শেষ আপডেট: 4 September 2023 08:26
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোটকে নানা গালমন্দ করলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তিনি ও তাঁর দল এই জোটকে মোটেই উপেক্ষা করতে পারছেন না (One Nation One Election)।
মুম্বাইয়ে ৩১ অগাস্ট এবং ১ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকের প্রাক্কালে একদিকে যখন দেশি-বিদেশি মিডিয়ার একাংশ ‘মোদীই ফের প্রধানমন্ত্রী’ বলে সমীক্ষা রিপোর্ট প্রচার করেছে তখন কেন্দ্রীয় সরকার রান্নার গ্যাসের দাম এক লপ্তে অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি প্রকল্পে ছয় হাজারের পরিবর্তে নয় হাজার টাকা দেওয়ার ভাবনাচিন্তা চলছে। বেশ কিছু খাদ্যপণ্যে ভরতুকি ঘোষণা সময়ের অপেক্ষা। সোজা কথা প্রধানমন্ত্রী ভোট কিনতে নেমেছেন।
বিরোধী বৈঠক শুরুর দিনই সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনের কথাও। যদিও সংসদীয় মন্ত্রী জানাতে পারেননি, বিশেষ অধিবেশনের আলোচ্য কী।
আর শুক্রবার বিরোধীদের দ্বিতীয় দিনের বৈঠক চলাকালে ‘এক দেশ এক ভোট’ ব্যবস্থা চালু করতে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে কমিটি গড়েছে সরকার। দুধের শিশুটিও বোঝে বিরোধী জোটের বৈঠক থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই এত আয়োজন। টিভির পর্দায় ভাগ বসানোও এখন রাজনীতির মস্ত বড় কৌশল।
আসলে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী দিল্লির কুর্সি আঁকড়ে থাকতে মরিয়া। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বিলোপ, তিন তালাক নিষিদ্ধ করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির আংশিক প্রয়োগ করে বিজেপির তিন মৌলিক ঘোষণা তিনি কার্যকর করে ফেলেছেন। তাঁর বাকি কাজ হল ২০২৫-এ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ শতবর্ষে পা দেওয়ার আগে ভারতের সংবিধান বদলে দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণার জন্য কাঠামো পরিবর্তনের কাজটি সেরে ফেলা। ‘এক দেশ-এক ভোট’ ব্যবস্থা প্রণয়ন সেই লক্ষ্যেই অগ্রসর হওয়া।
প্রস্তাবটি পুরনো। ২০১৯-এ প্রধানমন্ত্রী ‘এক দেশ-এক ভোট’ ব্যবস্থা চালুর ব্যাপারে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিলেন। যদিও বিরোধীদের থেকে তেমন সাড়া পাননি। যতদূর বুঝেছি, সব দল সহমত হলেও নয়া ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সহজ নয়। আবার ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র মতো বিষয়টি বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়াও রহস্যজনক। আমি সংবিধান বিশেষজ্ঞ নই। আগামী লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গেই সব বিধানসভার নির্বাচন সেরে ফেলতে সরকারের হাতে কোনও সাংবিধানিক যাদুকাঠি আছে কি না বলা মুশকিল। প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এন গোপালস্বামী, যিনি নয়া ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করেছেন তিনিও ‘দ্য ওয়াল’-কে বলেছেন, এই ব্যাপারে সহমতের ভিত্তিতে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে।
তবে এই ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকগুলি নিয়ে খানিক আলোচনা করা যেতে পারে। বলা হচ্ছে, সংযুক্ত নির্বাচন হলে পৃথক ভোটের বিপুল খরচ থেকে রেহাই মিলবে। আমাদের মতো গরিব দেশে খরচের বিষয়টি সত্যিই উপেক্ষা করার নয়। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলির মোট খরচের পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের রিপোর্ট অনুযায়ী এর ৪৫ শতাংশই খরচ করেছে বিজেপি ও তাদের প্রার্থীরা। নরেন্দ্র মোদী কি তাঁর দলের নির্বাচনী খরচে রাশ টানতে পারবেন? প্রধানমন্ত্রী সত্যিই নির্বাচনী সংস্কার চাইলে তাঁরই চালু করা অস্বচ্ছ ‘ইলেকটোরাল বন্ড’ সবচেয়ে আগে বাতিল করা দরকার। দরকার ভোটে প্রার্থীর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলিরও খরচের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া।
