শেষ আপডেট: 19th November 2023 15:34
অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারণে ৬ ডিসেম্বর তারিখটি স্বাধীন ভারতে এক কলঙ্কময় দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বুধনি মেঝানের মৃত্যু সংবাদের সূত্রে জানা গেল, ১৯৫৯-এর ওই দিনেই যাত্রা শুরু করেছিল পাঞ্চেত জলাধার। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মঞ্চে ডেকে নিয়েছিলেন আদিবাসী কিশোরী বছর পনেরোর বুধনিকে। হাতল টেনে জলাধার ও বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করার জন্য কিশোরীকে এগিয়ে দেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ডিভিসি কর্তৃপক্ষ মঞ্চের নিচে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে প্রকল্পের ঠিকা শ্রমিক বুধনিকে নির্বাচন করেছিল। নেহরু তাঁকেই ডেকে নিয়েছিলেন মঞ্চে।
দেশ জুড়ে তখন এমন অসংখ্য প্রকল্প মাথা তুলছে, নেহরু কথায় ‘ভারতের নতুন মন্দির’। রাউলকেলা, ভিলাই, দুর্গাপুরে স্টিল প্ল্যান্ট, চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ কারখানা, পেরাম্বুর কোচ ফ্যাক্টরি, সিন্দ্রির সার কারখানা, ভাকরা নাঙ্গল, হীরাকুদ, দামোদর, কোসি, তুঙ্গভদ্রা, সর্দার সরোবরের মতো সেচ ও বিদ্যুতের বহুমুখী প্রকল্প, তারাপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র— যেন এক একটি তীর্থস্থান। জল-জঙ্গলের দীর্ঘ রুক্ষ পথে হেঁটে মানুষ ছোটে ভারত নির্মাণ চাক্ষুষ করতে। সুনীল দাত্, আশা পারেখ অভিনীত হাম হিন্দুস্থানী সিনেমার মুকেশের গলায় ‘ছোড়ো কাল কি বাঁতে, কাল কি বাত পুরানি, নয়ে দৌড় মেঁ লিখেঙ্গে মিল কে নয়ি কাহানি, হাম হিন্দুস্থানী’, গানটি যেন সেই ভারতের আর এক জাতীয় সঙ্গীত।
সেই উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে ঘিরে বুধনি মেঝানের মর্মান্তিক কাহিনি তাঁর মৃত্যু সংবাদের সঙ্গে আরও একবার সামনে এসেছে। নেহরুর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, তাঁকে মালা পরানো মেনে নেয়নি আদিবাসী সমাজ। সমাজচ্যুত বুধনি আর ফিরতে পারেননি নিজের গ্রাম কারবোনায়। গ্রামের মুরুব্বিদের বিধান ছিল, মঞ্চে নেহরুর গলায় মালা পরানোর বুধনির আসলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আর নেহরু যেহেতু আদিবাসী নন, তাই বুধনিকে সমাজ আর গ্রহণ করবে না। অনেক পরে বিয়ে এবং স্থানীয় নেতাদের বদান্যতায়, প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নির্দেশে ডিভিসি-তে চাকরি মেলে বুধনি মেঝানের।
বুধনিকে নিয়ে আদিবাসী সমাজের সেই বিধান কি শুধুই কুসংস্কার ছিল, নাকি একই সঙ্গে ছিল চলমান উন্নয়ন যজ্ঞের প্রতি প্রতিবাদ। বঞ্চনা, শোষনের শিকার আদিবাসীরা শত শত বছর ধরে উচ্চবর্ণের প্রতি এভাবেই তাদের প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে, যেখানে সমুষ্টির উপরে ব্যক্তির স্থান নেই। ডিভিসি-র প্রকল্প সেচ ও বিদ্যুতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল সন্দেহ নেই। সেই প্রাপ্তির জন্য বাস্তুহারা হতে হয়েছিল শত শত আদিবাসী পরিবারকে। প্রকল্প চালুর পরবর্তী অভিজ্ঞতা ছিল আরও ভয়াবহ। প্রতি বর্ষায় হাজার হাজার আদিবাসী গ্রাম জলে ডুবে যাওয়া শুরু হল।
১৯৯৯-এ ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যামস-এর কাছে পেশ করা ‘ড্যামস, ডিসপ্লেসমেন্ট, পলিসি অ্যান্ত ল’ ইন ইন্ডিয়া’ রিপোর্টে হর্ষ মান্দার, বিজয় নাগরাজরা দেখিয়েছেন, ডিভিসি-র পাঞ্চেৎ ও মাইথন বাঁধের জন্য স্থানীয় আদিবাসীদের ৫৬ শতাংশকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল। হতে পারে, এই সত্য জানা থাকাতেই ডিভিসির কর্তারা বুধনিকে পাঞ্চেতের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে আদিবাসী মন জয়ের দূরহ চেষ্টা করেছিলেন। ফল হয়েছিল উল্টো। কারণ, দেশজুড়ে তখন উন্নয়ন যজ্ঞের বলি হচ্ছে জনজাতিরা। ১৯৯৯-তেই যোজনা কমিশন একটি রিপোর্টে জানায়, স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরে বৃহৎ প্রকল্পের জন্য পাঁচ কোটির বেশি মানুষকে বাস্তুহারা হতে হয়েছে, যাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যায়নি।
