শেষ আপডেট: 4th February 2024 16:20
অমল সরকার
নরেন্দ্র মোদী ২২ জানুয়ারি রাম মন্দির উদ্বোধনের দিন অযোধ্যায় মিডিয়া সেন্টারের আড্ডায় এক প্রবীণ মারাঠি সাংবাদিক লালকৃষ্ণ আডবাণীকে নিয়ে আক্ষেপ করছিলেন। ‘আডবাণী বেঁচে থাকতে অন্য কারও হাত দিয়ে এই মন্দির উদ্বোধন ভাবাই যায় না,’ বলেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে যোগ করেছিলেন, ‘নরেন্দ্র মোদী কিছু একটা সান্ত্বনা পুরস্কার নিশ্চয়ই প্রবীণ নেতার জন্য ভেবে রেখেছেন।’ তিনিই সেদিন মনে করিয়ে দেন, আডবাণী ইতিমধ্যেই পদ্মবিভূষণ, অর্থাৎ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মানের অধিকারী। অতএব, বাকি শুধু ‘ভারতরত্ন’।
শনিবার প্রধানমন্ত্রী মোদী এক্স হ্যান্ডেলে আডবাণীকে দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান জ্ঞাপনের কথা ঘোষণা করা মাত্র আমার সেই মারাঠি সাংবাদিকের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। বানপ্রস্থে থাকা বিজেপি নেতার কেন ‘ভারতরত্ন’ সম্মান প্রাপ্য, তা নিয়ে যুক্তি সাজাতে গিয়ে তিনি সেদিন একপ্রকার একঘরে হয়ে চুপ করে যান। তাঁর যুক্তি ছিল, মোদী যে মন্দিরের উদ্বোধন করলেন সেটির আসল রূপকার আডবাণী। বাকিদের যুক্তি ছিল, আডবাণী বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারিগরদের একজন। নিম্ন আদালত অভিযুক্তদের নির্দোষ ঘোষণা করলেও পূর্ণাঙ্গ বিচার এখনও শেষ হয়নি।
রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদানে প্রাপকের গোটা জীবনের অবদান বিবেচনায় নেওয়া হয়। কোনও বিশেষ ঘটনা তাতে রেখাপাত করে না। রাজনীতির গুরু আডবাণীকে ভারতরত্ন সম্মানের জন্য নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যেমন বলেছেন, ‘জনজীবনে বহু দশক ধরেই কাজ করেছেন আডবাণীজি। তাঁর প্রতিটি কাজকর্মে ছিল অবিচল কর্মনিষ্ঠা, সার্বিক স্বচ্ছতা ও সততা। রাজনৈতিক মতাদর্শের ক্ষেত্রে এক বিশেষ মান অনুসরণ করে চলতেন তিনি। জাতীয় ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল অনবদ্য ও অতুলনীয়।’
যদিও বহু ক্ষেত্রে কিছু ঘটনাবলীই সাধারণ নাগরিকের চোখে বিশিষ্ট ব্যক্তির অন্যতম পরিচয় হয়ে ওঠে। লালকৃষ্ণ আডবাণী দেশের প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তাঁর এমন কোনও অবদানের কথা জানা নেই যা দেশ ও দেশের কল্যাণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। অনেকেই তাই মনে করেন, রাম মন্দির উদ্বোধনের পর নরেন্দ্র মোদী মন্দির আন্দোলনের পুরোধা প্রবীণ নেতাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে তুষ্ট করলেন।
মসজিদ ধ্বংসের দিনে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কল্যাণ সিং ‘করসেবকদের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেওয়া হবে না’ বলে যিনি সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিলেও ঘটনার দিন ছিল ভিন্ন ছবি। পুলিশ-প্রশাসনের চোখের সামনে সাড়ে পাঁচশো বছরের পুরনো কাঠামোটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গুড়িয়ে দেয় উন্মত্ত করসেবকেরা। তারপর হিন্দুত্ববাদীদের চোখে রাতারাতি বীরের মর্যাদা পাওয়া কল্যাণ দেশ পরিক্রমায় বেরিয়ে বলেন, ‘আগার কনট্রাকটর কো দিয়া যাতা তো ছহ মাহিনা লাগ যাতা থা। হামারে করসেবকো নে ছহ ঘণ্টা মে ধাঁচা (বাবরি মসজিদ) গিরা দিয়া।’
