শেষ আপডেট: 19th October 2022 16:42
কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ফের মনোনীত হয়েছেন ডি রাজা। কমিউনিস্ট পার্টিগুলির দুর্দিন চলছে। ফলে সংবাদমাধ্যমও খুব একটা খবর রাখে না কবে কোথায় সিপিআইয়ের পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হল। এবার হয়েছে দক্ষিণের শহর বিজয়ওয়াড়ায়।
কিডনি বদলাতে সিঙ্গাপুরে গিয়েছেন লালু প্রসাদ যাদব। রোগভোগে চলাফেরায় শক্তি হারিয়েছেন তিনি। কিন্তু সিঙ্গাপুরের বিমান ধরার আগে ফের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সভাপতি মনোনীত হয়েছেন সেই তিনিই। এই নিয়ে ১২ বার।
৮ অক্টোবর মারা গেলেন মুলায়ম সিং যাদব। তিনি যখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, তখনই অনুষ্ঠিত হয় সমাজবাদী পার্টির রাষ্ট্রীয় সম্মেলন। ফের দলের সভাপতি হয়েছেন মুলায়ম পুত্র অখিলেশ।
সম্মেলন ডেকে এই তিন দলের শীর্ষ পদে নেতাদের যখন মনোনীত করা হল তখন যখন কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচন নিয়ে চর্চা ছিল তুঙ্গে।
কংগ্রেসও ২২ বছর পর সভাপতি পদে নির্বাচন (congress president) হল। ২০০০ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে সভাপতি হয়ে হন সনিয়া গান্ধী (Sonia Gandhi)। তবে সেটা দ্বিতীয়বারের জন্য। প্রথমবার শীর্ষপদে বসেন প্রবীণ সীতারাম কেশরিকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে। যাকে বলে পলিটিক্যাল ক্যু।
২০০০ সালের পর সনিয়া সভাপতি হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। রাহুল গান্ধীও তাই। ১৩৭ বছরের পুরনো দলটির বিরুদ্ধে তাই প্রধান অভিযোগ ছিল দুটি। এক, দল গান্ধী পরিবারের কুক্ষিগত। দুই, দলের অন্দরে গণতন্ত্র নেই।
এবার ভোটের মধ্য দিয়ে কংগ্রেস বেছে নিল নতুন সভাপতি, এবং তিনি গান্ধী পরিবারের বাইরের ব্যক্তি। হতে পারে, তিনি গান্ধী পরিবারের অনুগত। হতে পারে, তিনি ছিলেন গান্ধী পরিবারের পছন্দের প্রার্থী। ভোটের ফল বলছে, গান্ধী পরিবারের প্রতি আনুগত্য শুধু দিল্লিবাসী বা রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতাশালী কিছু কংগ্রেস নেতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কংগ্রেসের নিচুতলাতেও গান্ধীদের প্রতি আস্থার ঢল অটুট। ফলে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনের ভোট এবার দলকে অনেক গ্লানি থেকে মুক্তি দিল বলা যায়।
এর কৃতিত্ব গান্ধী পরিবারের পাশাপাশী শশী তারুরেরও (Sashi Tharoor)। শত অনুরোধেও রাহুল গান্ধী এখন আর সভাপতি হতে চাননি। চাননি গান্ধী পরিবারের কেউ হোন। আর রাহুলরা প্রার্থী হলে ভোটাভুটি হত না, এটাও স্বতঃসিদ্ধ ছিল বলা চলে। সভাপতি ভোটে যে ৪১৬ জনের ব্যালট বাতিল হয়েছে, তার অনেকগুলিতে কংগ্রেসের সেই ভোটাররা তৃতীয় প্রার্থী হিসাবে রাহুল গান্ধীর নাম লিখে তারপর তাতে টিক মেরেছেন। ফলে কংগ্রেস কর্মীদের মনে গান্ধী পরিবারের অধিষ্ঠান নিয়ে গবেষণা চলতে পারে, উপেক্ষা করা কঠিন।
শশীকে কৃতিত্ব দিতে হচ্ছে এই কারণে যে, বিপুল ব্যবধানে হার নিশ্চিত জেনেও তিনি লড়াইয়ে থেকে গিয়েছেন। ভরাডুবির ভয়ে পিছিয়ে যাননি। ফলে খাড়্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব নিতে চলেছেন। কংগ্রেসের অন্দরের গণতন্ত্র এবং দেশের জন্যও এটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, সন্দেহ নেই।
শশী গোড়া থেকেই বলেছিলেন, দলে গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল ফেরানো তাঁর লক্ষ্য। উদ্দেশ্য, দলকে পরিবার, দরবারের বাইরে বের করে আনা। তারুর তাঁর কর্তব্য পালন করেছেন। বাকিটা গান্ধী পরিবার ও কংগ্রেসের বাকিদের।
