শেষ আপডেট: 29th August 2023 13:25
দত্তপুকুরে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের পরে পরিযায়ী শ্রমিকদের (Migrant Labours) দুর্দশা নিয়ে ফের আলোচনা হচ্ছে। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে তবেই তাঁদের কথা সকলের মনে পড়ে।
রবিবার সকাল সাড়ে ন'টা নাগাদ দত্তপুকুর থানার মোষপোল এলাকা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে। যে একতলা বাড়িটিতে বাজি বানানো হচ্ছিল, সেটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। কারখানায় তখন ১০ জন উপস্থিত ছিলেন।
বিস্ফোরণের তীব্রতায় তাঁদের কারও হাত, কারও পা ছিটকে পড়ে বহুদূরে। মঙ্গলবার পর্যন্ত পাওয়া খবরে জানা যায়, মৃত্যু হয়েছে মোট ন'জনের। তাঁদের মধ্যে ছ'জন পরিযায়ী শ্রমিক। পাঁচজনের বাড়ি মুর্শিদাবাদে। একজন ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা।
উত্তরটা সহজ। নিজের রাজ্যে কর্মসংস্থান হয় না বলেই তাঁদের যেতে হয়। কিন্তু ভিন দেশে শ্রমিক হিসাবে কোনও আইনি অধিকার তাঁরা পান না। অর্থাৎ সংবিধানে শ্রমিকদের জন্য যে ন্যূনতম মজুরি, সুরক্ষা বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথা বলা আছে, তা পরিযায়ীদের কেউ দেয় না। ভিন জায়গায় গিয়ে শ্রমিকরা অনেকাংশে অসহায় হয়ে পড়েন। তাঁদের হয়ে বলার কেউ থাকে না। সেই সুযোগে নিয়োগকর্তারা তাঁদের নানাভাবে ঠকায়। বেতন কম তো দেয়ই, সেই সঙ্গে সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজে তাঁদের নিয়োগ করা হয়। কর্মরত অবস্থায় মারা গেলেও তাঁদের পরিজনরা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় না।
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কারও কাছে বিশেষ তথ্য নেই। অর্থাৎ কোন রাজ্য বা জেলা থেকে কতজন মানুষ ভিন জায়গায় কাজ করতে গিয়েছেন, তাঁরা কোন শিল্পে নিযুক্ত আছেন, কত বেতন পান, আর কী কী সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন, তা নিয়ে কেন্দ্র বা রাজ্য কেউই বিশেষ মাথা ঘামায় না।
কোভিড অতিমহামারীর সময় প্রায় এক কোটি পরিযায়ী শ্রমিক কর্মস্থল ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। তাঁদের মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী মহিলা সকলেই ছিলেন। কঠোর লকডাউনের মধ্যে তাঁরা শত শত মাইল অতিক্রম করেন। পথের কষ্টে অনেকের মৃত্যু হয়।
কিন্তু ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মোদী সরকার লোকসভায় জানায়, কতজন পরিযায়ী শ্রমিক মারা গিয়েছেন, সে বিষয়ে সরকারের কাছে কোনও তথ্য নেই। অর্থাৎ সরকার পরিযায়ীদের মৃত্যু নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি। সরকারই যদি এমন উদাসীন হয় তাহলে মালিকরা তো পরিযায়ীদের ঠকাবেই।
গত জুন মাসে ওড়িশার বালেশ্বর জেলায় তিনটি ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের এক বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক। মাসখানেক আগে মুম্বইতে বহুতলে কাজ করতে গিয়ে মারা যান রাজ্যের দুই পরিযায়ী। সম্প্রতি মিজোরামে নির্মীয়মাণ রেলসেতু ভেঙে রাজ্যের দু'জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
কিছুদিন আগে রাজ্য সরকার পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদকে পুনর্গঠন করেছে। শ্রমিকদের যাতে বাইরে কাজে যেতে না হয়, সেজন্য নানা প্রকল্পও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলি কবে বাস্তবায়িত হবে, হলেও পরিযায়ীদের দুর্দশা আদৌ ঘুচবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে যথেষ্ট।
পশ্চিমবঙ্গে মূলত বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা থেকে শ্রমিকরা ভিন জায়গায় কাজ করতে যান। এই প্রসঙ্গ তুলে এখন বিরোধীরা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যে উন্নয়ন হয়নি বলেই মানুষকে ভিন রাজ্যে কাজে যেতে হচ্ছে। তাঁদের কথা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে মনে রাখতে হবে, শুধু পশ্চিমবঙ্গ থেকেই যে শ্রমিকরা ভিন রাজ্যে যান, তা নয়। অসম, মধ্যপ্রদেশ,, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও রাজস্থানের কিছু এলাকা থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষকে কাজের খোঁজে বাইরে পাড়ি দিতে হয়।
নরেন্দ্র মোদী একসময় বছর ২ কোটি কর্মসংস্থানের কথা বলেছিলেন। এই প্রতিশ্রুতির কিছুমাত্র পূরণ করতে পারলেও পরিযায়ীর সংখ্যা এত বাড়ত না।
শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধির পিছনেও কেন্দ্রীয় সরকারের বড় ভূমিকা আছে। এরাজ্যে এখন ১০০ দিনের কাজের টাকা আসছে না। 'দুর্নীতি'-র জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ওই টাকা দেওয়া বন্ধ করেছে। সেজন্য অনেকে অন্নসংস্থানের জন্য বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলায় ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করেছে মোদী সরকার, তাই কি পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে
কেন্দ্রীয় সরকার এইভাবে ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকাতে পারে না। কাজ পাওয়া প্রত্যেকের সাংবিধানিক অধিকার। দুর্নীতি হলে সরকার তদন্ত করুক। দোষীদের জেলে পুরে দিক। কিন্তু কয়েকজনের দুর্নীতির জন্য নাগরিকদের কাজ পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কেন?
পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা দরকার। মানুষ কাজের সন্ধানে বাসভূমি ছেড়ে যেতেই পারে। কিন্তু ভিন জায়গায় গিয়ে যাতে অবিচারের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই তাঁদের অপমৃত্যু ঠেকানো যাবে।