনুদান জোগার করে দিয়েছেন ইউনুস। পরিবর্তে ইউনুসের কথায় বাংলাদেশ নিয়ে পদক্ষেপ করেছে ক্লিনটন বাহিনী।
কিন্তু বাংলাদেশের ভিতরে ও বাইরে ইউনুসের যে ভক্তরা মনে করছেন, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস জিতে গেলে অন্তর্বর্তী সরকারের আগামীর পথ নিষ্কণ্টক হয়ে যাবে, যতদিন ইচ্ছা তাঁরা বাংলাদেশ শাসন করবেন, তাঁরা আসলে ভুলের স্বর্গে বাস করছেন। ডেমোক্র্যাট শিবিরে কমলা মোটেই ক্লিন্টননিস্ট বা ক্লিনটনবাদী নন। তাঁর প্রচারে সেই কারণে ক্লিনটনবাদীরা তেমন সক্রিয় নন। ক্লিনটন লবির অসহযোগিতা সত্ত্বেও কমলা জিতে গেলে বাইডেন প্রশাসনের আজকের শীর্ষ আমলারা কে কোথায় থাকবেন বলা মুশকিল। কমলা তাঁর মতো করে টিম সাজাবেন। তাঁর প্রশাসনে পূর্বসূরিদের মাতব্বরি চলবে না। কারণ, তিনি জো বাইডেন নন। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরতে পারলে তো এমনীতেই ইউনুস বাহিনীর কপালে দুঃখ আছে। হাসিনা দেশছাড়ার পর বাংলাদেশের মাটিতে রাষ্ট্রীয় মদতে সংঘঠিত গণহত্যা, সংখ্যালঘুদের নিকেশ অভিযানের তদন্ত হবে কমলা প্রেসিডেন্ট হলেও। পিটার হাস, ডোলাল্ট লু, অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, বাইডেন জমানায় ক্লিনটন অনুগতরা তখন কে কোথায় থাকবেন তাঁরা নিজেও জানেন না।