সেই ভারত বদলায়নি। পাঁচ রাজ্যের চলমান বিধানসভা ভোটের চারটি—রাজস্থান, ছত্তীসগড়, মধ্যপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানার আদিবাসী এলাকায় মূল ইস্যু উন্নয়ন প্রকল্প ঘিরে উচ্ছেদের প্রতিবাদ। বস্তুত ভারতে কোনও নির্বাচনেই এখন এই ইস্যু বাদ থাকে না। যদিও জমানা নির্বিশেষে উচ্ছেদ চলতেই থাকে। গুজরাতে নর্মদার তীরে সর্দার প্যাটেলের বিশাল মূর্তিটির পাশে দাঁড়িয়ে কান পাতলে অদূরে জমিহারা আদিবাসী মহল্লার কান্না, প্রতিবাদ কানে আসবে। ছত্তীসগড়, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানার বিস্তীণ এলাকাতেও একই কাহিনি, যেখানে মাওবাদীরা আদিবাসীর অধিকারকে সামনে রেখে খুনের রাজনীতি কায়েম করেছে। সরকার এবং মাওবাদীদের জাঁতাকলে প্রাণওষ্ঠাগত জনজাতিদের। রাষ্ট্রপতি জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ, এই তাদের জন্য একমাত্র সান্তনা। ঘটনাচক্রে বুধনি মেঝান আর দ্রৌপদী মুর্মু, দু’জনেই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ।
তবে নেহরুর ভারতের সঙ্গে আজকের উন্নয়ন যজ্ঞের বিস্তর ফারাক আছে। আজকের ভারতের উন্নয়ন কর্মসূচিতে রাষ্ট্র, জনগণ গৌন, ব্যক্তি বিশেষ, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থই মুখ্য। ‘রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দূর হটো’ এটাই যেন রাষ্ট্রের অনুচ্চারিত ঘোষণা। সেগুলি বন্ধ অথবা বিক্রির উদ্যোগ চলছে জোরকদমে।
সেই ভারতে নেহরু যে প্রকল্পগুলিকে দেশের নতুন মন্দির বলে উল্লেখ করেছিলেন সেগুলির মালিকানা সব অর্থে ছিল দেশবাসীর। বিদেশের সহায়তা দেশকে স্বাবলম্বি করে তোলার পথে এগোচ্ছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তাঁর অকাল মৃত্যু দেশের জন্য কত বড় অপূরণীয় ক্ষতি ছিল, মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই দেশবাসী তা টের পেয়েছে। আরও অন্তত এক দশক তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলে ভারত আরও অনেক দূর এগিয়ে যেত সন্দেহ নেই।
বুধনি মেঝানকে ডিভিসি-র কর্তারা ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনার জন্য। নেহরু সেই কিশোরীকে দিয়েই পাঞ্চেত জলাধারের উদ্বোধন করিয়ে উন্নয়ন যজ্ঞে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করার বার্তা দিয়েছিলেন। আজকের ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় স্থানীয় রাস্তাঘাট, ছোট্ট সেতু, জল প্রকল্প, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল-কলেজ, বাড়িতে, মহল্লায় পানীয় জল, বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রকল্পেরও রিমোটে শিলান্যাস, উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা। প্রকল্পের রূপকার পঞ্চায়েত, পুরসভার জনপ্রতিনিধি এমনকী বিভাগীয় মন্ত্রীদের পর্যন্ত কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দিতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাততালি দেওয়া। এভাবেই বিকেন্দ্রীকরণের বিপরীত মুখে হাঁটা শুরু করেছে স্বাধীনতার ৭৫ পেরনো ভারত।
দুয়ারে লোকসভা ভোট। রাজ্যে রাজ্যে ‘দুয়ারে প্রশাসন’ জাতীয় চমকপ্রদ কর্মসূচির দেখাদেখি ভারত সরকারও ১৫ নভেম্বর বীরসা মুন্ডার জন্মদিনে চালু করেছে ‘বিকশিত ভারত সংকল্প যাত্রা।’ মোদী সরকারের রথ দেশের কোণায় কোণায় গিয়ে শোনাবে সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি। উন্নয়ন, দেশ কল্যাণ এখন দেশের প্রগতি ছাপিয়ে অনেক বেশি নির্বাচনমুখী। এই ভারতে যা কিছু ভালর কৃতিত্ব একজনের। বহুত্ববাদকে পিষে মারার সবচেয়ে বড় আয়োজনটি এখন সরকারি প্রকল্পের শিলান্যাস, উদ্বোধন। বিরোধীরা দূরে থাকে, দলের আঞ্চলিক নেতা-মন্ত্রীরও সেখানে ব্রাত্য। বুধনি মেঝানরা আর শিলান্যাস, উদ্বোধনে ডাক পান না। ঘরে বসে টিভিতে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর বোতাম টিপে প্রকল্পের শিলান্যাস, উদ্বোধন লাইভ দেখাই এখন দস্তুর।