ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে আঞ্চলিক দলগুলি (local political parties), যেমন; তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, বিজু জনতা দল, অসম গণ পরিষদ, এআইএডিএমকে দলগুলি সত্যিই আন্তরিক? কেবলমাত্র রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্ত্রক হিসেবেই নয়, রাজনৈতিক শক্তির নিরিখেও আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির শক্তি হ্রাস ঘটুক, এটা কি মন থেকে চায় এই আঞ্চলিক দলগুলি, যাঁরা অন্তত এখনও পর্যন্ত খাতায় কলমে বিজেপি বিরোধী?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে অটলবিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভাতে ছিলেন। আরএসএসের একাধিক নেতৃত্ব প্রকাশ্যে তাঁর সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন। তবু মমতা নিজেকে বিজেপি-বিরোধী আইকন হিসেবে তুলে ধরার সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।একদা কংগ্রেস ছেড়ে আসা মমতা সম্পর্কে সমস্ত ইগো ঝেড়ে ফেলে ইতিবাচক মানসিকতা একাধিকবার দেখিয়েছেন স্বয়ং সোনিয়া গান্ধী। তবুও কংগ্রেসকে আক্রমণের পথ থেকে সরেননি তৃণমূল নেত্রী। বিজেপিকে যেভাবে আক্রমণ করছেন তিনি, তার শতগুণ শানিত ভঙ্গিমাতে আক্রমণ শানাছেন কংগ্রেসের প্রতি। বিজেপি সম্পর্কে বেশিরভাগ সময়েই অরাজনৈতিক আক্রমণ করে থাকেন মমতা। কিন্তু তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আজ পর্যন্ত বিজেপির মস্তিষ্ক আরএএস সম্পর্কে একটা শব্দও মমতা উচ্চারণ করেননি।
পাঁচ বছর আগে ত্রিপুরায় তৃণমূলকে মেলে ধরেছিল এআইটিসি। কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, যাঁদের নিয়ে তৃণমূলের ত্রিপুরা শাখা তৈরি হয়েছিল, ভোটের অল্পদিন পরেই তারা ত্রিপুরা বিজেপির নানা পদাধিকারী হয়ে যান। সাম্প্রদায়িকতা খুব বেশি ত্রিপুরার রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হবে না বলেই জাতিসত্তাভিত্তিক রাজনীতি সেখানে করে গিয়েছে বিজেপি।
জাতিবিদ্বেষ সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদেরই একটা পরিবর্তিত সংস্করণ। সেই সংস্করণকে ত্রিপুরার রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তুলে সেখানকার বামশক্তিকে কোণঠাসা করতে চেয়েছে বিজেপি। বামেদের উপর নানা ধরনের অত্যাচারের চালিয়েছে।খোদ রাজধানী আগরতলাতে সিপিআই(এম)-এর সদর দফতর এবং তাঁদের মুখপত্র 'ডেইলি দেশের কথা'-র দফতরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
ত্রিপুরায় বিধানসভার ভোট দরজায় কড়া নাড়ছে। পুরভোটের ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় সদ্যসমাপ্ত শারদোৎসবের কালে বাংলাদেশের কিছু ঘটনার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে গোটা ত্রিপুরাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুসলমানদের উপর সংগঠিত হামলা করছে আরএসএস এবং তাদের হরেক রকমের শাখা সংগঠন। এই অত্যাচারে বড় ভূমিকা পালন করছে সঙ্ঘের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি।
এই অত্যাচার সম্পর্কে তৃণমূল কিন্তু নীরব। তাবড় তৃণমূল নেতা ত্রিপুরা যাচ্ছেন। তাঁদের একজনও সেখানে হিন্দু জাগরণ মঞ্চ বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের হাতে আক্রান্ত গরিব মুসলমান সহনাগরিকদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। অতি সম্প্রতি একদম আদিম যুগের কায়দায় জনজাতিভুক্ত মানুষদের দিয়েও ত্রিপুরার গরিব মুসলমানদের উপর বর্বরোচিত আঘাত হানছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির। কিন্তু নিজেদের সংখ্যালঘুর বিপত্তারণ বলে দাবি করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর দলের একজনও ত্রিপুরায় হিন্দুত্ববাদীদের হাতে আক্রান্ত মুসলমান সমাজের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না।
এ বছর মে মাসে বিধানসভার ভোটের সময় বা তার আগে যাঁরা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছিলেন, মমতা তাঁদের অনেককেই আবার দলে ফিরিয়ে নিয়েছেন। মুকুল রায়, সব্যসাচী দত্ত, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়-- লিখতে গেলে তালিকা ক্রমে দীর্ঘই হবে। মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আইকন, এর পরেও কি আমাদের বলতে হবে? ত্রিপুরা থেকে গোয়া-বিরোধী শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনাকে ভেস্তে দিয়ে, বিজেপি বিরোধিতার অভিনয়ের ভিতর দিয়ে প্রকারান্তে মমতা বিজেপিকেই কি সাহায্য করছেন না?
