Latest News

মোদীর ‘মুসলিম জোড়ো’ —জুতো মেরে গরু দান

অমল সরকার

বিবিসি-র তথ্যচিত্র ‘দ্য মোদী কোয়েশ্চেন’ নিয়ে বেজায় চটেছে নরেন্দ্র মোদীর (Narendra Modi) সরকার। বিবিসি সেটি ভারতে দেখার ব্যবস্থা না করলেও কলকাতার এক সাংবাদিক প্রযুক্তির সাহায্যে ডকুমেন্টারিটি দেখেছেন। তাঁর কথায়, তথ্যচিত্রটিতে খুব নতুন কিছু নেই। গুজরাত দাঙ্গার (Gujarat Riot) প্রেক্ষাপটে তৈরি তথ্যচিত্রটির মূল বিষয়, রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা এবং ভারতে মুসলিমদের দুরবস্থা। স্বাধীন ভারতে নজিরবিহীন এই দাঙ্গা ২০১৪-র লোকসভা ভোটে দিল্লির পালাবদলে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল, এমন একটা ধারণা নির্মাণের চেষ্টা হয়েছে তথ্যচিত্রটিতে। এটাও গোটা বিশ্বে বহুচর্চিত বিষয়। সেই দাঙ্গার পর মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্র নরেন্দ্র মোদীকে ভিসা দিতে অস্বীকার করে।

Image - মোদীর ‘মুসলিম জোড়ো’ —জুতো মেরে গরু দান

তবে আইনের শাসনে আস্থাভাজন সকলকেই মনে রাখতে হবে, সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র মোদীকে গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে ‘নিরপরাধ’ বলেছে। বিবিসি-র তথ্যচিত্র নিয়ে সেটাই কি মোদী সরকারের চটে যাওয়ার কারণ? মনে হয় না। বেশির ভাগ দাঙ্গাই এক ধরনের তাৎক্ষণিক অপরাধ। ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গা তার ব্যতিক্রম ছিল না। সেই বছর বিধানসভা ভোটে মুখ্যমন্ত্রী মোদী বিপুল ভোটে জিতে সরকার টিকিয়ে রাখেন, অনেকেই যে জয়কে দাঙ্গার ভোট-মূল্য দিয়ে বিচার করে থাকেন।

কিন্তু মুসলিমদের অবস্থা-দুরবস্থা যদি বলতে হয়, তা হলে ২০১৪ পরবর্তী ভারত এক তুলনাহীন পর্ব। যখন অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তোলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালু আছে। কখনও কখনও এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে খ্রিস্টান এবং শিখরা। তিন কৃষি বিলের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের কৃষকদের আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, খলিস্তানি বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। যেমন, ধর্মীয় অধিকার দূরে থাক, নিতান্ত পেটের টানে প্রতিবাদী মুসলিমকেও দেশদ্রোহী তকমা সেঁটে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার নিদান দেওয়া হয়। মুসলিমদের পাশাপাশি লাভ জিহাদের নামে নিশানা করা হয়েছে খ্রিস্টানদেরও। ২০২২-এর বড়দিন বিশ্ব দরবারে ভারতকে খাটো করেছে গির্জায়, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে অন্ধ হিন্দুত্ববাদীদের হামলার ঘটনায়।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পিউ রিসার্চ সেন্টার গত মাসে প্রকাশিত রিপোর্টে বলেছে, ২০২০ অর্থাৎ কোভিড কালে ধর্মকে জড়িয়ে সামাজিক শত্রুতার সূচকে ১৯৮টি দেশের মধ্যে শীর্ষে ছিল ভারত। আমেরিকা ভিত্তিক আর এক সংস্থা কাউন্সিল অন মাইনরিটি রাইটস ইন ইন্ডিয়া-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, ২০২২-এ ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর সংঘঠিত ঘৃণামূলক অপরাধের ২৯৪টি মামলার ১৯২টি হয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। খ্রিস্টান ও শিখদের বিরুদ্ধে সংঘঠিত হয়েছে যথাক্রমে ৯৫ এবং সাতটি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক অপরাধের ঘটনাগুলির বেশির ভাগই বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে ঘটেছে, যা একটি প্যাটার্নকেই ইঙ্গিত করে। বিপদ হল, এর পরেও সবচেয়ে ব্যবহৃত শব্দবন্ধগুলির তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে ‘সবকা সাথ’, ‘অচ্ছে দিন’। কী বিচিত্র আমার দেশ!

