বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ এক নয়
শেষ আপডেট: 25th August 2024 18:09
অমল সরকার
গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচনের দিন আমি ঢাকায় ছিলাম। ও দেশে ভোট শেষে বুথেই গণনা হয়ে থাকে। বিএনপি ভোট বয়কট করায় ফলাফল জানাই ছিল। শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। সেই রাতে ঢাকার একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল, যারা তখন কিঞ্চিৎ সরকারপন্থী বলে পরিচিত ছিল, তাদের টক-শো’তে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভোট কেমন হল এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়শি দেশের সাংবাদিক হিসাবে আমি কী ভাবছি।
আমি বলেছিলাম, নির্বাচন কমিশনের দাবি মতো ৪০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়ে থাকলেও (অভিযোগ, প্রকৃত সংখ্যা ছিল অনেক কম) বাকি ৬০ শতাংশ ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। বিএনপি-সহ বিরোধীরা ভোট বয়কট করে। আবার আওয়ামী লিগেরও বহু মানুষ দল ও সরকারের উপর বিতশ্রদ্ধ হয়ে ভোট দিতে যাননি।
টক শো’য়ে আমি বলি কোনও দল বা নেতার ছত্রছায়ায় না থাকা এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যে কোনও সময় ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে যুব সমাজ, যাদের ভোটের লাইনে দেখাই গেল না। আমি আরও বলি এই পরিস্থিতির সুযোগ নেবে সাম্প্রদায়িক শক্তি।
পরদিন বিকালে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসে বিদায়ী বিদেশমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বিদেশি কূটনীতিক ও সাংবাদিকদের চা-চক্রে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানে আওয়ামী লিগের কয়েকজন সদ্য নির্বাচিত সাংসদও ছিলেন। তাঁরা এবং কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি কূটনীতিক আমাকে বললেন, টক শো’য়ে আপনি যথার্থ বলেছেন। নেতৃত্বহীন ছাত্র-যুব-জনতা আগামী দিনে বিপদের কারণ হতে পারে।
সত্যি কথা বলতে কী, আমি তাই বলে ভাবিনি মাত্র ছয়-সাড়ে ছয় মাসের মাথায় বাংলাদেশে এত বড় কাণ্ড ঘটে যাবে। দেশ ছাড়তে হল মাত্র কয়েক মাস আগে শতকরা শতভাগ আসনে জয় হাসিল করা শেখ হাসিনাকে।
আরজি কর হাসপাতালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরোধীদের আন্দোলন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় গোড়া থেকেই অভিযোগ করে আসছেন, পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশ করার চেষ্টা হচ্ছে। ২৭ তারিখ ছাত্র-যুব সমাজের নামে নবান্ন অভিযানের ডাক ঘিরে রাজ্য প্রশাসন চিন্তিত। অভিযানের ডাক যাঁরা দিয়েছেন তাঁদের পরিচয় স্পষ্ট নয়। বাম ছাত্র-যুব সংগঠনগুলি জানিয়েছে, তারা এই অভিযানে নেই।
অন্যদিকে, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ক’দিন ধরেই ঝাণ্ডাবিহীন নবান্ন অভিযানের কথা বলে আসছিলেন। ঝাণ্ডাবিহীন মানে দলীয় বা সাংগঠনিক পতাকার পরিবর্তে হাতে হাতে লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা থাকবে। রাজনীতি করার জন্য যা দলীয় পতাকার থেকেও শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছে সাম্প্রতিক কিছু জন আন্দোলনে।
বাংলাদেশে আন্দোলনকারীদের হাতে হাতে জাতীয় পতাকা ছিল। মাথা, কপালেও ছিল লাল-সবুজ পতাকা। সে দেশের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ৫ অগাস্ট দেশবাসীকে ঢাকা চলে আসার ডাক দিয়েছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাজধানীতে জড়ো হওয়া মানুষকে দিয়ে গণভবন অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর অফিস-বাড়ি এবং অন্যান্য সরকারি ভবনগুলি ঘিরে ফেলা। যাতে চাপের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।
