শুভেন্দু অধিকারী ও মুকুল রায়।
শেষ আপডেট: 19th July 2024 18:53
বুধবার থেকে বাংলা বিজেপিতে একটা চাপানউতোর চলছে। কারণ, শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, লোকসভা ভোটে প্রমাণ হয়ে গেছে। বাংলায় বিজেপি মুসলিম ভোট পায়নি। সুতরাং যারা বিজেপির পাশে নেই, বিজেপিও তাদের পাশে থাকবে না।
এর মোদ্দা অর্থ হল, বিজেপি শুধু হিন্দুদের পাশে থাকবে। হিন্দুদের আবেগ ও স্বার্থ নিয়ে কথা বলবে। অর্থাৎ উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতি করবে। শুভেন্দুর এ কথা সর্বভারতীয় বিজেপির লাইন থেকে বিচ্যুত ভাবলে হয়তো ভুল হবে। বরং, খেয়াল করলে দেখা যাবে বিজেপি ‘একই সূত্রে বাঁধিয়াছে সহস্র জীবন’। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলছেন, কাওয়াঁর যাত্রা যে পথ দিয়ে যাবে সেখানে সব দোকানের গায়ে নাম লেখা থাকতে হবে। মানে নাম দেখে যাতে কাঁওয়ার যাত্রীরা বুঝে নিতে পারেন, সেটা হিন্দুর দোকান না মুসলমানের। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলছেন, তাঁর রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ৪০ শতাংশ ছুঁয়েছে। এটা তাঁর কাছে কোনও রাজনৈতিক সমস্যা নয়, মরণ-বাঁচন সমস্যা। আর শুভেন্দু বলছেন, বাংলায় বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চাই তুলে দেওয়া হোক।
এই লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে বিজেপির হিন্দু ভোটেও ধস নেমেছে। অসমে বিজেপির ভোট শতাংশ অতি সামান্য হলেও ছাপিয়ে গেছে কংগ্রেস। আর বাংলায় বিজেপির আসন কমে ১৮ থেকে হয়েছে ১২টি। বিজেপি বিশ্রাম নিতে জানে না। একটা ভোট হয়ে গেলেই পরের ভোটের কথা ভাবতে শুরু করে। সুতরাং পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, একটা তীব্র মেরুকরণের নকশা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হল, বাংলায় এই মেরুকরণ বিজেপির জন্য কতটা ফলদায়ক হতে পারে? শুধু এই এক অস্ত্রে শান দিয়ে কি বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে পারবে বিজেপি?
উনিশের লোকসভা ভোটে বাংলায় বিজেপির অন্যতম কুশলী ছিলেন মুকুল রায়। অমিত শাহ শহিদ মিনারে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ১৮টি আসন জেতার পিছনে বড় ক্রেডিট রয়েছে মুকুল রায়ের। একুশের বিধানসভা ভোটের সময়ে সেই মুকুলকে যখন একেবারে কোণঠাসা করে রেখেছেন দিলীপ ঘোষ-শিবপ্রকাশরা, তখন সল্টলেকে ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে বসে মুকুল বারবার বলতেন, 'এভাবে পারবেন না। বিজেপি বাংলায় ১০০ পার করবে না।'
কেন এমনটা বলতেন মুকুল রায়?
দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূল কংগ্রেসে অঘোষিত নাম্বার টু ছিলেন মুকুল। বরাবরই ঠান্ডা মাথা। মমতা ভরসাও করতেন। এক সময়ে বাংলা সংবাদমাধ্যমে মুকুল রায়কে প্রয়াত সিপিএম রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের সঙ্গেও তুলনা করা হত। মুকুলের বক্তব্য ছিল, বাংলায় অন্তত ৭০ থেকে ৭৫টি বিধানসভা আসন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। অর্থাৎ সেখানে সংখ্যালঘু ভোট যেদিকে যাবে, তারাই জিতবে। সুতরাং রাজ্যে ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল ভোটে নামবে ৭০টি আসন হাতে নিয়ে। আর বিজেপিকে ২২০টি আসনের মধ্যে ১৪৮টি জিততে হবে। যা খুবই কঠিন শুধু নয়, অসম্ভবও।
সল্টলেকের ওই ফ্ল্যাটে বসেই বিজেপি নেতাদের মুকুল বলেছিলেন, বাংলায় মুসলমানদের পুরোপুরি বাদ দিয়ে বিজেপি কখনও ক্ষমতা দখল করতে পারবে না। কারণ, তীব্র মুসলিম বিরোধিতা করলে সেই ভোটের প্রায় সবটা তৃণমূলের দিকে চলে যাবে। সেই সঙ্গে বেনিফিশিয়ারি ভোট এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজস্ব ভোট রয়েছে। সুতরাং এমন কিছু করতে হবে যাতে সংখ্যালঘুদেরও একাংশের মধ্যে বিজেপির উপর আস্থা তৈরি হয়।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে শুভেন্দু অধিকারী সমাবেশি রাজনীতি করতেন। নন্দীগ্রামে সংখ্যালঘুদের অনেকের প্রিয়পাত্র ছিলেন শুভেন্দু। অথচ সেই তিনি এখন এতটা উগ্র হিন্দু কথা বলেন যে, নন্দীগ্রামের সংখ্যালঘুদের বড় অংশের কাছে অপরিচিত ঠেকে।
প্রবীণ এক কংগ্রেস নেতার কথায়, বিজেপি এখন যে সমস্যা ভুগছে, অতীতে প্রায় সেই একই ভুল করে গেছিল কংগ্রেস। মুসলিম ভোট পাওয়ার ব্যাপারে কংগ্রেসের সমস্যা ছিল না। কিন্তু রাজ্যে ৭৭টি আসন এমন রয়েছে যা তফসিলি জাতি ও উপজাতি অধ্যুষিত। এই আসনগুলি সারাবছর ধরে লালনপালন করত সিপিএম তথা বামেরা। এবং ওই আসনগুলিতে কংগ্রেস মোটেও জিতত না। ৯৬ সালে বাংলায় কংগ্রেস বাংলায় ৮২টি আসনে জিতলেও তফসিলি আসনগুলিতে একেবারেই জিততে পারেনি। অর্থাৎ রাজ্যের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে বা তাদের আস্থার পরোয়া না করে ভোটে ভাল ফল করা যাবে না।
শুভেন্দুরা হয়তো অবশ্য অন্য কথা ভাবছেন। তাঁরা মনে করছেন, যত চেষ্টাই করা হোক না কেন সংখ্যালঘু ভোট বিজেপি পাবে না। তুলনায় নওসাদ সিদ্দিকির মতো পার্টি যদি মুসলিম ভোটে কিছুটা ভাঙন ধরাতে পারে তাহলে ভাল হয়। আর বিজেপি প্রতিষ্ঠা বিরোধিতার বিষয়আশয় তুলে ধরার পাশাপাশি হিন্দুত্বের ধ্বজা তুললে ব্যাপারটা কার্যকরী হতে পারে। লোকসভা ভোটেও দেখা গেছে, বাম ও কংগ্রেস প্রায় ১২ শতাংশ ভোটে কেটেছে। বিজেপির ভোট শতাংশ দাঁড়িয়েছে ৩৮ শতাংশে। সুতরাং তীব্র মেরুকরণের মাধ্যমে বাম-কংগ্রেসের ভোট যদি আরও ৫-৬ শতাংশ কমানো যায় তাহলে ভাল লড়াইয়ে চলে আসবে বিজেপি।