প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও রতন টাটা।
শেষ আপডেট: 10th October 2024 09:58
অমল সরকার
দিনটা ছিল ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৮। দেবীপক্ষ শুরু হয়ে গিয়েছে। দুয়ারে দুর্গা পুজো। বাংলা ও বাঙালির সেরা উৎসবের এমন আবহে দুঃসংবাদ দিলেন রতন টাটা। কলকাতায় টাটা গ্রুপের হোটেল তাজ বেঙ্গলে এক সন্ধায় সাংবাদিকদের ডাকলেন রতন টাটা। কী বলতে পারেন ধারণা করা যাচ্ছিল। আমরা তবু ছুটলাম শহরের একপ্রান্তের ওই সাত তারা হোটেলে। রতন টাটা বললেন সিঙ্গুর থেকে ন্যানো কারখানা গুটিয়ে নিচ্ছে টাটা মোটরস। তিনি তখন টাটাদের মূল প্রতিষ্ঠান টাটা সনসের চেয়ারম্যান।
মাঝে কেটে গিয়েছে ১৬টি বছর। বুধবার সেই পুজো শুরুর মুখেই চলে গেলেন রতন টাটা। ঠিক একমাস আগে অগাস্টের আট তারিখ চলে গিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিঙ্গুরের ন্যানো গাড়ির কারখানার স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ দুটি এক মাসের ব্যবধানে চলে গেলেন।
সিঙ্গুর থেকে চলে যাওয়ার কথা রতন টাটা যেদিন জানালেন কারখানা ততদিনে আশি শতাংশ শেষ। রতন টাটা ঘোষণা করেন, 'চূড়ান্ত অসহযোগিতার মুখে কারখানা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলাম।' ইঙ্গিত করেছিলেন, কারখানা ঘিরে থাকা তৃণমূলের অবরোধকে। দফায় বৈঠক, রাজ্যপালের মধ্যস্থতাতেও সমাধান না মেলায় একটা সময় হাত গুটিয়ে নেন বুদ্ধদেবও।
কারখানা গুটিয়ে টাটারা চলে যায় গুজরাতের সানন্দে। সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তখন আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পরে দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দেখে বলেছিলেন, 'ভাববেন না আমি বাংলা থেকে টাটাদের ভাঙিয়ে এনেছি। বাংলায় সমস্যা হচ্ছিল দেখে ওরা বিকল্প জায়গা খুঁজছিল। আমি দিল্লি থেকে খবর পেয়ে ওদের আমার রাজ্যে আসতে বলি।' পরে জানা যায় মোদীকে খবরটা দেন কংগ্রেস নেতা আহমেদ প্যাটেল। তিনি তখন সনিয়া গান্ধীর পলিটিক্যাল সেক্রেটারি। নিজের রাজ্য গুজরাতে টাটাদের গাড়ি কারখানা হোক চেয়েছিলেন এই কংগ্রেস নেতা। তাই বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী মোদীকে খবরটা দিয়ে বলেছিলেন রতন টাটার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
বাংলার কংগ্রেস অবশ্য তখন তৃণমূলের জমি আন্দোলনের পাশে। সিঙ্গুরের কারখানা আটকাতে তারাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনকে সমর্থন করে।
বাংলায় টাটাদের গাড়ি কারখানা নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন ২০০৬-এর বিধানসভা ভোটের আাগেই টাটাদের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলেন। গাড়ি শিল্পকে বেছে নেওয়ার কারণ, স্বাধীনতার ঠিক পরে হিন্দমোটর্সে হয়েছিল বিড়লা গাড়ি কারখানা। জনপ্রিয় ভারতীয় গাড়ি অ্যাম্বাসাডর তৈরি হত সেখানে। সিঙ্গুরে টাটারা আসার আগে বিড়লাদের কারখানা মৃতপ্রায় বলা যায়।
সেবার বিধানসভার ভোটের ফল বেরিয়েছিল ১৩ মে। ২৩৫ আসন নিয়ে ক্ষমতায় টিকে যায় বামফ্রন্ট। ১৮ মে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তৃতীয়বারের জন্য শপথ নেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেদিনই বিকালে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের রাজ্য দফতরে বুদ্ধদেববাবু সাংবাদিকদের বললেন, :সন্ধায় পারলে রাইটার্সে থাকবেন। একজন অতিথি আসছেন।' সাংবাদিকেরা নাম জানতে চাইলে বুদ্ধদেববাবু শিশুর মতো সরল হাসিমুখে বললেন, 'এখন বলব না। সাসপেন্স থাক।' আমরা রাইটার্সে অপেক্ষায় রইলাম।
সন্ধায় রতন টাটা এলেন রাইটার্সে। ওদিকে নতুন সরকারের শপথ উপলক্ষে রাজভবন সন্ধায় উন্মুক্ত করে দিয়েছেন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। রাজভবনের লনে বসেছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর।
রতন টাটা চলে যেতে বুদ্ধদেববাবু বললেন, 'উনি বাংলায় শিল্প করতে চান। আমরা বলেছি সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে। উনি চান, শিল্পে বাংলা ঘুরে দাঁড়াক। আর আমরা কবে থেকেই বলছি সে কথা।' বামফ্রন্ট সরকারের তখন স্লোগান হল, 'কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ।'
এক-দু'দিন পর জানা গেল টাটারা গাড়ি কারখানা করবে। জানা গেল কারখানা হবে সিঙ্গুরে।
সেই কারখানা নিয়ে বিবাদ বাঁধল গোড়াতেই, জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আন্দোলনের রাশ নিজের হাতে নেওয়ার পর টাটার কর্ণধার বলেছিলেন 'কপালে বন্দুক ঠেকালেও সিঙ্গুর ছেড়ে যাব না।' আর বুদ্ধদেব আশ্বাস দিয়েছিলেন, টাটাদের কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু জমি আন্দোলন এবং তৃণমূলের ন্যানো কারখানা অবরোধকে কেন্দ্র করে এমন পরিস্থিতি তৈরি হল যে দু'জনের কেউই কথা রাখতে পারলেন না।