শেষ আপডেট: 13th August 2023 08:01
গত বৃহস্পতিবার সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভাষণ (Narendra Modi and Rahul Gandhi in the parliament) শেষ করার খানিক পরেই পরিচিত একজন দেখা হতে বললেন, ‘কী, মোদী সাহেব তো একেবারে আঠা মাখার মতো ডলাইমলাই করে ছাড়ল বিরোধীদের।’
ভদ্রলোককে কট্টর মোদী বিরোধী বলে জানি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা ওপর ওপর শুনলে এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভাষণকে কাটাছেঁড়া করলে বোঝা যাবে মোদী সেদিন আসলে কী বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিরোধীরা প্রস্তুত হয়ে আসেননি। তারা শুধুই ‘নো বল’ ছুড়ছেন। তাই সরকার পক্ষ চার-ছয় হাঁকাতে পারছে।’ সংবাদমাধ্যমে খবর ছিল, বিজেপি সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আগাম গেয়ে রেখেছিলেন, অনাস্থা প্রস্তাবের শেষদিনে শেষ বলে ছক্কা হাঁকাবেন। সেই ভদ্রলোকের মতো অনেকেই মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী সেদিন জবাবি ভাষণে মাত করে দিয়েছেন। যদিও সেই ভাষণকে চার-ছয় হাঁকানোর ব্যাটিং বলে আমার মনে হয়নি।
শ্রুতিমধূর না হলেও নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ যে আমজনতার বোধগম্য হয়, তাতে কারও সংশয় থাকার কথা নয়। তাঁর ভাষণ কোটি কোটি মানুষ টিভিতে, মোবাইলে দেখে কারণ তিনি হিন্দিতে বলেন এবং তাঁর ভাষণ একটানা শোনানো হয়। বাকিদের, বিশেষ করে বিরোধীদের বক্তব্যের অধিকাংশ সময় সংসদের ক্যামেরা স্পিকার কিংবা চেয়ারম্যানের দিকে তাক করা থাকে।
মোদীর ভাষণ লোকে শোনার আর একটি কারণ, সংসদ, লালকেল্লা কিংবা ভোটের ময়দান, মোদীর ভাষণে শব্দচয়ন থেকে ভঙ্গিমার কোনও ফারাক থাকে না। এবারও মনে হচ্ছিল তিনি কোনও ময়দানে নির্বাচনী ভাষণ দিচ্ছেন। আর তাঁর কথ্য হিন্দি কম-বেশি গোটা ভারত বোঝে। বিজেপির এমপিরা প্রায় সকলেই সংসদে হিন্দিতে বলে থাকেন।
কিন্তু এগুলিই সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীদের মাত করে দেওয়ার অন্যতম কারণ নয়। আসল কারণ, সেই ২০১৪-থেকেই দেখে আসছি, যে কোনও মোকাবিলাতেই তিনি ফুটবল ম্যাচে রাগবি খেলার মতো ময়দানে নেমে খেলাটাই বদলে নেন। প্রধানমন্ত্রীর এই কৌশল হল, যথাসম্ভব অর্ধসত্য বলে সব কিছু ওটলপালট করে দেওয়া।
যেমন, অনাস্থা বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী ৫৭ বছর আগে মিজোরামে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বোমা বর্ষণের ঘটনা তুলে ধরে কংগ্রেসকে উত্তর-পূর্বের অবিচার নিয়ে আক্রমণ শানিয়েছেন। বলেছেন, ‘মিজোরামের বাসিন্দারা কি ভারতীয় নন?’
প্রধানমন্ত্রী যে সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন স্বাধীন ভারতের বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার লালডেঙ্গা করাচিতে বসে পাকিস্তান ও চিনের মদতে বৃহত্তর অসমের অংশ মিজোরামকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণার দাবি তুলেছেন। অ-মিজোদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার ফতোয়া জারি করেছেন। তখন পুরোদস্তু বিচ্ছিন্নতাবাদী পার্টি মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের অত্যাচারে প্রতিদিন নিরীহ মানুষ মরছে। লালডেঙ্গার বাহিনীর ঘাঁটি ধ্বংস করতে বায়ু সেনাকে বোমা নিক্ষেপ করতে পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আজকের প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে যখন বোমা নিক্ষেপের প্রেক্ষাপটটি চেপে যান তখন এই ব্যাপারে তাঁর ভাষণ মিথ্যাচার নয় তো কী!
