একুশের মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।
শেষ আপডেট: 21st July 2024 09:26
২১ জুলাই শুধু তৃণমূল কংগ্রেস নয়, বঙ্গ-রাজনীতিতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। যেমন ৩১ আগস্ট। ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিল যুব কংগ্রেস। তিনি তখন যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভানেত্রী। অভিযানকারীদের ঠেকাতে পুলিশ গুলি চালালে ১৩টি তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যায়।
অদম্য সাহসী আন্দোলনকারীরা সব বাধা উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মরিয়া চেষ্টা করলে, পুলিশ গুলি চালায়। ৩১ বছর আগে ধর্মতলা এবং রাইটার্স বিল্ডিংয়ের চারপাশে সেই পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে যুব কংগ্রেসের রাইটার্স অভিযানের দিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও পুলিশের লাঠির বাড়ি আর টিয়ার গ্যাসের মুখে আহত হন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
৬৫ বছর আগে, ১৯৫৯-এর ৩১ গস্ট ওই ধর্মতলা চত্বরেই কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন ভাতের দাবিতে। রাজ্যে তখন তীব্র খাদ্য সংকট। বুভুক্ষু সেই মানুষেরাও সেদিন রাইটার্স বিল্ডিংস অভিযানের জন্য জড়ো হয়েছিলেন। বামপন্থীদের ডাকে শহিদ মিনার ময়দানের সেই জমায়েত ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যে লাঠির আঘাত আর পদপিষ্ট হয়ে ৮০ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি, পুলিশ বহু লাশ পাচার করে দিয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলায় গণ-আন্দোলনের তালিকা দীর্ঘ। ছোট-বড় সব বাম দলই একটা সময় মাঠে-ময়দানে মানুষের দাবি নিয়ে আন্দোলনে ব্যস্ত থাকত। শিক্ষক-সরকারি কর্মচারীদের দাবিদাওয়া, ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন তার অন্যতম। সে গণ আন্দোলন জ্যোতি বসুকে বিরোধী শিবিরের মুখ করে তুলেছিল। আবার এসইউসিআই-এর মতো ছোট দলটি বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শাসনে মাঠে-ময়দানেই কাটিয়েছে। নয়ের দশকের মাঝামাঝি ধর্মতলাতেই এক আইন অমান্য আন্দোলনে ওই দলের কর্মী মাধাই হালদার পুলিশের গুলিতে মারা যান। ঘটনাচক্রে দিনটি ছিল ৩১ অগস্ট, অর্থাৎ খাদ্য আন্দোলনের শহিদদের স্মরণ করার দিন।
১৯৫৯-এ বামপন্থীদের খাদ্য আন্দোলন আর তার ৩৪ বছর পরে ১৯৯৩-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাইটার্স বিল্ডিংয় অভিযানের কথা আলাদা করে উল্লেখ করার কারণ, এই দুই আন্দোলনের সূত্রে বাংলার রাজনীতির অভিমুখ অনেকটাই বদলে গিয়েছিল। মাঝে নকশালপন্থীদের সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ডাক রাজনীতিকে উত্তাল ও অশান্ত করে তুললেও তা স্থায়ী হয়নি। সেই রাজনীতি দমনে পুলিশি নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন সীমা ছাড়ায়। নকশালপন্থীদের খুনের রাজনীতিকেও মানুষ প্রত্যাখ্যান করে।
খাদ্য আন্দোলনের পথ ধরে জনস্বার্থবাহী ইস্যুতে বাম দলগুলির লাগাতার আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের পায়ের তলার মাটি কেড়ে নেয়। ওই আন্দোলনের দশক পেরোনোর আগেই কংগ্রেস বাংলায় ক্ষমতাচ্যুত হয়। ১৯৬৭ ও ৬৯, দু-দু'টি যুক্তফ্রন্ট সরকারের কাণ্ডারী ছিল সিপিএম। ১৯৭৭ সালে সেই সিপিএম সরকারের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার পিছনে যুক্তফ্রন্ট সরকারের বহু সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব ছিল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ২১ জুলাই নিয়ে একটি আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘২১ জুলাই বাংলার ইতিহাসে রক্তঝরা এক দিন। অত্যাচারী সিপিআইএম-এর নির্দেশে সেদিন চলে গিয়েছিল তরতাজা ১৩টি প্রাণ। আমি হারিয়েছিলাম আমার ১৩ জন সহযোদ্ধাকে। তাই ২১ জুলাই আমার কাছে, আমাদের কাছে একটা আবেগ।’