দু’ বছর আগে ভারত সরকার উত্তর প্রদেশের সেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে মরণোত্তর ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানজ্ঞাপন করেছে। অথচ, বাবরি ধ্বংসের ঘটনায় ভারত সরকারই কল্যাণের সরকারকে বরখাস্ত করেছিল, আদালতের চোখে যে ঘটনাটি ছিল চরম নিন্দনীয় অপরাধ। প্রয়াত কল্যাণকে পদ্ম-সম্মান প্রদানে সেই চরম অন্যায় রাষ্ট্রীয় মান্যতা পেয়ে গেছে কি না, এ প্রশ্ন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
বাবরি ধ্বংসের আগে মসজিদের জমিতে রাম মন্দির নির্মাণের দাবিতে আডবাণীর অযোধ্যামুখী রামরথ রাজনীতির অনেক অঙ্ক ওলটপালট করে দিয়েছিল। রথ-রাজনীতিতে তাঁর সাফল্যের রেকর্ড আজও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সেই তিনি বাবরি ধ্বংসের পর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মন্দির অবশ্যই চাই, কিন্তু মসজিদ ভাঙা হোক চাইনি।’
আবার মসজিদ রক্ষায় তাঁর কোনও প্রচেষ্টাও দেখা যায়নি। সেই সব দিনে বিজেপিতে কার্যত শেষ কথা হয়ে ওঠা আডবাণী চাইলে দলের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণকে নির্দেশ দিতে পারতেন পুলিশ-প্রশাসনকে সক্রিয় হতে বলতে। আডবাণী পারতেন, অযোধ্যার পরিস্থিতি সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে। এই আডবাণী হাওলা কাণ্ডে স্রেফ নাম জড়ানোয় নীতি-আদর্শের প্রতি আনুগত্যের কথা বলে ১৯৯৬-এর লোকসভা ভোটে লড়াই করেননি। এমন প্রায় বিরল, প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনের পর প্রত্যাশিত ছিল বাবরি ধ্বংস চাক্ষুষ করে আডবাণী রাজনীতি থেকেই অবসর নেবেন।
বিজেপির এই প্রবীণ নেতাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান জ্ঞাপনের ঘোষণায় কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কংগ্রেস সভাপতি খাড়্গে সরকারি সিদ্ধান্ত সমর্থনের পাশাপাশি বলেছেন, আডবাণীকে আরও আগেই এই সম্মান দেওয়া উচিত ছিল। কংগ্রেসের জাতীয় মুখপাত্র জয়রাম রমেশ এই অবকাশে আডবাণী ও মোদীর সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে চিমটি কেটেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতি কোন ভূমিকার জন্য বিজেপি নেতার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রাপ্য সে প্রশ্ন কংগ্রেস তোলেনি। আদবাণীর রামরথ ঘিরে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ, সংঘাত, হিংসা, বাবরি ধ্বংসের জেরে দেশব্যাপী দাঙ্গার ঘটনা তো আছেই, বিতর্কিত এনআরসি, সিএএ-র গোড়াপত্তনকারীও বিজেপির এই প্রবীণ নেতা।
কংগ্রেস না ঢুকলো সেই প্রসঙ্গে, না প্রশ্ন তুলল কেন মনমোহন সিংহের নাম সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানের জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে না, যিনি আর্থিক ও শিল্প ক্ষেত্রে আমুল সংস্কার করে দেশকে কয়েক কদম এগিয়ে দিয়েছেন। যাঁর সরকার খাদ্য, শিক্ষা, তথ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং যে মানুষটিকে আর্থিক, রাজনীতিক, কোনও কলঙ্কই স্পর্শ করতে পারেনি। এই ব্যাপারেও কংগ্রেস আসলে গান্ধী পরিবারের বাইরের কারও নাম ভাবতে অভ্যস্ত নয়।