সেই ভারতে শুধু মিজোরাই নন, উত্তর-পূর্বের বহু জনগোষ্ঠী ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়নি। তাদের এই ইচ্ছাকে উসকে দিতে তৎপর ছিল চিন, পাকিস্তান। আজকের বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। তাই পরিস্থিতির চাপে অসম-সহ গোটা উত্তর-পূর্বে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার পাশাপাশি সেনাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের সঙ্গে কাজ করতে হত। সে জন্য সেনার বিশেষ আইন আফ্সপা বলবৎ করতে হয় যা ব্রিটিশরা গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মোকাবিলায় চালু করেছিল। মানবাধিকার বিরোধী সেই আইন পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে বলে উত্তর-পূর্বের মানুষকে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া কথা প্রতিশ্রুতিতেই থমকে আছে। ইন্দিরা যেমন বোমা বর্ষণ করিয়েছিলেন, তেমনই শান্তি ফেরাতে রাজীব গান্ধী সেই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার সঙ্গে বৈঠক করে সমস্যা মিটিয়ে দেন। মুখ্যমন্ত্রীও হন লালডেঙ্গা।
অনাস্থা বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী সেদিন উত্তর-পূর্ব থেকে উড়ে মুহূর্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরে। ইন্দিরা গান্ধীই সেখানে সেনা অভিযান (অপারেশন ব্লু স্টার) চালিয়েছিলেন। স্বর্ণ মন্দির শিখ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মস্থান। সেই ঘটনার জেরেই দুই ব্যক্তিগত শিখ রক্ষীর গুলিতে মরতে হয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে। তার জেরে দিল্লি এবং দেশের অন্যত্র দাঙ্গা, শিখদের প্রতি অন্যায়-অবিচার, এসবই ইতিহাসের অংশ। ইতিহাসের পাতায় আছে লেখা আছে বিচ্ছিন্নতাবাদী, খলিস্তানপন্থীদের হাতে সাধারণ মানুষকে নিধন যজ্ঞ। সেই আতঙ্কের দিনগুলিতে দিল্লি-সহ উত্তর ভারতের শহরগুলিতে বসবাস কী কঠিন ছিল অল্পদিনের জন্য কাজেকম্মে গিয়েও টের পাওয়া যেত। সর্বক্ষণ জঙ্গি হামলা, বিস্ফোরণ, গুলিবৃষ্টির শঙ্কা বুকে নিয়ে পথ চলতে হত। কিন্তু ইন্দিরার দল স্বর্ণ মন্দিরে সেনা অভিযান, দিল্লি দাঙ্গার জন্য কংগ্রেস দলগতভাবে ক্ষমা চেয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এসবের ত্রিসীমানা মারাননি।
প্রধানমন্ত্রী এর আগে গান্ধী পরিবারকে আক্রমণ করতে গিয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, পদবিই যখন ধার করবেন তখন নেহরু পদবি কেন নিলেন না। তিনি আসলে সনিয়া, রাহুল, প্রিয়াঙ্কাদের গান্ধী পদবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আসলে এখানেও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ একটি সত্যকে গুলিয়ে দিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। রাহুলের পিতামহ স্বাধীনতা সংগ্রামী, সাংবাদিক ও সাংসদ ফিরোজ গান্ধী ছিলেন মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা, আদিবাস ছিল গুজরাত। তাঁদের আসল পদবি ছিল গান্ডি। পার্সি ফিরোজের মা-বাবা ছিলেন রতিমাই এবং জাহাঙ্গির ফরিদুন গান্ডি। এলাহাবাদে নেহরুর বাড়ি আনন্দভবনে যাতায়াতের সুবাদে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তরুণ ফিরোজের আলাপ, ঘনিষ্ঠতা। গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নিজের পদবি গান্ডি থেকে গান্ধী করে নিয়েছিলেন ফিরোজ।
