শেষ আপডেট: 14th September 2024 20:46
গত লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের দিন কয়েক পর সীতারাম ইয়েচুরির মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কলকাতায় সিপিএমের রাজ্য সদর দফতরের চারতলায় পার্টির ভোট পর্যালোচনা বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সিঁড়ি ভেঙে উঠে হাঁফাচ্ছিলেন। চোখমুখে কষ্টের ছাপ। এক সাংবাদিক বন্ধু সীতারামকে দেখে আমাকে বললেন, ইনিও আর এক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দু’জনেরই দেদার ধূমপান এবং শ্বাসকষ্ট প্রসঙ্গে বলেছিলেন কথাটি বলেছিলেন সেই সাংবাদিক বন্ধু। এক মাসের ব্যবধানে দু’জনেই চলে গেলেন।
সেদিন সীতারাম থাকবেন বলেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল না, মুখ চেনা সম্পর্ক ছিল বলা চলে। উনি কলকাতায় এলে সাংবাদিক বৈঠক, আলোচনা সভায় আমি যাওয়ার চেষ্টা করতাম। এমন অনেক সভাতেই বয়স্ক এবং সক্রিয় সাংবাদিকতা থেকে বসে যাওয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা হত। কারণ, তাঁরাও সীতারামের কথা শুনতে যেতেন। রাজনীতির কথা বলতেন একেবারে ক্লাসরুমের জনপ্রিয় শিক্ষকের পড়ানোর ঢঙে। যে গুণটা জ্যোতি বসুর ছিল। সীতারামের সাংবাদিক বৈঠকও ছিল সমসাময়িক নেতা-নেত্রীদের থেকে আলাদা। সাংবাদিকের মর্যাদা, সম্মান রক্ষা করে নিজের বক্তব্য পেশ করতেন। অপ্রিয় প্রশ্নে বিরক্ত হতেন না।
সীতারামকে নিয়ে আমার বাড়তি কৌতূহলের সূত্রপাত নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয় শতবার্ষিকী ভবনে সিপিএম অথবা পার্টির মুখপাত্র গণশক্তি আয়োজিত একটি সভায়। সীতারাম মূল বক্তা। ততদিনে তিনি পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য। যতদূর মনে পড়ে, সেদিন সীতারাম গাড়ি থেকে নামতে গৌতম দেব রসিকতা করে বললেন, ‘এই যে রাম-সীতা, দিল্লি বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছো। আর আমরা এখানে সরকারে থেকেও মাঠে-ময়দানে ছুটে বেড়াচ্ছি।’ সীতারাম খানিক বাংলা বুঝতেন। দূরন্ত জবাব দিলেন, ‘পার্টিকে বলো, আমাকে বাংলায়, তোমাকে দিল্লিতে ট্রান্সফার করে দিতে।’
সেই সভায় আমার সঙ্গে কাগজের লেফট বিট অর্থাৎ নিয়মিত বাম শিবিরের খবর করেন এমন দু’জন পোড়খাওয়া সাংবাদিক প্রয়াত দেবাশিস ভট্টাচার্য, শ্রদ্ধেয় শুভাশিস মৈত্র ছিলেন। তবে অ্যাসাইনমেন্ট ছিল আমার, তাঁরা গিয়েছিলেন সীতারামের ভাষণ শুনতে।
সভা শেষ হতে দুই জেষ্ঠ সাংবাদিক আমাকে বললেন, খবরের মাথা কিন্তু হবে সীতারামের শেষের কয়েকটি লাইন। আমি নোটবই খুলে দেখে নিলাম কী বলে শেষ করেছেন সীতারাম। বলেছেন, ভারতের সমাজ ব্যবস্থায় জাত ও শ্রেণি-সংঘাত এক-অপরের সঙ্গে মিশে আছে। কথাটির রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব আমার তেমন বোধগম্য হয়নি। দেবাশিস ও সুভাশিসদা বুঝিয়ে দিলেন। পরদিন সেই মতো খবর প্রকাশিত হল।
