নরেন্দ্র মোদী এবং মহম্মদ ইউনুস
শেষ আপডেট: 8th December 2024 19:50
আট বছর আগে দিনটি ছিল ৮ নভেম্বর। ২০১৬-র সেই দিন বিকেলে খবর এল রাত আটটায়, জাতীর উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই খবরে সংবাদমাধ্যম থেকে আমজনতা বেশিরভাগেরই ধারণা হয়েছিল, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী। আমিও তেমন সম্ভাবনা ধরে নিয়ে সে রাতে কারগিল যুদ্ধ কভার করা কতিপয় সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, ভারত-পাক যুদ্ধ নিয়ে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করার জন্য। পরে জেনেছি, বলতে গেলে দেশের সমস্ত নিউজই সে রাতে রুম ধরে নিয়েছিল, কারগিল যুদ্ধের দু-দশকের মাথায় আবার পাকিস্তানকে জবাব দিতে চলেছে ভারত। তার কিছুদিন আগে পাঞ্জাবের সেনা ছাউনিতে পাকিস্তানি জঙ্গি হামলার ঘটনায় সমাজমাধ্যমে অনেকেই সরকারের উদ্দেশে দাবি জানাচ্ছিলেন ইসলামাবাদকে আরও একবার উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার।
সেই রাতে প্রধানমন্ত্রী মোদী কী বলেছিলেন সকলেই মনে থাকার কথা। রাত ১২’টার পর পাঁচশো ও দু-হাজার টাকার নোট অচল হয়ে যাবে জেনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল দেশবাসীর। পরের দিনগুলির অভিজ্ঞতা বহু বছর মনে রাখবে ভারতবাসী।
নরেন্দ্র মোদীর সিদ্ধান্তকে অনেকেই দেশবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বলে অনুযোগ, অভিযোগ করলেও ভোটের বাক্সে ক্ষোভের প্রতিফলন ধরা পড়েনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, টাকা বাতিলের ফলে সবচেয়ে বিপাকে পড়বে জঙ্গিরা। তাঁর বাজনদারেরা দাবি করেছিল, নোট বাতিল করে পাকিস্তানকে আচ্ছা জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশে মহম্মদ ইউনুস এখন ২০১৬-র নরেন্দ্র মোদী। ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর বিগত তিন-সাড়ে তিনমাস তাঁর উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। জিনিসপত্রের দাম, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় মানুষ প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছিল, ‘আগেই ভাল ছিলাম’, ‘ফের হাসিনাকে চাই’ ইত্যাদি। সব কিছু ছেড়েছুড়ে ইউনুস ফিরে যাবেন গ্রামীণ ব্যাঙ্কে, এমন জল্পনাও শোনা যাচ্ছিল।
কিন্তু নভেম্বরের শেষে এসে আচমকাই পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে চলে গিয়েছে। চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার, সেই হিন্দু সাধুকে জামিন দিতে অস্বীকার করা এবং আদালতের অদূরে তরুণ সরকারি আইনজীবী সাইফুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের জেরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে চেনা অস্ত্রই হাতে তুলে নিয়েছেন তিনি। হিন্দু আর হিন্দুস্থান অর্থাৎ ভারতকে এক করে নিয়ে ‘বাংলাদেশ বিপন্ন’ আওয়াজ তুলেছেন। তিনদিন আগে সর্বদলীয় বৈঠকে আবেগঘন ভাষণে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী-খুলনা-বরিশালের রাস্তায় উগ্রবাদী ইসলামপন্থীদের মতো তিনিও কথার মারপ্যাঁচে আসলে ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের অভিযোগ তুলেছেন। দেশবাসীকে বার্তা দিয়েছেন, দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়াই এখন পবিত্র কর্তব্য। ফলে হঠাৎ করেই রাজনৈতিক দলগুলি ইউনুসের পিঠ চাপড়াতে নেমে পড়েছে।