ঢাকায় এবং অন্যত্র ছাত্রদের প্রকাশ্যে ঘোষিত চিত্রনাট্য মেনেই যা হওয়ার হয়েছে। হাসিনার দেশত্যাগের কৃতিত্ব বিরোধীরা ছাত্রদের দিয়েছে। যদিও পরবর্তী পনেরো-কুড়ি দিনের ঘটনাবলী থেকে স্পষ্ট, হাসিনার পতন নিশ্চিত করতে সংঘঠিত গণঅভ্যত্থানটি মোটেই স্বতঃস্ফুর্ত ছিল না, বরং ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত। পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রীর সময়ের অনাচার, ভোটাধিকার এবং বাক-স্বাধীনতা হরণ এবং জিনিসপত্রের আকাশ ছোঁয়া দাম ও সীমহীন দুর্নীতির কারণে মানুষের ক্ষোভ চরমে উঠেছিল। সেই পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়া হয়েছে মাত্র।
যে কোনও অপশাসনের অবসানে সামনে একটি বা দুটি ইস্যু মারণাস্ত্র হিসাবে কাজ করে বটে, তবে কম-বেশি সব জন-আন্দোলনই আসলে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। আরজি করের ঘটনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হওয়া আন্দোলনও তার ব্যতিক্রম নয়। তেরো বছর ক্ষমতাসীন তৃণমূল দল ও সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ-অসন্তোষ স্বাভাবিক। কোনও একটা ভোটের ফল দিয়ে তা মাপা যায় না। মাত্র তিন মাস আগে অনুষ্ঠিত লোকসভা ভোটে জোড়াফুলের বিপুল সাফল্যের সঙ্গে চলতি জন-আন্দোলনের কোনও বিরোধ নেই। লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচনে ভোটদানের ক্ষেত্রে অনেক রকম অঙ্ক কাজ করে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে তুমুল ক্ষোভ-বিক্ষোভ সত্ত্বেও দেশের নতুন সরকার গঠনের প্রশ্নে বাংলার মানুষ বিজেপির পরাজয় চেয়েছিল। যদিও তাতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে বলা যাবে না।
তাপরপরও বলব, বাংলাদেশের ঘটনাবলী এপারের আন্দোলনকে বাড়তি মাত্রা দিয়ে থাকলেও দুই পারের পরিস্থিতির গুণগত ফারাক আছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে পঞ্চায়েত-পুরসভার ভোটে কারচুপির অভিযোগ থাকলেও লোকসভা ও বিধানসভার ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। তেমন ভোটের জন্য বাংলাদেশকে অনেক পথ পেরতে হবে। ২০২১-এর বিধানসভা এবং ২০২৪-এ লোকসভা ভোট নিয়ে কোনও দলই কারচুপির অভিযোগ তোলেনি। আসলে তৃণমূলের শত অপরাধ সত্ত্বেও বিরোধীরা তাদের জায়গা তৈরি করতে পারেনি।
বাংলাদেশের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে এপার বাংলার মিল আছে। ওপারে সাবেক শাসক দল বিএনপি প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লিগের সামনে কখনও কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি। তার একটি কারণ, দলের চেয়ারম্যান খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় জেলবন্দি থাকায় বহু বছর রাজনীতির ময়দানে অনুপস্থিত। তাঁর পুত্র বিএনপি-র কার্যনির্বাহী সভাপতি তারেক জিয়া বহু বছর লন্ডন প্রবাসী। আওয়ামী লিগের মতো বিএনপি-ও একটি পরিবারের হাতে কুক্ষিগত। খালেদা এবং তারেকের পর দ্বিতীয় কোনও নেতার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই।
শেখ হাসিনার বিগত চারবারের জমানার একচ্ছত্র শাসনে বিরোধী শূন্যতাই ছিল সবচেয়ে বড় সুযোগ, যা ক্রমে বিপদে পর্যবসিত হল। এপারে প্রধান বিরোধী দল বিজেপির বিএনপি-র দশা এবং বাম-কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হলে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে আম-জনতার নেমে পড়া অসম্ভব নয়। আরজি করের ঘটনায় প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্রীর ডাকে রাত দখলের আন্দোলন যতটা প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা থেকে ততটাই বিরোধীদের প্রতি ভরসা হারানোর আভাস।
তারপরও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। পড়শি দেশে কোনও জমানাতেই নির্বাচন অবাধ হয়নি। দুই সেনা শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেন মহম্মদ এরশাদের সময়ে ভোট বলতে গেলে নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। খালেদা জিয়ার সময়ও তাই। ১৯৯৬ সালে তিনি স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতা দখল করে গণরোষের মুখে গদি ছাড়তে বাধ্য হন। সেখানে শেখ হাসিনা সব মিলিয়ে পাঁচবার এবং টানা চারবার ক্ষমতা দখল করেছেন। শেষের তিনবারের ভোট তাঁর শাসনাধীনে হয়েছে। ২০১৮-তে তো নির্বাচনের আগের রাতেই ভোট হয়ে গিয়েছিল, যে ঘটনা এপারে গত শতকের সত্তরের দশকে কংগ্রেস জমানায় হত।