কম যান না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। রাহুল গান্ধীকে বিঁধতে জলজ্যান্ত মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি মহারাষ্ট্রের এক নিরীহ মহিলা তুলোচাষি কলাবতীকে অনাবশ্যক সংসদের ভাষণে টেনে এনে। দেড় দশক আগে সেই দুর্দশাগ্রস্ত মহিলার সঙ্গে দেখা করার পর রাহুল কিছুই করেননি অভিযোগ করার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, মোদী সরকারই ওই মহিলাকে পানীয় জল, বিদ্যুৎ, শৌচাগার দিয়েছে।
সেই মহিলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে জানিয়েছেন, তাঁর পাশে সর্বদা রাহুল গান্ধীই ছিলেন। তাঁর ঘরে বিজলি বাতি, রান্নার গ্যাস, শৌচাগার, সব কিছুই রাহুলের অবদান।
এত গেল মোদী-শাহের মিথ্যাচারের প্রসঙ্গ। কিন্তু সংসদে সেদিন বিরোধীরা কী করলেন? মোদীর দু ঘণ্টা ১৩ মিনিট বক্তৃতার দেড় ঘণ্টার মাথায় বিরোধীরা সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী মণিপুর নিয়ে মুখ না খোলায়। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বিরোধীরা ওয়াকআউট করার পর পরই মণিপুর নিয়ে দু-চার লাইন বলেন। প্রশ্ন হল, বিরোধীরা ওয়াক আউট করলেন কেন? আর করলেনই যদি প্রতীকী প্রতিবাদ করে সভায় ফিরে এলে প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যাচার নিয়ে চেপে ধরতে পারতেন। অনাস্থা বিতর্কের নিয়ম হল জবাবি ভাষণের পর প্রস্তাবক প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতে পারেন। দল তথা ইন্ডিয়া জোটের ভুলে সেদিন যে সুযোগ পাননি অনাস্থা প্রস্তাবের প্রস্তাবক গৌরব গগৈ। সেদিন বিরোধীরাই প্রধানমন্ত্রীকে ফাঁকা মাঠে গোল করার সুযোগ করে দেন। সেই সুযোগে মোদী বিরোধীদের শূন্য বেঞ্চের দিকে পাল্টা প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিয়েছেন।
সংসদের পরপর পর দুটি অধিবেশন উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ ছাড়াই শেষ হয়ে গেল। বাজেট অধিবেশনে বিরোধীরা আদানি ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে অটল থাকলেন। এবারের দাবি ছিল, মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা ভঙ্গ। অথচ জানাই আছে, নরেন্দ্র মোদী সংসদীয় রীতিনীতি, দায়িত্ব, কর্তব্যের প্রতি ততটা আস্থাশীল নন, যিনি এই দাবির কাছে মাথা নোয়াবেন। বরং, বিরোধীদের লাগাতার বয়কটে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরকারকে কার্যত কোনও জবাবদিহিই করতে হল না।
শেষ করব রাহুল গান্ধীর প্রসঙ্গ দিয়ে। তিনি মণিপুর ও ভারত মাতার প্রসঙ্গ টেনে জোরালো আক্রমণ করে সরকারকে যতটা অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন, ঠিক ততটাই কবর খুঁড়েছেন ভাষণ শেষে ফ্লাইং কিস দিয়ে। সেই দৃশ্য লোকসভা টিভির পর্দায় প্রায় কেউই নজর করেননি। দেশবাসীকে তা জানিয়েছে বিজেপি। পদ্ম শিবিরের মহিলা এমপিরা স্পিকারের কাছে নালিশ ঠুকেছেন। কোনও সন্দেহ নেই রাহুলকে অপদস্থ করাই এর লক্ষ্য। লোকসভার স্পিকার কী রায় শোনাবেন জানি না, তবে আইনের চোখে এই আচরণ অপরাধ নয়।
আবার এটাও খেয়াল রাখা দরকার, আচার-আচরণে আইন শেষ কথা বলে না এবং তা দেশ-কাল-সমাজের ঊর্ধ্বে নয়। আমাদের দেশে এখনও এই ধরনের আচরণ সবজনগ্রাহ্য হয়নি। বরং মানুষ এগুলিকে খুব লঘু চোখে দেখে। ছেলেপুলেরা করে এক জিনিস। মাঝবয়সির এমন আচরণ ভালভাবে নেয় না। রাহুল গান্ধীর মনে রাখা দরকার সংসদে বসে চোখ মারা, ফ্লাইং কিস দেওয়ার মতো শিশু সুলভ আচরণ করে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া দূরে থাক, কংগ্রেসের মুখ থাকাও বেশিদিন সম্ভব হবে না।
আরও পড়ুন: জ্যোতিবাবু সেদিন প্রধানমন্ত্রী হলে…