নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ
শেষ আপডেট: 5 May 2025 16:39
পহেলগাম (Pahalgam) হত্যাকাণ্ডের (Pahalgam attack) পর যথারীতি যুদ্ধ উন্মাদনায় (war cry) মেতেছে দেশ। বাড়ির ড্রয়িংরুম, ট্রেন, বাস, চা-কফির আড্ডা—সর্বত্র এটাই প্রশ্ন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করবে কবে।
সাম্প্রতিক অতীতে, ২০১৬ এবং ২০১৯-এ ভারত (India) দু’বার পাকিস্তানের (Pakistan) মাটিতে সার্জক্যাল স্ট্রাইক (Surgical strike) চালিয়ে জঙ্গি শিবির (terrorist camps) ভেঙে দিয়েছে। সমাজমাধ্যমে একাংশের মুড হল, দিল মাঙ্গে মোর, অর্থাৎ এবার পুরোদস্তর যু্দ্ধ হোক। পাকিস্তানকে শেষ করে দিক ভারত। পুলওয়ামার পর যুদ্ধ যুদ্ধ রব যদিও আরও বেশি ছিল। যুদ্ধের দাবিতে অনেক বড় ঝড় উঠেছিল সমাজমাধ্যমে। বলাইবাহুল, সেবার দু’মাসের মাথায় লোকসভার ভোট থাকায় উত্তেজনা উচ্চগ্রামে তোলার চেষ্টাও ছিল চোখে পড়ার মতো।
যদিও কাশ্মীরে (Kashmir) আমাদের সেনাকে সারা বছর যুদ্ধ করতে হয়। পাকিস্তান, চিন সীমান্তে বিএসএফ নয়, সীমানা রক্ষার মূল দায়িত্ব সেনা বাহিনীর (Indian Army)। জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ J & K police), বিএসএফ (BSF), সিআইএসএফ (CISF), সিআরপিএফের (CRPF) কমান্ডোরাও অংশ নিয়ে থাকেন।
মার্চের গোড়া থেকেই গোটা কাশ্মীর জুড়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছিল ভারতের যৌথ বাহিনী। খবর পাওয়া যাচ্ছিল, বরফ গলা শুরু হওয়া মাত্র সীমান্ত পেরিয়ে পাক জঙ্গিরা উপত্যকার জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়েছে। মরণপন লড়াই করে যৌথ বাহিনী তাদের নিকেষ করছিল। সে লড়াই ছিল অনেক কঠিন। সীমান্তে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে অস্তিত্ব জানান দেওয়ার লড়াই নয়। প্রাণ হাতে মুখোমুখি যুদ্ধ। সেনা-আধা সেনা-পুলিশের বীর জওয়ানেরা সীমান্ত থেকে অনেকটা ভিতরে যখন জঙ্গি দমন অভিযানে ব্যস্ত তখন পহেলগামের হত্যাকাণ্ডে স্পষ্ট, আমাদের জওয়ান, অফিসারেরাও নিরাপদ নন। তাঁদের কাজ জঙ্গিদের মোকাবিলা করা। অন্যদিকে, নাশকতা, হামলা সংক্রান্ত গোপন তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব গোয়েন্দা এজেন্সিগুলির।
জম্মু-কাশ্মীর এখন আধা রাজ্য। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ভার কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। কিন্তু রাজ্যে একটি নির্বাচিত সরকার আছে। পহেলগামের হত্যাকাণ্ডের সপ্তাহ দুই আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্য সফরে গিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে বৈঠকে উপ-রাজ্যপালকে ডাকলেও মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি, যিনি হয়তো কিছু উপযুক্ত পরামর্শ দিতে পারতেন। অতীতে পূর্ণাঙ্গ রাজ্য চালানোর সুবাদে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা কেন্দ্র কাজে লাগাতে পারত।
তারপরও ওমর আবদুল্লাহ কেন্দ্রকে দায়ী না করে মুখ্যমন্ত্রী তথা পর্যটনমন্ত্রী হিসাবে পহেলগাম হত্যাকাণ্ডের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে রাজনৈতিক বিবাদ এড়িয়ে গিয়েছেন। সাম্প্রতিক অতীতে এ দেশের এমন প্রকৃত রাষ্ট্রনেতা সুলভ আচরণ বিরল। বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী, পর্যটন মন্ত্রী হিসাবে আমি মানুষকে জম্মু-কাশ্মীরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তাঁদের নিরাপদে ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। ক্ষমা চাওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি।’ রাজ্য বিধানসভায় দাঁড়িয়ে ওমরের এই বক্তব্যের বার্তা স্পষ্ট, কেন্দ্রকে হামলার দায় নিতে হবে।
সমস্যা হল, দিল্লির বর্তমান শাসকদের দায় নিতেই যত দ্বিধা। জবাবদিহিকে তারা পরাজয় মনে করেন। পুলওয়ামা, উরির হামলার পরও কেউ দায় নেয়নি। একের পর এক রেল দুর্ঘটনাতেও দায় নেওয়ার বালাই নেই।