বিজেপি প্রচার করেছে, যে ২৪ বছর কংগ্রেস গান্ধী পরিবারের কুক্ষিগত ছিল সেই সময়কালের মধ্যে তাদের নয় জন সভাপতি হয়েছেন। কিন্তু জেনে রাখা ভাল, জন্মের পর বিগত ৪১ বছরে ওই দলের একজন সভাপতিও দলের ভোটে লড়াই করে শীর্ষ পদে বসেননি। অমিত শাহ, জেপি নাড্ডারা সভাপতি হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী, মোহন ভাগবতদের ইচ্ছায়, সমর্থনে। রাজনাথ সিং, নীতিন গড়কড়িরা দলের শীর্ষ পদে বসতে পেরেছিলেন আরএসএসের ইচ্ছায়। বিজেপিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের কোনও বালাই নেই। মোদীর জমানায় সভাপতিও ল্যাম্পপোস্ট মাত্র। মোদী-শাহ'ই শেষ কথা।
আঞ্চলিক দলগুলি আবার প্রবলভাবেই ব্যক্তিতন্ত্রিক। মুলায়ম ছেলেকে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার ছেড়ে দিয়েছিলেন, লালুপ্রসাদ সেখানে গোটা পরিবারকেই আরজেডির গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রেখেছেন। তাঁর অবর্তমানে ছেলে তেজস্বী কিংবা মেয়ে মিশা শীর্ষ পদে বসবেন, কে না জানে।
মাস কয়েক আগে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে তৃণমূলের সম্মেলন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের চেয়ারপারসন মনোনীত হয়েছেন। ওড়িশায় বিজেডি, অন্ধ্রে ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তেলেঙ্গানায় টিআরএস, তামিলনাড়ুতে ডিএমকে, সর্বত্রই এক চিত্র। ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারই দলের হকদার।
দক্ষিণপন্থী পার্টিগুলিতে যা ব্যক্তি ও পরিবার তন্ত্র, কমিউনিস্ট পার্টিতে সেটাই দলতন্ত্র। পার্টি কংগ্রেসে বিদায়ী সেন্ট্রাল কমিটির পেশ করা প্যানেল খানিক এধার অধার করে ঠিক হয় পরের কমিটি। পার্টির সাধারণ সম্পাদক ঠিক করাই থাকে। পার্টি কংগ্রেসে প্রতিনিধিরা হাত তুলে স্বাগত জানান তাঁকে। এক দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া ভোটাভুটির বালাই নেই। নেতা-কমরেডের ইচ্ছাই শেষ কথা। সিপিএমে এবার কলকাতা সহ বেশ কিছু জেলায় সম্মেলনে ভোটাভুটি হয়েছে। কিন্তু প্রকাশ কারাটের পর কেন সীতারাম ইয়েচুরি পার্টির সাধারণ সম্পাদক হবেন, বৃন্দা কারাট কেন নন, তা নিয়ে পার্টিতে আলোচনার অবকাশ নেই। কতিপয় নেতাই ঠিক করেন পার্টির ভাগ্য।
ইদানীং বাংলায় জেগে ওঠা সিপিআইএমএলের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য টানা ২৪ বছর ওই পদে আছেন।
তবে, একথাও মানতে হবে, পার্টি পরিচালনায় বাম দলগুলিতে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল আছে। সীতারাম ইয়েচুরি বা ডি রাজারা চাইলেই কংগ্রেস, বিজেপি বা তৃণমূল সম্পর্কে কোনও নীতিগত অবস্থান ঘোষণা করতে পারবেন না। দলে আলোচনার পর বাইরে মুখ খুলতে পারবেন।
ফিরে আসি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে। জানাই ছিল শশী বিপুল ব্যবধানে হারবেন। তবু তাঁর পরাজয় গর্বের। কারণ তিনি দলে গণতন্ত্র ফেরানোর লক্ষে লড়াই করেছেন।
কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচনের শেষ যে দুটি ভোট হয়েছে, তার প্রথমটি অর্থাৎ সীতারাম কেশরীর বিরুদ্ধে শরদ পাওয়ার ও রাজেশ পাইলটের লড়াই ছিল নরসিংহ রাওয়ের পর দলে ক্ষমতা দখলের লড়াই। আর সনিয়ার বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশের জিতেন্দ্র প্রসাদের লড়াই ছিল বিদেশিনী ইস্যুতে একান্তই সনিয়ার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। শশীর লড়াই সেই কারণেই কংগ্রেসে এবং রাজনীতির ইতিহাসে লেখা থাকবে।