খরচের প্রসঙ্গেই বলি, যৌথ নির্বাচন নিয়ে ২০১৫ সালে নির্বাচন কমিশন একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল তৎকালীন মুখ নির্বাচন কমিশনার ওপি রাওয়াতের নেতৃত্বে। সেই কমিটির রিপোর্ট বলছে, গোটা বিশ্বে ভারতেই নির্বাচন খাতে খরচ সবচেয়ে কম—ভোটার পিছু এক ডলার। আসলে নির্বাচনে সরকারি খরচের থেকে বেশি মাথাব্যথার কারণ বিজেপি ও তাদের সহযোগী দলের প্রচারে ব্যয়।
কমিশনের তখনকার হিসাব অনুযায়ী সংযুক্ত নির্বাচন করতে হলে অন্তত ৩০ লাখ ইভিএম প্রয়োজন হত। কমিশনের হাতে ছিল অর্ধেকের কিছু বেশি। বাকি ইভিএমের জন্য তখনই খরচ ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। গড়ে একটি ইভিএম পনেরো বছর কার্যক্ষম থাকে। সংযুক্ত নির্বাচন হলে বিপুল টাকা খরচ করে কেনা ইভিএমগুলি পনেরো বছরে মাত্র তিনবার ব্যবহার হবে, এখন যা গড়ে ১০ বার ব্যবহার হয়।
বলা হচ্ছে পৃথক নির্বাচনের আদশ আচরণবিধির জেরে প্রায়ই সরকারি কাজ থমকে যাচ্ছে। এই বক্তব্যের সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, আদর্শ আচরণবিধি সরকারের চালু কাজে কোনও বাধা সৃষ্টি করে না। বিধিনিষেধ আছে শুধু নতুন প্রকল্প, নতুন প্রতিশ্রুতি ঘোষণায়। নির্বাচন কমিশন ভোট চলাকালে সরকারকে হাত-পা গুটিয়ে থাকতে বলে না।
নির্বাচন হল রাজনৈতিক লড়াইয়ের সর্ব বৃহৎ কর্মকাণ্ড। ভোটের প্রচারের সুবাদেই রাজনৈতিক দল জনমনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। লোকসভা, বিধানসভার পৃথক নির্বাচন চালু থাকায় পদ্ম শিবিরের নেতারাও বেশি করে মানুষের কাছে যেতে পারছেন। প্রশ্ন হল তাহলে খরচ, লোকবল, সুরক্ষা, সময় ইত্যাদিতে সাশ্রয়ের নামে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল কেন সংযুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। শুক্রবার খবর প্রচার হওয়া মাত্র দেখা গেল ময়দানে নেমে পড়েছেন পদ্ম শিবিরের মুখ্যমন্ত্রী ও নেতারাও।
আসলে বিজেপির লক্ষ্য শুধু ‘এক দেশ-এক নির্বাচন’ নয়। তাদের স্বপ্ন, ‘এক দেশ-এক নির্বাচন-এক দল।’ নির্বাচনের মাধ্যমেই ভারতে একদলীয় ব্যবস্থা কায়েম। ঠিক যেভাবে ভোটে জিতে এসে প্রতি পদে গণতন্ত্রকে পদদলিত করে মোদী সরকার নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে। মোদী-শাহরা মনে করছেন, সংযুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যে রাজ্যে ডবল ইঞ্জিন সরকার প্রতিষ্ঠা আরও সহজ হয়ে যাবে।
এই কারণেই সংযুক্ত নির্বাচন ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর। যুক্ত নির্বাচন হলে প্রচারে জাতীয় ইস্যুই প্রাধান্য পাবে, বড় দলগুলির ঢক্কা নিনাদে হারিয়ে যাবে আঞ্চলিক দলের বক্তব্য, রাজ্যবাসীর প্রত্যাশা। আঞ্চলিক দল যারা রাজ্যের মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে সামনে রেখে লড়াই করে সেই দলগুলি যুক্ত নির্বাচনে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে যাবে।
এমনিতেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন অনেক বেশি নির্বাচনকেন্দ্রীক। সংযুক্ত নির্বাচন হলে ছোট এবং আঞ্চলিক দলগুলিকে স্থবিরতা গ্রাস করবে, বড় দলগুলির ক্ষেত্রে যে সম্ভাবনা তুলনায় কম। দেশবাসী, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে রাজনীতি বিমুখ করাও যৌথ নির্বাচনের অন্যতম উদ্দেশ্য। এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে যাতে, সরকারের নীতি, পদক্ষেপের বিরোধিতা করার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। চলতি ব্যবস্থায় কোনও ভোটার লোকসভায় কোনও দলকে সমর্থন করার পর যদি দেখেন তারা প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ তাহলে বিধানসভায় অন্য দলকে ভোট দিতে পারেন। সংযুক্ত নির্বাচনে সে সুযোগ থাকবে না এবং লোকসভা এবং বিধানসভার জন্য পৃথক দলকে ভোটদানের সম্ভাবনা ক্রমশ কমে আসবে।
বিজেপি কিন্তু এই ভরসাতেই মনে করছে, সংযুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা গেলে দাক্ষিণাত্য এবং পূর্ব ভারতের অধরা রাজগুলির দখল নেওয়া সহজ হয়ে যাবে। পুলওয়ামার মতো কিছু একটা ঘটে গেলে তো কথাই নেই। জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলে বাজিমাৎ করা যাবে একত্রে অনুষ্ঠিত দুই নির্বাচনেই। ভারতবাসীর সবচেয়ে বড় শক্তি, একই সঙ্গে দুর্বলতা হল তাদের দেশপ্রেম। বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী শিবির দেশবাসীর এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই আজ ভারত শাসন করছে। ভোটের মুখে ‘ভারত বিপন্ন’ প্রতিষ্ঠা করা গেলে বাংলা, বিহারের প্রতি বঞ্চনার ইস্যু নির্বাচনে দাগ কাটবে না, বলাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন: ‘কেয়া নাম হ্যায় তেরা?' ঘৃণার নরকে বেড়ে উঠছে যে প্রজন্ম
কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে, ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ভারতে ‘এক দেশ-এক নির্বাচন’ ব্যবস্থাই চালু ছিল। কিন্তু সেই ভারতের সঙ্গে আজকের ভারতের আসমান-জমিন ফারাক। স্বাধীনতা প্রাপ্তির দশ বছরের মাথায় কেরলে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির সেই সরকারকে আবার দু’বছরের মাথায় একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল দিল্লির কংগ্রেস সরকার। ১৯৬৭-র আগে কেরল বাদে দ্বিতীয় কোনও রাজ্যে অকংগ্রেসি সরকার ক্ষমতায় ছিল না।
আজকের ভারতে প্রায় দেড় ডজন রাজ্যে আঞ্চলিক দল ক্ষমতায়। স্বাধীনতার সময়ও রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক দল ছিল। কিন্তু আজকের মতো শক্তিশালী এবং শাসক দল ছিল না একটিও। ১৯৬৭ পরবর্তী ভারতে আঞ্চলিক দল দেশের রাজনীতি বদলে দিয়েছে। এই প্রস্ফুটিত যুক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে যুক্ত নির্বাচন চালু হলে।
প্রশ্ন হল, কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের অস্তিত্ব নিয়ে সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলে কী হবে? এখন বিকল্প সরকার গড়া না গেলে মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়ে থাকে। বলা হচ্ছে সংযুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর পর মধ্যবর্তী নির্বাচনও এড়ানো হবে। তাই বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হলে সঙ্গে বিকল্প সরকারের দিশাও পেশ করতে হবে। তা না হলে রাষ্ট্রপতি শাসনই একমাত্র পথ।
প্রশ্ন হল এমন শর্ত কি সংবিধান সম্মত? ভারতে জোট রাজনীতি যেভাবে বিকশিত হয়েছে তাতে সরকারের অস্তিত্ব নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়। সমস্যার সমাধানে রাষ্ট্রপতি শাসন কায়েমের অর্থ বিনা নির্বাচনে ডবল ইঞ্জিন সরকার কায়েম। এভাবেই বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদী ‘এক দেশ-এক ভোট-এক দল’ ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে।