Latest News

মোদী: সম্পদ ও বোঝা

বিবিসি আর আদানি। এই দুই বিতর্কে এখন সরগরম জাতীয় রাজনীতি। সংসদের বাজেট অধিবেশনে বিরোধীরা দু’টি ইস্যুতে সরকারকে চেপে ধরতে তৈরি। মনে হয়, ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াবে। এই বছরেই মোট ন’টি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আছে। তার আগে বিরোধীরা চেষ্টা করবেন যাতে সরকারকে যথাসম্ভব বিপাকে ফেলা যায়। বিবিসির তথ্যচিত্র ও আদানি গোষ্ঠীর তথাকথিত কেলেংকারি, দুই বিতর্কেরই কেন্দ্রে আছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi)।

বিজেপির অপর কেউ অভিযুক্ত হননি। এতদিন মোদী ছিলেন বিজেপির পোস্টার বয়। তাঁর অনুগামীরা বলত, তিনি একাই দলকে ভোটে জেতাতে পারেন। এবার দলকে বিপদে ফেলার দায়ও সম্ভবত মোদীকেই নিতে হবে।

২০১৯ সালের ভোটে বিজেপির স্লোগান ছিল, ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।’ অর্থাৎ মোদী থাকলে সবই সম্ভব। বিজেপির বক্তব্য ছিল, স্বাধীনতার পরে কয়েক দশক ধরে কংগ্রেস দেশকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। একমাত্র মোদীই ভারতকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারেন। একমাত্র তাঁর নেতৃত্বেই দেশ উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করতে পারে।

Image - মোদী: সম্পদ ও বোঝা

বিজেপি বরাবরই মোদীকে ‘বিকাশপুরুষ’ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে মোদী সর্বভারতীয় রাজনীতিতে পরিচিতি পেয়েছিলেন গুজরাত দাঙ্গার পরে। ওই সময় তিনি ছিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। অভিযোগ, গোধরায় ট্রেনে অগ্নিসংযোগের পরে তিনি দাঙ্গাবাজদের অবাধে তাণ্ডব চালাতে দিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য তাঁকে ক্লিনচিট দিয়েছে। কিন্তু রাজনীতির চাপান-উতোর সবসময় আদালতের ক্লিনচিট মেনে চলে না। একসময় রাজীব গান্ধীও বফর্স মামলায় ক্লিনচিট পেয়েছিলেন। কিন্তু বহু লোক এখনও বিশ্বাস করেন, তাঁর অপদার্থতার জন্যই ওই কেলেংকারি ঘটতে পেরেছিল।

বহুকাল আগে ১৯৪৬ সালে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হুসেন শাহিদ সোহরাবর্দি। অভিযোগ, দাঙ্গার তিনদিন তিনি নিজে বসেছিলেন লালবাজারে। নজর রাখছিলেন যাতে পুলিশ দাঙ্গাবাজদের একাংশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়। ২০০২ সালের দাঙ্গায় মোদীর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছিল। সেই অভিযোগই বিবিসির তথ্যচিত্রে নতুন করে ফিরে এসেছে।

কয়েক সপ্তাহ আগে গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে দু’দফায় একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেছে বিবিসি। তার নাম ‘ইন্ডিয়া: দি মোদী কোশ্চেন’। তাতে বলা হয়েছে, দাঙ্গার পরে ব্রিটিশ সরকারের ধারণা হয়েছিল, গুজরাতে এথনিক ক্লিনজিং-এর চেষ্টা হয়েছে। অর্থাৎ পরিকল্পিতভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। ব্রিটিশ রাজপুরুষরা অনেকেই ভেবেছিলেন, মোদীর জন্য পুলিশ অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

কেন্দ্রীয় সরকার তথ্যচিত্রটি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তি যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে কোনও ভিডিওকে নিষিদ্ধ করে বিশেষ লাভ হয় না। তাছাড়া এমনিতেই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি হয়। ইতিমধ্যে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি ও আরও কয়েকটি শিক্ষায়তনে ওই তথ্যচিত্র দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। পুলিশ বাধা দিতে গেলে গোলমাল বেঁধেছে দফায় দফায়।

সেই অশান্তি থিতিয়ে আগেই শুরু হয়েছে আদানি বিতর্ক। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ নামে এক মার্কিন সংস্থার দাবি, আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। এছাড়া ওই গোষ্ঠী হিসেবেও নানা কারচুপি করেছে।

এই অভিযোগের কথা জানাজানি হতেই আদানির বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম পড়ছে হু হু করে। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীরা পাঁচ লক্ষ কোটি টাকার বেশি হারিয়েছেন। গত সপ্তাহে বিশ্বের ধনীতমদের মধ্যে আদানির স্থান ছিল তিন নম্বরে। এখন তিনি আট নম্বরে নেমে এসেছেন।

হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের জবাবে আদানি গোষ্ঠী বলেছে, তাদের ওপরে আক্রমণ মানে ভারতের ওপরে আক্রমণ। এই ধরনের ‘মিথ্যা’ রিপোর্টের মাধ্যমে দেশের অগ্রগতিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

বিরোধীরা সঙ্গে সঙ্গে সরব হয়েছেন। তাঁদের প্রশ্ন, একজন শিল্পপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে ভারতের ক্ষতি হবে কেন? আদানি মানেই কি ভারত? তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ মানেই কি ভারতের ওপরে আক্রমণ?

এর আগে মোদী সম্পর্কেও একই অভিযোগ উঠেছিল। বিবিসির তথ্যচিত্র সম্প্রচারিত হওয়ার পরে মোদীর অনুগামীরা বলেছিলেন, এর ফলে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। বিরোধীরা বলেছিলেন, ওই তথ্যচিত্রে মোদীর ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে, ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে কেন? মোদী মানেই কি ভারত?

আদানি হলেন মোদীর বহুকালের বন্ধু। ন’য়ের দশকেই দু’জনের আলাপ হয়েছিল। মোদী তখন ভারতীয় জনতা পার্টির মাঝারি স্তরের নেতা। ২০১৪ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে মোদী গুজরাত থেকে প্রাইভেট জেট প্লেনে দিল্লি অবধি উড়ে গিয়েছিলেন। বিমানের সিঁড়ি থেকে ফটোগ্রাফারদের উদ্দেশে হাত নেড়েছিলেন তিনি। সেই বিমানে জ্বল জ্বল করছিল আদানি গোষ্ঠীর লোগো। তখন থেকেই সারা দেশে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন গৌতম আদানি।

অনেকে বলেন, আদানির উত্থানের পিছনে মোদীর বড় ভূমিকা আছে। অভিযোগ, আদানির কয়লা ব্যবসার স্বার্থে অন্তত তিনবার আইন বদলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। হিন্ডেনবুর্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে বিতর্কের আঁচ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না মোদীও।

একসময় ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কংগ্রেস দলের সম্পদ। মানুষ তাঁকে দেখেই কংগ্রেসকে ভোট দিত। পরে ইন্দিরার কয়েকটি কাজকর্মে দলের ক্ষতি হয়। তিনি হয়ে ওঠেন কংগ্রেসের বোঝা। অনুগামীর দল তাঁকে ত্যাগ করে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, বিবিসি বা আদানি বিতর্কে বিজেপির কোনও বড় নেতা এখনও মোদীর হয়ে মুখ খোলেননি। তাহলে মোদীও কি ক্রমশ দলের বোঝা হয়ে উঠছেন?

মোদী সরকার বিচারব্যবস্থাকে মাফ করুক

You might also like