জবরদস্তি জয় হাসিল, ক্ষমতা ধরে রাখার পাশাপাশি হাসিনার জমানায় দল ও দলীয় বৃত্তের বাইরে প্রতিবাদী মানুষকে গুম খুন, ডিজিটাল আইনে মানুষের কণ্ঠরোধ, 'আয়না ঘর' নামের গোপন কুঠুরিতে রেখে অত্যাচার, কথায় কথায় পুলিশ, র্যাবের হামলার ঘটনায় মানুষ একটা সময় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেও পরে সাহস করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলেন। পুলিশের গোলাগুলির মধ্যে আবু সাঈদ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শহিদ হওয়ার ঘটনায় স্পষ্ট মানুষ প্রতিবাদের মরণঝাঁপ দিয়েছিল।
শেখ হাসিনার সময়ে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নতি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। পদ্মা সেতু, ঢাকায় মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে স্পষ্ট তিনি উন্নয়নের একটি রোড-ম্যাপ নিয়ে এগোচ্ছিলেন। তাঁর সময়েই দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়। জিডিপি বৃদ্ধি এমনকী ভারতেও ছাপিয়ে যায়। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সারিতে উন্নীত হয় বাংলাদেশ। কিন্তু সেগুলির কোনওটাই বাক স্বাধীনতা, ভোটাধিকারের বিকল্প নয়।
করোনা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশকে আর্থিকভাবে যে বিপদের মুখে ফেলেছিল তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে না পারাও হাসিনার উপর ক্ষোভ বাড়ছিল। পেটে টান পড়লে মানুষও হিংস্র বাঘ হয়ে ওঠে। ক্ষুধার যন্ত্রণা তীব্র করে তোলে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি। আওয়ামী লিগের নেতা-মন্ত্রী এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা সরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্ক ইত্যাদি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুঠ করেছে। জানা যাচ্ছে, একজন ব্যবসায়ী একাই এক লাখ কোটি টাকা বেনামে ঋণ নিয়ে নিরুদ্দেশ। পুলিশের প্রাক্তন কর্তার বেআইনি সম্পত্তির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব বোর্ডের কর্তার পুত্র কুরবানির ইদে ১৬ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কিনে বুঝিয়ে দিয়েছে বাবার উপরি ইনকাম কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
বাংলাদেশের অনাচারের সব উপসর্গই পশ্চিমবঙ্গ শুধু নয়, দেশের সব রাজ্যেই কম-বেশি আছে। তবে তা বাংলাদেশের মাত্রায় নয়। দুর্নীতি, অনাচারের প্রশ্নে তৃণমূল শাসিত বাংলার বিজেপি শাসিত অসম এবং ত্রিপুরার কোনও ফারাক নেই।
তারপরও বলব, বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ এক নয়। বিগত তেরো বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ গুলি চালিয়ে গণ্ডায় গণ্ডায় মানুষ মারেনি। দুর্নীতির পরিধি এবং চরিত্রও আলাদা। বাক্ স্বাধীনতা হরণের ভূরি ভূরি অভিযোগ থাকলেও হাসিনা জমানার সঙ্গে তা তুলনীয় নয়। ফলে পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশ বানানো আপাত ভাবে সহজ নয়। বিজেপি হয়তো চাইছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২১ জুলাইয়ের বিপরীতে একটা ২৭ অগাস্ট সংঘঠিত করতে।
তবে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ এক না হলেও পড়শি দেশের ঘটনাবলী থেকে সব শাসকেরই শিক্ষা নেওয়ার আছে। বাংলাদেশে ছাত্ররা যে এমন ইতিহাস ঘটিয়ে ফেলবে কে ভাবতে পেরেছিল? পশ্চিমবঙ্গে এক তরুণীর রাত দখলের আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে দল নির্বিশেষে মানুষ পথে নেমে আসবে, বিরোধীরাও ভাবতে পেরেছিল কি?