শাহের সেই পর্যালোচনা বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী মোদীর ১৯ এপ্রিলের কাশ্মীর সফর চূড়ান্ত হয়েছিল। আবহাওয়া খারাপ থাকায় সেই কর্মসূচি বাতিল হয়। যদি আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকত তাহলেও নিরাপত্তার ঝুঁকির মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর সফর হত। তিনদিনের মাথায় পহেলগামের হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দিল, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাও নিশ্ছিদ্র নয়। তারপরও এত বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত কর্তারা কেউ দায় নেননি। প্রধানমন্ত্রীও কাউকে জবাবদিহি করতে বলেননি। নিরাপত্তায় গাফিলতি, গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে হয়তো পুলওয়ামার মতোই পহেলগাম নিয়েও কোনও সত্যপাল মালিক একদিন ‘আসল’ তথ্য ফাঁস করবেন। ব্যর্থতার দায় প্রধানমন্ত্রীর উপরও বর্তায়।
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে কাশ্মীরে জঙ্গি অনুপ্রবেশ, হামলার ঘটনা নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে তাঁর লাগাতার আক্রমণের কথা মোদী নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। প্রতিটি ঘটনায় পূর্বসূরীকে দুর্বল আর নিজেকে পরাক্রমশালী প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। সেই জম্মু-কাশ্মীরে আরও বেশি সেনা, আধা সেনার ঘেরাটোপে অতবড় জঙ্গি হামলার ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আমাদের বেতনভুক জেমস বন্ডেরা তার দায় নেবেন না কেন?
বছর গড়ায়নি, জম্মু-কাশ্মীরকে জঙ্গিমুক্ত শাম্তির উপত্যকা করার সংকল্প ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কথায় কথায় কাশ্মীরকে জঙ্গিমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি বিলিয়েছেন। পহেলগামের ঘটনার দায় তাই রাজনৈতিক নেতৃত্বও অস্বীকার করতে পারেন না। পদত্যাগই একমাত্র সমাধান মনে করি না। কিন্তু দেশবাসীর সামনে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাওয়া রাজনৈতিক দায়। মনমোহন সিংহ বেঁচে থাকলে উত্তরসূরির উদ্দেশে হয়তো বলতেন, অনেক তো জবাবদিহি চেয়েছেন, এবার জবাব দিন, দায় নিন।
পহেলগামের মতো হত্যাকাণ্ড কাশ্মীরে প্রায় দু-দশক আগে হয়েছিল। একদা উত্তর-পূর্ব ভারতে জঙ্গিরা বহিরাগতদের অপহরণ করত। অন্যদিকে, কাশ্মীরে পর্যটকদের উপর হামলার ঘটনা ছিল হাতে গোনা। তবে বাহিনীর সঙ্গে জঙ্গিদের মুখোমুখি সংঘর্ষের মাঝে পড়ে সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক আক্রান্ত হওয়ার নজির আছে। পহেলগামের পর্যটক হত্যার ঘটনায় মনে হয়, জঙ্গি সংগঠনগুলির স্থানীয় নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুরোপুরি পাকিস্তানের কবলে চলে গিয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পাকিস্তান জম্মু-কাশ্মীরে ঘুরে দাঁড়ানো পর্যটন ব্যবসাকে আরও একবার ধ্বংস করার চেষ্টা চালালো। একের পর এক যুদ্ধে পরাজয়ের বদলা নিতে গত শতকের আটের দশকে পাক সেনা শাসক জিয়াউল হক হিন্দুস্তানকে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত করার যে কৌশল নিয়েছিলেন, তারই পুনরাবৃত্তি পহেলগামের ঘটনা।
প্রশ্ন হল ভারত কী করবে? পাকিস্তানকে কীভাবে জবাব দেবে? পরমাণ বোমা হামলার কথা বলে পাকিস্তানের মন্ত্রীরা আসলে যুদ্ধে না জড়ানোর বার্তা দিয়েছেন। আজকের বিশ্বে পরমাণু অস্ত্র যুদ্ধ করা নয়, ভয় দেখানোর জন্য কাজে লাগে। তা ছাড়া যুদ্ধ করার মতো অবস্থায় নেই দেশটি। পাকিস্তানের বহু মানুষের এখন দিন আনি দিন খাই অবস্থা। আর্থিক অবস্থা এতটাই তলানিতে ঠেকেছে যে যুদ্ধ বাঁধলে সেনাদের অভুক্ত থাকাও অসম্ভব নয়।
অন্যদিকে, কয়েক বছরের ব্যবধানে দুবার পাকিস্তানের মাটিতে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং ফলাও করে তার কৃতিত্ব দাবি করে মোদী সরকার দেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে অনেকেই চান এবার পুরোদস্তুর যুদ্ধ ঘোষণা করুক ভারত।
শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার কী করবে দায়িত্ব নিয়ে বলা মুশকিল। তবে হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না মোদী সরকার যুদ্ধের দিকে হাঁটবে। প্রধানমন্ত্রী কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, কিন্তু পাকিস্তানের নাম উচ্চারণ করেননি। মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা এবং অর্থনীতি বিষয়ক কমিটির বৈঠকের পর পাকিস্তানকে জবাব দিতে সেনা বাহিনীকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যদিও সরকারিভাবে এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়নি। যদি সত্যিই তা হয়ে থাকে তাহলে সেটা নিতান্তই হাওয়া গরম করা নজর ঘোরানোর চেষ্টা বলতে হবে। ভারতীয় সেনা পাকিস্তানি আর্মি নয়। সরকারের অনুমতি, অনুমোদন ছাড়া তারা কোনও পদক্ষেপ করবে বলে মনে হয় না।
দিন তিনেক আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর পূর্ব নির্ধারিত সাংবাদিক বৈঠক ঘিরে গোটা দেশে তুমুল কৌতূহল তৈরি হয়েছিল পাকিস্তানকে জবাব দেওয়ার ঘোষণা করবে কেন্দ্র। সরকারি কর্তারা নাগরিক প্রত্যাশার বেলুন ফুটো করে দিয়ে করেন কাস্ট সেন্সাস অর্থাৎ জাতিগত গণনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। চলতি পরিস্থিতির সঙ্গে যার কোনও সম্পর্ক নেই, ছিল না আশু রাজনৈতিক দায়ও। পহেলগামের ঘটনায় বিরোধীরা যখন সরকারের জবাব চাইছে, তখন রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেস-সহ বিরোধী শিবির থেকে তোলা কাস্ট সেন্সাসের সিদ্ধান্তও কি নজর ঘোরানোর আরও এক পদক্ষেপ?
যুদ্ধ করতে হলে আগে জাতীয় ঐক্য তৈরি জরুরি। পহেলগাম নিয়ে সরকারের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী যোগ দেননি। অন্যদিকে, শোক ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আবহের মধ্যে বিজেপি গৃহশক্রু খোঁজা শুরু করেছে। দলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র শম্বিত পাত্র শনিবার কংগ্রেসকে পাকিস্তানের সঙ্গে এক করে দেখিয়ে লম্বা বিবৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, কংগ্রেস দীর্ঘদিন পাকিস্তানের সন্ত্রাসী ও সামরিক বাহিনীর মনোবল শক্তিশালী করার কাজে যুক্ত। বাইরে তারা নিজেদের কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি (CWC) হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু বাস্তবে পাকিস্তান ওয়ার্কিং কমিটির (PWC) হিসাবে কাজ করে।
আসলে ভারত নয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদী হয়তো সমস্যায় আছেন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে তিনি বারে বারে বলেছেন, যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়। ঘন ঘন আলোচনা করেছেন পুতিন ও জেলেনেস্কির সঙ্গে। তাঁর সেই তৎপরতাকে সাধুবাদ জানিয়ে হিন্দুত্ববাদী শিবির থেকে তাঁকে শান্তিতে নোবেল দেওয়ার দাবি ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, চলতি দফায় ভারতকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে উন্নীত করার সংকল্প ঘোষণা করেছেন তিনি। যুদ্ধ তাতে বড় বাধা হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। এমনীতেই অর্থনীতি দৌদুল্যমান। হয়তো সেই কারণেই হিন্দুত্ববাদী শিবিরের তথাকথিত অতি দেশপ্রেমী নেতারা এবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অতীতের মতো ততটা সরব নন।
সমাজমাধ্যমে যে মানুষ যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে তারা দেশের অতিক্ষুদ্র অংশ। তবে যুদ্ধ বিরোধীরাও চান পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হোক। সেটা কীভাবে সম্ভব নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই কোনও পথ বের করবেন। কিন্তু তার আগে জরুরি সরকারের তরফে হামলা, ২৬জন নিরীহ নাগরিকের জীবন রক্ষা করতে না পারার দায় নেওয়া, ব্যর্থতার জন্য দেশবাসীর উদ্দেশে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাওয়া, জবাবদিহি করা।