তৃণমূল নেত্রীর এই রাজনৈতিক আচরণের পাশেই উঠে আসে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ভূমিকাও। মমতার ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটানোকে সাম্প্রতিক রাজনীতির ইতিহাসে যেমন একটা মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তেমনিই আইআইটি-র প্রাক্তনী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকেও মধ্যবিত্তের বৈঠকখানার পরমাত্মীয় করে তুলে ধরার রেওয়াজ তৈরি হয়ে গিয়েছে। সময় যত এগোচ্ছে তত এই ধরণের প্রবণতা ঘিরে সন্দেহ তীব্র হয়ে উঠছে। এই যে মমতা বা কেজরিওয়ালের ইমেজ বিল্ডিং, সেই চরিত্র নির্মাণের আড়ালে আরএসএসের সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নিপুণ কোনও কৌশল নেই তো?
দক্ষিণবঙ্গে ঝড়বৃষ্টি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই, ভিজবে কলকাতাও, সাত জেলায় হলুদ সতর্কতা
খড়গপুর আইআইটি-র প্রাক্তনী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে ঘিরে মধ্যবিত্ত ভারতবাসীর প্রচণ্ড উৎসাহ, যেমনটা গরিবগুর্বো দেশবাসীর আছে মমতাকে ঘিরে। এই অরবিন্দ কেজরিওয়ালকেও বিজেপি বা মোদীর বিকল্প মুখ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হয়। বিশেষ করে দিল্লি গণহত্যার কালো দিনগুলির ভিতরেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে কেজরিওয়ালের দিল্লির ক্ষমতা ধরে রাখার ঘটনাকে মধ্যবিত্ত আদৌ খাটো করে দেখে নি।
সেই কেজরিওয়াল বিজলি বাতি ব্যবহারে মধ্যবিত্তকে ছাড় দিয়েছেন। আবার এই মমতা স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার করেছেন। কেজরিওয়াল জলকর মকুব করেছেন। মমতা ওয়াকফের টাকায় ইমাম ভাতা দিয়েছেন, পুরোহিত ভাতাও দিচ্ছেন। এমন তুলনামূলক আলোচনার ভিতর দিয়ে এঁদের জনবাদী ইমেজ তৈরির কাজটা যখন অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে তখন অযোধ্যায় মন্দির দর্শনে দিল্লিবাসির জন্য স্কিম ঘোষণা করেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
কে কোন মন্দির- মসজিদ-গির্জা দেখতে যাবেন, তার সঙ্গে রাষ্ট্রের কী সম্পর্ক? বিতর্কিত ধর্মস্থান দেখার জন্যে রাষ্ট্র কেন তার রাজকোষের অর্থ খরচ করবে? কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধ্বংসে বদ্ধপরিকর। কিন্তু মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেও রাজ্য বিধানসভা ভবনের অভ্যন্তরে যখন জন্মাষ্টমী পালিত হয়, তখন কি আর রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে চপেটাঘাত করতে মোদী সরকারের ভূমিকার সাথে মমতার সরকারের এতোটুকু ফারাক থাকে? অরবিন্দ কেজরিওয়াল যখন উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের সঙ্গে কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তথাকথিত রামলালা দর্শনের পুরস্কার স্বরূপ দিল্লির প্রবীণ নাগরিকদের নগদ টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন তখন কি বিজেপির রাজনীতি সহজ হয়ে যায় না?
(মতামত লেখকের নিজস্ব)পড়ুন দ্য ওয়ালের সাহিত্য পত্রিকা 'সুখপাঠ'