শেষ আপডেট: 6th December 2024 11:41
অমল সরকার
‘আর বিবাদ নয়, রায় মেনে নিয়ে এবার শান্তিতে বাস করুন’—বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদী।
‘আরএসএস আর কোনও মন্দির-মসজিদ বিবাদে থাকবে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে আমরা রামমন্দির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম, আমাদের কাজ শেষ’—বক্তার নাম মোহন ভাগবত।
প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রধান এই মন্তব্য করেছিলেন ২০১৯-এর ৯ নভেম্বর বিকালে। ওইদিন সকালে ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার বিতর্কিত জমিকে রামচন্দ্রের জন্মস্থান বলে হিন্দুদের দাবি মেনে সেখানে রাম মন্দির নির্মাণের রাস্তা খুলে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়ের পর দেশ শান্ত ছিল। রায় উল্টো হলে কী হতে পারত শীর্ষ আদালত রায় ঘোষণার ২৭ বছর আগেই দেশ তা প্রত্যক্ষ করে।
দিনটি ছিল, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২। যেদিন শত শত টিভি ক্যামেরা, পুলিশ, আধা সেনার কয়েক হাজার কর্মী, প্রশাসনের শীর্ষ আমলা এবং দেশের প্রথমসারির নেতাদের উপস্থিতিতে পাঁচশো-সাড়ে পাঁচশো বছরের প্রাচীন একটি মসজিদকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল উন্মত্ত করসেবকেরা।
মসজিদ যদিও ঘেরা ছিল কাঁটাতারের বেড়ায়। দেওয়ালে, পোস্টারে লেখা হচ্ছিল, মিছিলে আওয়াজ উঠেছিল, ‘এক ধাক্কা ঔর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো।’ ভারতে কী ধর্মীয়, কী রাজনৈতিক, কোনও স্লোগানই ‘এক ধাক্কা ঔর দো’-র মতো চোখের সামনে বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি, ’৯২-এর ৬ ডিসেম্বর দেশ যা প্রত্যক্ষ করে। লখনউয়ের কুর্সিতে সেদিন বিজেপির হিন্দুত্বের পোস্টারবয় কল্যাণ সিং, মোদী সরকার যাঁকে মরণোত্তর পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করেছে।
মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে দেশের নানা প্রান্ত যখন দাঙ্গায় জর্জরিত, কল্যাণ তখন দেশব্যাপী গর্বযাত্রায় বেরিয়ে কলকাতার এসে বলেছিলেন, ‘আগার কন্ট্রাকটর কো দিয়া যাতা কো ছহ মাহিনা লাগ যাতা থা। হামারে করসেবেকো নে ছহ ঘণ্টা মে ধাঁচা তোড় দিয়া।’
ধাঁচা মানে বাবরি মসজিদ। বিজেপি-সহ হিন্দুত্ববাদীদের অভিধানে কোনও দিনই বাবরি-কে মসজিদ বলে স্বীকার করা হয়নি।
ইতিহাসের কালো দিন হয়ে থাকা সেই অযোধ্যা কাণ্ড কয়েক দিনের মধ্যে কেড়ে নিয়েছিল হাজার মানুষের প্রাণ। বাংলায় নিহত হন ৩২জন। উত্তর প্রদেশে নিহত ২০১ জনের বেশির ভাগেরই প্রাণ যায় পুলিশের গুলিতে বাবরি মসজিদ ধ্বসের সময় যারা লাঠি উচিয়ে করসেবকদের ধাওয়া করার সাহস দেখায়নি। বাবরি ধ্বসের রেশ ধরে সংঘঠিত গুজরাত দাঙ্গায় দেশবাসী চিনেছিল এমন এক রাজনীতিককে যিনি দাঙ্গার হিংস্রতা, শত শত মানুষের মৃত্যু, জ্বালাও-পোড়াও পরিস্থিতির মধ্যেও রাজধর্ম ভুলে বিভাজন উসকে দিতে পারেন। দুর্ভাগ্যের হল, সেই রাজনীতি গিলিয়েই তিনি দেশের চৌকিদার হতে পেরেছেন।
আসলে বাবরি ধ্বংসের পর ভারতের রাজনীতির গঙ্গা-যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। রাজনীতি ও সমাজজীবনের ডিএনএ-তে পাকাপাকিভাবে স্থান করে নিয়েছে মন্দির-মসজিদ রাজনীতি। সেই ধ্বংসলীলায় আসলে জোর ধাক্কা খেয়েছে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার স্তম্ভটিই।
বাবরি ধ্বংসের পর বিশ্বহিন্দু পরিষদ স্লোগান তোলে—‘এ তো সিরফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী, মথুরা বাকি হ্যায়।’ তারপরও ২০১৯-এর ৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে মনে হয়েছিল, এই স্লোগান বুঝি আর শুনতে হবে না।
কিন্তু বছর তিন যাবৎ বারাণসীর উত্তর বাহিনী গঙ্গার মতোই ধর্মনগরীর পরিবেশ উল্টো খাতে বইছে। সেখানে জ্ঞানবাপী মসজিদের একদিকের দেওয়ালে হিন্দু দেবদেবীর খোদাই করা মূর্তি লুকনোর বস্তু নয়। চারশো বছর ধরেই মানুষ তা প্রত্যক্ষ করে আসছে। এত বছর পর তা নিয়ে খুঁচিয়ে তোলা হচ্ছে বিতর্ক, বিবাদ। পাঁচ মহিলার আর্জি মেনে বারাণসীর মসজিদের প্রাচীরে খোদাই করা শৃঙ্গার গৌরীর মূর্তিতে সারা বছর পূজাপাঠের অনুমতি দিয়েছে আদালত। এরপর দাবি পেশ হয় মসজিদ জরিপের মামলা। খোদ সুপ্রিম কোর্ট সেই আর্জি মঞ্জুর করে।