শুনলাম, খবরটি সাড়া ফেলেছে বাম মহলে। কারণ দুটি। এক. ওই পয়েন্টটি দিয়ে বাকি কাগজ খবর করেনি। দুই. কমিউনিস্ট পার্টির ব্যবহারিক রাজনীতির থেকে কথাটি আলাদা। মোদ্দা কথা, জাত আর শ্রেণিকে আলাদা দৃষ্টিতে না দেখে দেশিয় বাস্তবতা মেনে দলিত, আদিবাসী-সহ জাতিগত পরিচিতির কারণে পশ্চাৎপদ অংশের কথা বলতে হবে। সিপিএমের পত্র-পত্রিকা যাই বলুক, পার্টির রাজনীতির মধ্যে তা ছিল না। বামফ্রন্ট সরকার তো আটের দশকের গোড়ায় মণ্ডল কমিশনকে বলেছিল, বাংলায় ওবিসি বা অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণি বলে কিছু নেই।
এর কয়েক বছর পর ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা সূত্রে সীতারামের বিশ্ববিদ্যালয় শতবার্ষিকী হলের ভাষণের কথা মনে পড়ল। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার ড. সব্যসাচী সেন একদিন তাঁর ঘরে ডেকে বললেন, সীমান্তবর্তী ব্লকগুলিতে কয়েক বছর ধরে ভোটার অস্বাভাবিক হারে বাড়ছিল। এবার আমরা নতুন করে তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছি। তালিকায় বনগাঁ, বাগদার নাম আছে। পারলে ওখানে গিয়ে খোঁজখবর করতে পারো, ব্যাপারটা কী। আমি বললাম, আপনি তো সব জানেন। বলুন না কী ব্যাপার। ড. সেন বললেন, আমি জানি, তবু আমি চাইছি সাংবাদিকরা খোঁজ করুক। দেখি জেলা প্রশাসনের রিপোর্টের সঙ্গে তোমাদেরটা মেলে কিনা।
আমি পরদিনই বনগাঁ, বাগদা ছুটলাম। দুই বিডিও-ই বললেন, হাজার হাজার দরখাস্ত বাতিলের পরও এই অবস্থা। ওপার থেকে আসা মানুষ ভোটার হতে চাইছেন। দরখাস্তকারীরা মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। সেই প্রথম মতুয়া কথাটি শুনলাম। এলাকায় কথা বলে জানলাম, অপার থেকে আসা লোকেদের আর আগের মতো সহজে ভোটার তালিকায় নাম তুলতে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ, দমদম আর কৃষ্ণনগর লোকসভা পর পর দু’বার বিজেপি জেতায় উদ্বাস্তুদের সিপিএম সন্দেহের চোখে দেখছে।
মতুয়াদের নাগরিকত্ব, ভোটার তালিকায় নাম তোলা নিয়ে সমস্যা, প্রশাসন ও সিপিএমের বক্তব্য-সহ খবর প্রকাশিত হল। পরদিন কেউ কেউ বললেন, এর আগে এই বিষয়ে কলকাতার প্রথমসারির মিডিয়ায় লেখালেখি হয়নি। আমার মতোই মতুয়া সম্প্রদায়ের কথা অনেকেই প্রথম শুনলেন।
দেশভাগের পর মতুয়াদের বড় অংশই এপারে আসেননি। অপারে তারা মুসলিমদের সঙ্গেই সুখে থাকবেন ভেবেছিলেন। কারণ, দেশভাগের আগে বর্ণ হিন্দু জোতদার, জমিদারেরা গরিব মুসলিম এবং নমশূদ্রদের উপর জোর-জুলুম করত। দেশভাগের পর এপারে উদ্বাস্তুদের সংঘঠিত করে বামদলগুলি বাংলার ভোট-রাজনীতিতে বাজিমাৎ করে। আবার তাদের বিরুদ্ধেই মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তুদের উপর নিপীড়নের অভিযোগে উত্তাল হয়েছে রাজ্য-রাজনীতি। মরিচঝাঁপিতে নিপীড়নের শিকার সেই উদ্বাস্তুরাও ছিলেন মূলত তফসিলি সম্প্রদায়ের সর্বহারা মানুষ। সিপিএম তথা বামফ্রন্ট সরকার এই দিকটি উপেক্ষা করেছে।
তারপরও সিপিএমের সঙ্গে তফসিলিদের সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটেনি। ৩৪ বছরের বাম শাসনের পিছনে এই সম্প্রদায় ছিল অন্যতম সহায়ক শক্তি। তবে সেই সম্পর্ক ছিল পার্টি সংগঠনের জোরে। পশ্চাৎপদ অংশ, তা সে তফসিলি জাতি কিংবা আদিবাসী, ওই অংশের মানুষের চাহিদার সঙ্গে নেতারা পার্টির রাজনীতিকে মেলাতে পারেননি। নানা বিষয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ জ্যোতি বসুও এই ব্যাপারে মাথা ঘামিয়েছেন বলে শোনা যায়নি।
বাম সরকারের দীর্ঘদিনের শিক্ষা ও উদ্বাস্তু কল্যাণ মন্ত্রী কান্তি বিশ্বাস এই ব্যাপারে বহু বার পার্টিকে পথ বদলের পরামর্শ দিলেও কেউ কানে তোলেননি। নেতৃত্বের প্রশ্নে পার্টি সংগঠনে তিনি নিজেও ছিলেন প্রান্তিক, অবহেলিত। আর কে না জানে, সিপিএমে নানাবিধ সমস্যার মূলে আছে তথাকথিত পার্টি কাঠামো ও শৃঙ্খলা, যা বহুক্ষেত্রে একপ্রকার আমলাতন্ত্র ও শৃঙ্খলে পর্যবসিত হয়েছে। এই দলের বেশিরভাগ নেতাই মানসিকতায় সিএজি’র অডিটরদের মতো। চালের টাকায় ডাল কেনা হলেই অনিয়ম বলে লালকালির দাগ দেওয়া চাই অডিটরদের। প্রয়োজনটা তাঁদের কাছে গুরুত্ব পায় না। এই ব্যাপারে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের মতো সীতারামও কতিপয় ব্যতিক্রমীর তালিকায় ছিলেন।
বয়সের বিস্তর ফারাক সত্ত্বেও জ্যোতি বসুর সঙ্গে সীতারামের গভীর সম্পর্ক ছিল। হয়তো সেই কারণেই কিংবদন্তী নেতার বাস্তববাদী রাজনীতির গুণটি সহজে আয়ত্ব করেছিলেন সীতারাম। বিজেপি ও কংগ্রেসকে মোকাবিলায় তৃতীয় ফ্রন্টের সরকার, আবার সময়ের দাবি মেনে হাত শিবিরের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার গঠনে অন্তরালে ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। জ্যোতি বসু, হরকিষেন সিং সুরজিতের মতো হয়ে উঠেছিলেন জোট রাজনীতির কোচ। সীতারামের অবদান এই ব্যাপারে তাঁর দুই পূর্বসূরির তুলনায় বেশি, কারণ তিনি সফল হয়েছেন যখন সংসদে, জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর পার্টি ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। এই ব্যাপারে সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষোভ। তিনি বারে বারে অভিযোগ করেছেন, চালচুলোহীন সিপিএমের নেতা সীতারাম ইন্ডিয়া জোটে ছড়ি ঘোরাচ্ছে।
সিপিএম-সিপিআইয়ের এই ভূমিকা, অবদান নতুন নয়। বাংলায় বামেদের ভোট বিজেপিতে চলে গিয়েছে। অথচ দুই কমিউনিস্ট পার্টিই জাতীয় স্তরে বিজেপির জয়যাত্রা বহু বছর আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছিল তাদের উদার জোট-রাজনীতি দিয়ে। ক্ষুদ্র শক্তি হয়েও ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, এবি বর্ধনদের মতো সিপিআই নেতারা অসামান্য অবদান রেখেছেন। বসু-সুরজিৎ পরবর্তী সময়ে সেই কাজটাই করেছেন সীতারাম।
নির্বাচনে হার-জিৎ স্বাভাবিক। ভোট, সাংসদ, বিধায়ক সংখ্যা, ক্ষমতায় থাকা না থাকা, এসবের বাইরে দলের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখাই প্রকৃত নেতার কাজ। সেই কাজে বিগত দেড়-দু’দশক কোনও দলের কেউ সীতারামের সমকক্ষ ছিলেন না। সিপিএমের খারাপ সময়ে তিনি দলকে প্রাসঙ্গিত রাখতে পেরেছিলেন। দুঃসময়ে সীতারামের চলে যাওয়া তাই দলের জন্য অনেক বড় শূন্যতা।
আগামী বছরের এপ্রিলে পরবর্তী পার্টি কংগ্রেস থেকে সিপিএমের নতুন সাধারণ সম্পাদক স্থির হওয়ার কথা। সময়ের দাবি মেনে সীতারামকে আরও এক দফা সাধারণ সম্পাদক রাখা হত কিনা তিনি প্রয়াত হওয়ায় সেই প্রশ্ন আর প্রাসঙ্গিক নয়। যিনি দায়িত্ব আসবেন, পার্টিকে প্রাসঙ্গিক রাখতে হলে সীতারামকে স্মরণে রেখে পা ফেলতে হবে তাঁকে। এই ব্যাপারে কেরল-বাংলা লড়াইয়ের অবকাশ নেই।