আজানে মাইক নিষিদ্ধ করা, রামনবমীর সময় আমিষ খাবারে নিষেধাজ্ঞা, জেলা, শহর, গ্রাম, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান থেকে মুসলিম নাম বাদ দেওয়া, ইসলামিক প্রার্থনা সঙ্গীত, গান, কবিতায় আপত্তি, পাঠপুস্তক থেকে জনপ্রিয় মুসলিম কবি, লেখকদের পদ্য, গদ্য বাতিল— গত আট-সাড়ে আট বছরে কী না ঘটেছে গান্ধীর ভারতে। নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরতদের উদ্দেশে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বলেছেন, ‘পোশাক দেখেই বোঝা যায়, বিরোধিতা কারা করছে’। এমন দেশে হিজাব, বোরখা নিষিদ্ধ করার ফতোয়া জারি আর বিচিত্র কী!

অতএব, বিবিসি-র তথ্যচিত্রের বিষয়বস্তু কেন্দ্রীয় সরকারের গোসার কারণ হয়েছে ধরে নিলে ভুল হবে। আসলে তথ্যচিত্রটি রিলিজের সময়টি নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল এবং সরকারের পক্ষে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সদ্যই (১৬-১৭ জানুয়ারি) দিল্লিতে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ফের ‘মুসলিম জোড়ো’-র ডাক দিয়েছেন। মাস সাতেক আগে কর্মসমিতির হায়দরাবাদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দলকে প্রথম বার এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, হিন্দু দলিতের পাশাপাশি গরিব সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমদেরও কাছে টানতে হবে। এক কথায়, জয় শ্রীরামের পার্টিতে রহিমদের আর ব্রাত্য করে রাখা চলবে না।

মোদীর পরামর্শটি ছিল অবাক করা। হায়দরাবাদের বৈঠকের তিন মাস আগে উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে বিজেপির এক জনও মুসলিম প্রার্থী ছিলেন না। শুধু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাই নয়, যে ১৭টি রাজ্যে বিজেপি একক শক্তিতে ক্ষমতায়, তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশে একজন বাদে কোথাও মুসলিম মন্ত্রী নেই। লোকসভা-রাজ্যসভা মিলিয়ে দলের চার শতাধিক সাংসদ এবং দেশে দেড় হাজারের কাছাকাছি বিধায়কের একজনও মুসলিম নন। উত্তরপ্রদেশে ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী যোগী রীতিমতো তাচ্ছিল্যভরে জানিয়ে দিয়েছিলেন, রাজ্যের কুড়ি শতাংশ মুসলিমের ভোট না পেলেও তাঁর চলবে।

তার পরেও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মোদী উত্তরপ্রদেশের সেই ভোটের পরই মুসলিমদের কাছে টানার কথা বলেছেন। কারণ, হিন্দি বলয়ে দলের হিন্দুত্বের সর্ববৃহৎ ল্যাবরেটরি উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফলে বিজেপির অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি আছে। ভোটের পর বুথভিত্তিক ফল পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে, যোগীর তুচ্ছতাচ্ছিল্য সত্ত্বেও বহু মুসলিম মহল্লায় বিজেপি ভোট পেয়েছে। সংখ্যালঘু শিবিরের এই ভোটাররা বেশির ভাগই অত্যন্ত গরিব, দু-বেলা দু-মুঠো জুটলেই যাদের চলে যায়। করোনা কালে তারাও বিনামূল্যে রেশনের চাল-ডাল পেয়েছে। পেয়েছে বিনামূল্যের টিকা। কিন্তু ধর্মের প্রশ্নে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি তুচ্ছাতাচ্ছিল্য সইতে হচ্ছে তাদের।

ভারতে বিগত দু’-আড়াই দশক যাবৎ মুসলিমদের বড় সমস্যা হল, তাদের প্রতিনিধিত্বকারী কোনও নেতা নেই কোনও দলেই। তাই গরিব মুসলিমেরা, নিত্যদিন বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাওয়া যাদের জীবনে দস্তুর, তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা চলে না। ভোটের বুথভিত্তিক ফলাফল অনেক জনগোষ্ঠীর জন্যই বিপদ ডেকে এনেছে। কারণ, ভোটের ফলে এলাকার রাজনৈতিক আনুগত্য গোপন থাকে না। উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য যেখানে লাভ জিহাদের নামে মুসলিম তরুণদের জেলে আটকে রাখা হয়েছে, গরুর মাংস বিক্রি, বহন, খাওয়ার অপরাধে পিটিয়ে মারা, অপরাধী দমনের নামে বাছাই করে মুসলিমদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে নিরুপায় গরিব সংখ্যালঘু অনিচ্ছা গোপন করে সংখ্যাগুরুর কাছে আত্মসমর্পণ করবে, তাদের কৃপা, আশ্রয় প্রার্থনা করবে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে!