আজকের তৃণমূল নেত্রী, যেদিনের যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মহাকরণ অভিযানের সময় ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারের বয়স ছিল ১৬। পরপর তিনটি বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়। তবে তা বিধানসভার আসনের নিরিখে। ভোটের অঙ্কে সিপিএমের সঙ্গে বিরোধী কংগ্রেসের তেমন একটা ফারাক ছিল না। অর্থাৎ বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও গনিখান চৌধুরী, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সোমেন মিত্ররা কংগ্রেসের নেতৃত্বে ২১ জুলাইয়ের মতো কোনও গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। পারেননি জন-আন্দোলনের মুখ হতে। এখানেই দলের পুরুষ নেতৃত্বকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যান মমতা।
২১ জুলাইয়ের অভিযানের মাস আটেক আগে যুব কংগ্রেসের ডাকে মমতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের কূল ছাপানো সভা (১৯৯২-এর ২৫ নভেম্বর) থেকেও ইঙ্গিত মিলেছিল রাজ্যের বিরোধী শিবিরের মানুষ ওই ছাপোষা তরুণীকেই নেতৃত্বের সামনের সারিতে দেখতে চাইছেন। ‘বামফ্রন্টের মৃত্যুঘণ্টা বাজানো’র সেই সমাবেশের ভিড়ে বিচলিত সিপিএম কালক্ষেপ না করে চারদিনের মাথায় একই ময়দানে ভিড়ের রেকর্ড করে জানান দিয়েছিল, তাদের টলানো কঠিন। বাম কর্মী-সমর্থকদের মুখে স্লোগান শোনা গিয়েছিল ‘আয় দেখে যা মমতা, বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতা’, ‘আয় দেখে যা মমতা, জ্যোতি বসুর ক্ষমতা’ ইত্যাদি।
জ্যোতিবাবুদের কথায় স্পষ্ট ছিল, তাঁরা তখনই বুঝেছিলেন, কংগ্রেসের পুরুষ নেতৃত্ব নয়, আগামী দিনে তাঁদের মোকাবিলা করতে হবে ওই তরুণীকে। প্রবীণ সাংবাদিকদের অনেকের মুখেই যেমন শুনেছি, জ্যোতি বসু যে একদিন রাইটার্সে তাঁর উত্তরসূরি হবেন, প্রথম তা অনুধাবন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের পতন ঘটিয়ে রাজ্যের কুর্শি দখল করেন। মমতা নিজের দল গঠনের দু'বছরের মাথায় জ্যোতিবাবু মুখ্যমন্ত্রিত্বের ব্যাটন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ফলে ভোটের ময়দানে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে মমতার মোকাবিলা হয়নি। হলে ফলাফল কী হত, বলা কঠিন।
তবে একথা খেলায় রাখা দরকার, জ্যোতিবাবু মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে সরে যাওয়ার আগের দু'বছরে লোকসভার দুটি অন্তর্বর্তী নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সদ্য তৈরি তৃণমূল অবাক করা ফল করে। সেই দুই নির্বাচনে সদ্য জন্ম নেওয়া তৃণমূল বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়া করলেও, ততদিনে রাজ্যে মমতার নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মাঠে-ময়দানে তাঁর সভায় গরিব মানুষের কূল ছাপানো ভিড়ের ছবিতেই স্পষ্ট ছিল, বামফ্রন্ট সরকার ঠিক পথে হাঁটছে না।
সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ ১৩ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সক্রিয় রাজনীতি থেকে ক্রমে সরে গিয়েছেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এখন অবশ্য গুরুতর অসুস্থ। তৃণমূল নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগেই রাজ্য-রাজ্যনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা হারান প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সোমেন মিত্র, সুব্রত মুখোপাধ্যায়েরা, ছাত্র-যুব আন্দোলনের সময় থেকে যাঁদের ভবিষ্যতের নেতা মনে করা হত। দিল্লিতে কংগ্রেসের ক্ষমতার করিডরে যাঁদের গতিবিধি ছিল অবাধ। তিনজনই ইন্দিরা, রাজীব, সনিয়ার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রিয়রঞ্জন, অজিত পাঁজারা দিল্লির সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা পূর্ণ না হলেও দেশের রাষ্ট্রপতি হন প্রণব। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, অজিত পাঁজারা অকালে চলে না গেলে হয়তো দিল্লিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক সামলাতেন। কিন্তু তাঁরা কেউ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন কিনা সন্দেহ। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সে যোগ্যতা ছিল, হলে হয়তো রাজ্যের মঙ্গলই হত। কিন্তু তাঁরও সেই জায়গায় পৌঁছোনোর মতো নেতৃত্বের জোর ছিল না। রাজ্য-রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী লেখা আছে, বলা মুশকিল। তবে দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারেরাও তৃণমূল নেত্রীকে জব্দ করতে পারেননি। ব্যর্থ হয়েছে মোদী-শাহ জুটির তিনবারের চেষ্টাও।
বাকিরা যখন ব্যর্থ, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী করে সফল? পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতিতে তিনি কীভাবে ভেসে আছেন? কারও সম্পর্কেই এমন প্রশ্নের জবাব অল্পকথায় লিপিবদ্ধ করা কঠিন। সংক্ষেপে বলা চলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানা গুণাবলির একটি হল, ১৩ বছর ক্ষমতার কুর্শিতে বসার পরেও তিনি যতটা না মুখ্যমন্ত্রী, তার চেয়ে ঢের বেশি বিরোধী নেত্রী। কথাবার্তা, চালচলন, মেলামেশায় এখনও তিরিশ বছর আগের মেজাজ ধরা পরে, এমনকী তাঁর প্রশাসনিক বৈঠকগুলিতেও। সেই তিনি দলের সভা থেকে আজও যখন সাধারণ কর্মীর মতো স্লোগান দেন, ‘সামনে কারা তৃণমূল’, ‘ডাইনে কারা তৃণমূল’, ‘বাঁয়ে কারা তৃণমূল’, ‘আসছে কারা তৃণমূল’, তখন মনে হয় না, সেই ২০১১ থেকে তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
তাঁর সরকারের সময়ে প্রশাসনের চুরি-দুর্নীতি মাত্রা ছাড়িয়েছে। মুদ্রার অন্য পিঠে আছে গরিব মানুষের জন্য তাঁর সরকারের কল্যাণ কর্মসূচি। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গ-রাজনীতিতে অগ্নিকন্যা হিসাবে নির্মাণ পর্বে যে গরিব মানুষ তাঁর পিছু নিত, আপদে-বিপদে পড়তে ‘মমতা ব্যানার্জীকে বলে দেব’, ‘দিদিকে খবর দে’ বলে চিৎকার জুড়ে দিত, সেই মানুষ এখনও তাঁর রাজনীতির প্রহরী। আর সচেতনভাবেই তিনি ২১ জুলাইয়ের মতো পুলিশের গুলি চালনার পুনরাবৃত্তি এই ১৩ বছরে হতে দেননি, যে ঘটনা তাঁর ১৩ সমকর্মীকে কেড়ে নিয়েছিল। তাঁর পুলিশ বিশিষ্টজনের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় শূন্যে গুলি চালিয়েছে বেশি। সেটা পুলিশের কৃতিত্ব, নাকি বিরোধীদের ব্যর্থতা যে তাঁরা ২১ জুলাইয়ের মতো প্রতিবাদ সংঘঠিত করতে পারেননি, তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে।
তাই বলে তৃণমূল নেত্রী কি পুরোপুরি বিপন্মুক্ত? সদ্য সমাপ্ত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের অভাবনীয় সাফল্যের মধ্যেই আছে বিপদের গন্ধ। লোকসভার ভোটে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে যে ভোটার বাম-কংগ্রেসকে ভরসা না করে তৃণমূলকে জিতিয়ে দিয়েছে, বিধানসভা ভোটে তাঁরাই একই যুক্তিতে জোড়াফুলের বিরোধিতায় পদ্মের দিকে ঝুঁকবে না, কে বলতে পারে! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই সে ব্যাপারে সচেতন।