ঢাকার সেই সর্বদলীয় সভার আগে কলকাতায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অমর্যাদা, আগরতলায় সে দেশের দূতাবাস অফিসে কতিপয় বীরপুঙ্গবের হামলার ঘটনা ইউনুসের পক্ষে দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্নতার কথা গেলানো আরও সহজ হয়ে যায়। ফলে ক’দিন আগেও যে বিরোধী দলগুলি প্রধান উপদেষ্টাকে আকারে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করছিল, সময় হয়ে গেছে, নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে সরে যান, তারাই এখন ঢাকার রাজপথের মিছিল থেকে স্লোগান দিচ্ছে, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা, ঢাকা।’ ইউনুস সরকারের কট্টর সমালোচক, যিনি ক’দিন আগেও বলেছেন, হাসিনাই এখনও দেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী, সেই বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভারতকে উচিত জবাব দেওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসা প্রাপ্য।
এমনকী শনিবার কিছু বালখিল্য অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ঢাকার মিছিল থেকে হুঙ্কার ছেড়েছেন, চাইলে চারদিনের মধ্যে কলকাতা, ত্রিপুরা, অসম দখল করে নিতে পারি। অন্যদিকে, এপারেও শুরু হয়েছে দুই দেশের সামরিক শক্তি নিয়ে মিডিয়ার আস্ফালন। এরই নাম দেশপ্রেমের জিগির। ফলে দায়িত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে আসীন নেতার আস্ফালন, সীমান্তে গিয়ে অশান্তি সৃষ্টি, বাংলাদেশের মানুষকে ভাতে মারার হুঙ্কার সীমান্তের দুই প্রান্তের মোটা মাথাদের এক বন্ধনীতে এনে দিয়েছে, ধর্মকে যারা রাজনীতির অস্ত্র ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না।
যদিও এটাই সব নয়। এই অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেও সময়ের দাবি মেনে অপারের কিছু মানুষ ভিন্ন কথা বলছেন, দুর্ভাগ্যের হল, এপারে যা অনুপস্থিত। জাতীয় ঐক্য রক্ষার নামে নিজের গদি বাঁচাতে ইউনুসের ডাকা সেই বৈঠকে যেমন বাংলাদেশের কবি ও মানবতাবাদী বিশিষ্টজন ফরহাদ মজহার জোর গলায় প্রশ্ন তোলেন, চিন্ময়কৃষ্ণ দাস কী এমন অপরাধ করেছেন যে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে জামিন না দিয়ে জেলে আটকে রেখেছে? তিনি তো তাঁর ধর্ম সম্প্রদায়ের দাবিদাওয়া পেশ করতেই পারেন।
পরদিন দ্য ওয়াল-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মজহার বলেছেন, হিন্দুদের সংগঠনগুলির আটদফা দাবির মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। চিন্ময়কৃষ্ণের কথাতেও দেশদ্রোহিতার কিছু আমি পাইনি। জুলাই-অগস্টের গণঅভ্যত্থানের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘ওই গণ বিপ্লবের সংকল্প ছিল সকল বৈষম্যের অবসান। কাউকে যদি নিজের সম্প্রদায়ের কথা বলায় জেলে যেতে হয় তাহলে তো বৈষম্য আরও বেড়ে গেল।’
বাংলাদেশের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভারতের জাতীয় পতাকা ও প্রতীকের অমর্যাদার ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। শনিবার বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের প্রাইম টাইম অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগের অধ্যাপক শামিম রেজাকে বলতে শুনলাম, ‘কেন আমরা ভারতের জাতীয় প্রতীকের অবমাননা করলাম? ভারতে ঘটেছে বলেই আমাদের করতে হবে?’ আরও বলেছেন, ‘দূতাবাসে কতিপয় মানুষ হামলা করেছে। তার জন্য গোটা ভারতকে কেন শত্রু ভাবছি আমরা? ক’দিন আগে আর একটি টিভি শো’য়ে তিনি সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা নিয়ে ইউনুস সরকারকে বিদ্ধ করে বলেছেন, কম বা বেশি, সংখ্যাটা আসল নয়, যে ক’টি ঘটনাই হয়ে থাক না কেন, সেগুলি স্বীকার করে নিতে হবে। এড়িয়ে গেলে, উপেক্ষা করলে চলবে না। সংখ্যালঘু নিপীড়ন, নির্যাতনের ঘটনাগুলি নিয়ে তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরির দাবিও তুলেছেন এই প্রবীণ অধ্যাপক।