সঙ্কটে নরেন্দ্র মোদী দেশের দরিদ্র মুসলিমদের এই অসহয়তারই সুযোগ নিচ্ছেন ভালমানুষি করে। মোদীর সঙ্কট তাঁর ২০২৪-এর টার্গেট। তিনি এমন একটা ফল প্রত্যাশা করছেন, যা তাঁকে সংবিধান বদলে দেওয়া ক্ষমতা দেবে। কিন্তু বাদ সেধেছেন রাহুল গান্ধী। মোদীর ‘কংগ্রেস শূন্য ভারত’-এর স্বপ্ন মিথ্যা প্রমাণ করে শতাব্দী প্রাচীন দলটি ‘পাপ্পু’ রাহুল গান্ধীকে সামনে রেখেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আপ, টিআরএস এবং উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমের আরও নানা আঞ্চলিক দল মোদীর মুখ চেয়ে কংগ্রেস মুক্ত জোটের ভাবনায় মশগুল হলেও দশ বছরের শাসনে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার স্বাভাবিক প্রবণতাকে অস্বীকার করা কঠিন, জানেন নরেন্দ্র দামোদর মোদী। ফলে ঘরের ভোট যদি বা কিছু হাতছাড়া হয়, অসহায়, দরিদ্র মুসলিমদের কাছে টেনে সেই শূন্যতা পূরণ সম্ভব, আশাবাদী তিনি।

নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের সেই ভাবনা, কৌশলের পরীক্ষাগার হতে চলেছে কর্নাটক, যেখানে সাড়ে পাঁচ কোটি ভোটারের তেরো শতাংশ মুসলিম এবং গত এক-দেড় বছর যাবৎ কখনও হিজাব নিষিদ্ধ, কখনও লাভ জিহাদ তো কখনও হালাল মাংস বিতর্কে মুসলিমদের কোণঠাসা করা হয়েছে। হিন্দুদের মেলা-উৎসবে মুসলিম দোকানদারদের স্টল খুলতে দিতে আপত্তি করা হয়েছে। সেখানে বিজেপি রাজ্য সভাপতি নলিন কুমার কাতিল ক’দিন আগেই বুথ স্তরের কর্মী বৈঠকে বলেছেন, রাস্তা, জল, জঞ্জাল পরিস্কারের দাবি আদায়ের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হল লাভ জিহাদ প্রতিরোধ।

দিল্লিতে দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে ‘মুসলিম জোড়ো’ বার্তা দিয়েই পর দিন সেই কর্নাটকে সভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। মুখে সেই ‘সবকা সাথ-সবকা বিকাশ’-এর বুলি। বলেছেন ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা। কারণ, দক্ষিণের এই একমাত্র রাজ্যটিতে সরকারে টিকে থাকতে মুসলিম ভোট ছাড়া গতি নেই। নয়তো লোকসভার মহারণের আগে মুখ পুড়তে পারে মোদীর। রাজ্যে লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ভুক্ত প্রভাবশালী পঞ্চমাশালি উপ-জনগোষ্ঠী বিজেপির উপর খাপ্পা ওবিসি সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি না রাখায়।

তা ছাড়া, পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, অপশাসনের অভিযোগও ভাবিয়ে তুলেছে গেরুয়া শিবিরকে। হিন্দুত্বের জাদুকাঠিতে লক্ষ্যপূরণ হবে না বুঝেই এই মুসলিম দরদ। বাংলার ঠোঁটকাটা বিজেপি নেতা তথাগত রায় যাকে ‘নরম ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলেছেন। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, হিন্দু ভোটের বাসনায় বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে নরম হিন্দুত্বের পথে হেঁটেও রাজীব গান্ধীর দিল্লির কুর্সি রক্ষা করতে না পারার কথা। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর চার দশক আগের যে সিদ্ধান্ত বদলে দিয়েছে ভারতের রাজনীতির ডিএনএ।

অবশ্য রাজীব গান্ধী মোটেই নরেন্দ্র মোদীর মতো ক্ষুরধার রাজনীতিক ছিলেন না। মোদীর মুসলিম প্রীতি নিয়ে বলতে গিয়ে কর্নাটকের বিজেপি নেতারা ‘সব মুসলিম খারাপ নয়’ তত্ত্ব হাজির করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, মুসলিমদের কাছে টানার মধ্যেও আছে বিভেদের কৌশল।

‘বডি স্প্রে কালচার’ ও ২৩-এর ভাবনা

You might also like