আসলে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদানের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার কংগ্রেস অনেক আগেই হারিয়েছে। জওহরলাল নেহরু ও তাঁর কন্যা ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নিজেরাই নিজেদের ‘ভারতরত্ন’ ঘোষণা করেছেন। কাল নরেন্দ্র মোদী সেই তালিকায় নাম তুললে কংগ্রেসের প্রশ্ন তোলার নৈতিক অধিকার নিয়েই পাল্টা প্রশ্ন উঠে যেতে পারে।
নেহরু-গান্ধী পরিবারের তৃতীয় ‘ভারতরত্ন’ রাজীব গান্ধীকে মরণোত্তর এই সম্মান দিয়েছিল নরসিংহ রাওয়ের সরকার। আদবাণী, মোদীদের মতো প্রয়াত রাজীবের প্রতিও হিন্দুত্ববাদীদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ যিনি বাবরি মসজিদের তালা খোলার ব্যবস্থা করে মন্দির রাজনীতির রাস্তা প্রসস্ত করে দিয়েছিলেন। সেই রাজীব সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান পেতে পারলে নরসিংহ রাও-ও হয়তো বাদ থাকবেন না, বাবরি ধ্বংসের দিনে যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং মসজিদ রক্ষায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি।
প্রধানমন্ত্রী মোদী পূর্বসূরি অটল বিহারী বাজপেয়ীকেও ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত করেছেন। সেই বাজপেয়ী ১৯৯৬-এ ১৩ দিন সরকার চালনার পর সংসদে আস্থা ভোট বিতর্কে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন রাম মন্দির নির্মাণ-সহ দলের কোনও কর্মসূচির সঙ্গেই তাঁর কোনও বিরোধ ছিল না। বলেছিলেন, ‘ইয়ে বাত সহি হ্যায়, ছুপানে কা কৌ বাত নহি হ্যায়। ইয়ে হামারা ইস সময় কে কারিক্রম মে নহি হ্যায়। ইসলিয়ে নহি হ্যায়, কী হামারা পাশ বহুমত্ নহি হ্যায়।’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে বাজপেয়ী কী ভূমিকা নিতেন দেশবাসীর কাছে তা অজানাই রয়ে গেছে।
আডবাণীর রামরথে সওয়ার হননি বাজপেয়ী। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিনও অযোধ্যায় ছিলেন না। এই সব দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বিজেপির এই প্রতিষ্ঠাতা নেতা সম্পর্কে ‘উদারপন্থী’, ‘নরমপন্থী’ শব্দগুলি ব্যবহার হত। সেই ভাবমূর্তিও যে পার্টি নির্দেশিত সচেতন প্রয়াস, তা বোঝা যেত তাঁর ওই মন্তব্যে, ‘পার্টি নে মেরে উপর ইয়ে কর্তব্য সঁপা। আউর মুঝে উসকা পালন করনা হ্যায়।’
সেই তিনি বাবরি ধ্বংসের আগের সন্ধ্যায় লখনউয়ে করসেবকদের জমায়েতে বলেছিলেন, ‘করসেবা হবে, আটকানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, করসেবা করা যাবে। নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু পুজোর বেদি তো নির্মাণ করতেই হবে। আদালত বলেছে, ভজন কীর্তন করা যাবে। ভজন কীর্তন তো একা একা হয় না। অনেক মানুষ লাগে। আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভজন, কীর্তন করা সম্ভব। বসতে হবে। তার জন্য পাথরের টুকরোগুলিকে (করসেবকদের সঙ্গে থাকা শিলা) পরিস্কার করতে হবে। আমি যদিও জানি না কাল অযোধ্যায় কী পরিস্থিতি তৈরি হবে।’ বাজপেয়ীর ভাষণে উল্লাসে ফেটে পড়ে গোটা সমাবেশ চত্ত্বর। উন্মত্ত করসেবকেরা এরপর অযোধ্যা অভিমুখে রওনা হয়ে যান।