বিবিসি বাংলার একটি অনুষ্ঠানে একই কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর এক অধ্যাপক জুবাইদা নাসরিন। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে হিন্দুরা কখনওই নিরাপত্তা পায়নি।’ সংখ্যালঘুদের উপর হামলাবাজির ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনিও। বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি বাদ দেওয়ার সরকারি উদ্যোগ হিন্দুদের পরিচয় সত্ত্বাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে, মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে সরকার এবং প্রথমসারির রাজনৈতিক দল ও মিডিয়ার বড় অংশ যখন সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনাগুলিকে অতিরঞ্জিত বলে রব তুলেছে, তখন এই শিক্ষিকা বিবিসি-র অনুষ্ঠানে স্পষ্ট বলেছেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দুরা প্রতিদিন ভয়ের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।’
কিন্তু এপারে আমরা কি সাম্প্রদায়িক উসকানির বিপরীতে এমন নজির তৈরি করতে পারছি? পড়শি ছোট দেশটিতে হিন্দুদের উপর নির্যাতনে ঘটনা চলমান থাকার সময় উত্তর প্রদেশের সাম্ভালের মসজিদে মন্দিরের নিদর্শন খোঁজার জরিপ ঘিরে সাম্প্রদায়ির সহিংসতার ঘটনায় চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। তারপরও মসজিদের নীচে মন্দির খোঁজার অভিযানে বিরাম নেই। সাম্ভাল এবং অন্যত্র রাজনীতি চড়লেও নীরব দেশের নাগরিক সমাজ। অশান্তি থামাতে শেষে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মুখ খুলতে হয়েছে দিল্লির জামা মসজিদের ইমামকে।
রাজনীতি সবর্দাই ভোটের অঙ্ক মেনে চলে। সহ-নাগরিকের প্রতি মসজিদের নীচে মন্দির, শিবলিঙ্গ খোঁজার অভিযান নিয়ে রাজনীতির বাইরে দেশের নাগরিক সমাজের নীরবতা ভয়ঙ্কর প্রবণতা। মধ্যপ্রদেশে জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করতে শিশুদের উপর শারীরিক পীড়নের ঘটনাতেও নীবর দেশের নাগরিক নেতৃত্ব। হিন্দুত্বের নামে এপারে বিনা প্রতিবাদে উগ্রবাদী আচরণ, আস্ফালন চলমান থাকলে সীমান্তের অপারে তালিবানি ইসলাম আরও সুর চড়াবে, বলার অপেক্ষা রাখে না।
রবিবার ইউনুস সরকারের চারমাস পূর্ণ হল। চারমাস অনেকটা সময় নয়। আবার কমও নয়। মানুষ প্রত্যাশা করেছিল দেশে শান্তি ফিরবে। আয়ত্বের মধ্যে আসবে জিনিসপত্রের দাম। ইউনুস সরকার আমজনতার সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলেও সরকারের চালিকা শক্তির মন জোগাতে দারুন সফল। বাংলাদেশকে আর একটা পাকিস্তান হিসাবে গড়ে তুলতে মাত্র চারমাসে প্রত্যাশার অতিরিক্ত করেছেন তিনি। নিপূণভাবে অনুসরণ করে চলেছেন অবিভক্ত পাকিস্তানের শাসকদের।
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন, বাংলা ভাষার জন্য লড়াই-সংগ্রামের মোকাবিলায় পাকিস্তানের পশ্চিমী শাসকেরা কথায় কথায় ‘ইসলাম খতরে মে হ্যায়’ এবং যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিকে হিন্দুস্থানের ষড়যন্ত্র বলে চালাত। ইউনুস তাঁর অনন্ত ব্যর্থতা ঢাকতে ইসলাম এবং বাংলাদেশকে এক করে বিপন্নতার রব তুলেছেন। এপারে হিন্দুত্ববাদীদের হুংকার শুনে মনে হচ্ছে, সীমান্তের অপারে এমন পরিস্থিতিই তাদের প্রত্যাশিত ছিল। ভারতের দুই প্রান্তে দুটি পাকিস্তান থাকলে দেশের ক্ষতি বটে, হিন্দুত্ববাদীদের লাভ। তারা আরও গলা চড়িয়ে বলতে পারবে, ‘হিন্দু খতরে মে হ্যাঁয়’। ভারতের আম নাগরিক, নাগরিক নেতৃত্বকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কী চান।