জ্ঞানবাপী নিয়ে আদালতের সায় পেতেই হিন্দুত্ববাদীরা মথুরার শাহি ইদগা, মধ্যপ্রদেশের ভোজশালা, বিদিশা এবং উত্তর প্রদেশের সম্ভলের শাহি মসজিদ, রাজস্থানের আজমির শরিফ দরগা এবং সেটির লাগোয়া মসজিদটি ঝাঁকাঝাঁকি শুরু করেছে। মসজিদের নীচে মন্দির খোঁজার অভিযান শুরু হয়েছে দেশ জুড়ে। হিমাচল প্রদেশে মসজিদের বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ এনে পথে নেমেছে গেরুয়া বাহিনী।
অযোধ্যা, বারাণসী, মথুরার মতো বিবাদ এ দেশে অসংখ্য। বাবরি নিয়ে বিবাদ তুঙ্গে উঠলে বিতর্কিত নির্মাণগুলি সুরক্ষিত রাখতে ১৯৯১ সালে কেন্দ্রের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার‘ প্লেসেস অফ ওরশিপ অ্যাক্ট চালু করে, যে আইনে বলা হয়, অযোধ্যা বাদে দেশের অন্যত্র কোনও অবস্থাতেই উপাসনাস্থলগুলির আকার-আয়তন-চরিত্র বদল করা যাবে না। ১৯৪৭-এর ১৫ অগাস্ট সেগুলি যে অবস্থায় ছিল তেমনই রাখতে হবে। জ্ঞানবাপীর মামলায় মুসলিমপক্ষ সেই আইন হাতিয়ার করলে আদালতই পাল্টা যুক্তি হাজির করে বলেছে, আইনে আকার-আয়তন বদল করা যাবে না বলা আছে, সেগুলির ইতিহাস জানার চেষ্টা নিষিদ্ধ নয়। শীর্ষ আদালতের সেই রায়দানকারী বিচারপতিদের একজন ছিলেন সদ্য প্রধান বিচারপতির পদে থেকে অবসর নেওয়া ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ বিবাদ মামলার রায়ে যিনি ১৯৯১-সালের আইনটির প্রশংসা করে সেটিকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রহরী বলে উল্লেখ করেছিলেন।
বাবরি ধ্বংসের তিন দশকের মাথায় সেই আইনটিকেই অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে হিন্দুত্ববাদীরা। সেটি বাতিলের দাবিতে অসংখ্য মামলা সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন। আশ্চর্যজনকভাবে আদালত বারে বারে জানতে চাইলেও মোদী সরকার আইনটির বিষয়ে নীরব।
তাই কাল সরকার সংসদে বিল এনে আইনটি বাতিল করে দেবে না, এমন কথাও হলফ করে বলা যাচ্ছে না। লক্ষণীয় হল, হিন্দুত্ববাদীরা আশা করছে শীর্ষ আদালতই আইনটি অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দেবে। সম্ভলের মুসলিম সমাজ দাবি করেছে, নিম্ন আদালতের মসজিদে জরিপের আদেশ দেওয়ার আগে তাদের মতামত শোনেনি। হিন্দুপক্ষের আর্জি শুনেই জরিপের আদেশ দেয়। মসজিদ কমিটিকে হাই কোর্টে আপিল করার পরামর্শ দিলেও নিম্ন আদালত কেন একপক্ষেক কথা শুনে জরিপের নির্দেশ দিয়েছিল সে ব্যাপারে শীর্ষ আদালত রা কাড়েনি। আজমির শরিফেও জরিপের নির্দেশ দিয়েছে রাজস্থানের আদালত। এরপর মুসলিম মহল্লায় ঘরবাড়ির নিচে মন্দির খোঁজার অভিযান শুরু হওয়াও বুঝি অসম্ভব নয়। সেদিন কী বলবে আদালত? ১৯৯২-র সঙ্গে ২০২৪-এর মস্তবড় ফারাক, আদালতকে পাশে গিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। অযোধ্যায় রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ বিবাদে বিজেপিকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতির শক্তি ও নাগরিক সমাজের যে বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়, আজকের ভারতে তাও অনুপস্থিত। সম্ভলের ঘটনা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস-সহ অনেক দলকেই সেভাবে সরব হতে দেখা গেল না যারা উত্তর প্রদেশের হাতরাসের ধর্ষণকাণ্ডে সংসদীয় দল পাঠিয়ে নজর কেড়েছিল। অথচ, রাজ্যের কোনও মসজিদ নিয়ে ঝাঁকাঝাঁকি শুরু হবে না, তার গ্যারান্টি নেই। মালদহের আদিনা মসজিদ নানা সময়ে আলোচনা এসেছে।
আবার সব আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে ’৯১ সালেক আইনটি বহাল থাকলেও জ্ঞানবাপী, শাহি ইদগা মসজিদের মতো বিতর্কিত নির্মাণগুলির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত কি? বাবরি কাণ্ডে উত্তর প্রদেশের কল্যাণ সিংহের সরকার সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছিল, অযোধ্যায় বিশ্বহিন্দু পরিষদের করসেবায় অনুমতি দেওয়া হলেও মসজিদের ত্রিসীমানায় কেউ ঘেঁষতে পারবে না। টিভির পর্দায় দেশ কিন্তু প্রত্যক্ষ করেছিল অন্য দৃশ্য। সেদিনের কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও মসজিদ ভাঙা শুরুর পর দরজায় খিল দিয়ে হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। দরজা খুলেছিলেন মসজিদের তিনটি গম্ভুজ ভেঙে ফেলার পর। আজকের প্রধানমন্ত্রীর নীরবতাই রাজনীতির প্রধান কৌশল।