
জলের অক্ষর পর্ব ৫
কুলদা রায়
ছেলেবেলায় গ্রামে বোরকা পরা মহিলাদের দেখেছি। তারা হয়তো হেঁটে হেঁটে কাছেপিঠের কোনও গ্রামে বাপের বাড়িতে যাচ্ছে। বা মেয়ের বাড়িতে যাচ্ছে। অথবা কবিরাজ বাড়িতে যাচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো হাটে যাচ্ছে ক’টা আনাজ বিক্রি করতে।
এদের বোরকা মাথা গলিয়ে পরতে হত। কালো রংয়ের। চোখ, নাক ও মুখের দিকে জালি কাটা। বহু বছর ধরে এই বোরকা ব্যবহারের জন্য কালো বর্ণ ধূসর হয়ে গেছে। দু’এক জনেরটায় তাপ্পি মারাও দেখেছি। দুতিনজনে হেঁটে যাওয়ার সময় তারা বোরকার ঢাকনা উঠিয়ে গপসপ করতে করতে পথ চলত। শুধু ময়মুরুব্বী দেখলেই ঝপ করে মুখের ঢাকনা ফেলে দিত। কিন্তু অল্পবয়স্ক বালক, কিশোর বা তরুণদের সামনে মুখ খোলা রেখেই তারা চলত। কোনও সমস্যা হত না।
আমাদের পাড়ায় শুধু বোরকা পরতে দেখেছি মাসুদের মাকে। তারা ছিলেন তন্তুবায় সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের বাড়িতে পরির আছর ছিল। তিনি খুব বেশি বাড়ির বাইরে যেতেন না। আমাদের বাড়িতে আসতেন। বাপঠাকুরদার সামনে কখনও পর্দা করেননি তিনি।
আমাদের শহরে ধনীবাড়ির কাউকেই বোরকা পরতে দেখিনি। তবে মধ্যবিত্তদের কোনও কোনও বাড়ির বয়স্ক মহিলা বোরকা একটা পরতেন বটে, কিন্তু সেটা শাড়ির উপরে হাউস কোটের মতো। ঘাড় পর্যন্ত। এর উপরে বোরকা উঠত না।
বর্ষাকালে কুসুমদিয়ার পির শের আলী ফকির যেতেন বরিশালে মুরীদদের দর্শন দিতে। পথে তিনচারদিন থেকে যেতেন আমাদের বাড়িতে। নদীর ঘাটে বাঁধা থাকত তাঁর বজরা। এ এলাকার ভক্ত মুরীদানরা আসতেন পির সাহেবের কাছে ফিকির নিতে। এদের অধিকাংশই ছিলেন মহিলা। তাঁদের কোলে কাঁখে বাচ্চা-কাচ্চা থাকত। উঠোন জুড়ে তাঁরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতেন। বোরকা থাকত কারও কারও কাছে। কিন্তু সেটা রাখতে হয় বলে রাখা। কেউ কেউ বোরকা পেতেও বসত। আর ফকিরের সামনে বোরকা পরতে দেখিনি কাউকে।
আমাদের কলেজে অনেক মেয়েরা পড়ত। কিন্তু বোরকা পরা সেভাবে দেখিনি কাউকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোনা কয়েকজনকে দেখেছি। তারা মৌলবাদী জামাত-শিবির করত। তাদের সঙ্গে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কোনও যোগ ছিল না। তারা ছিল বিচ্ছিন্ন মানুষ।
চাকরি জীবনে আমার কলিগ আলাউদ্দিন ভাই খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি নিয়মিত নামাজ কালাম পড়তেন। ভাবি একটি তুঁতে রঙের বোরকা পরতেন। কিন্তু মুখ ঢাকতে দেখিনি তাঁকে। আমাদের বাসায় ঢুকেই তিনি বোরকা খুলে রাখতেন।
আরেকজন সিনিয়র কলিগ ছিলেন আমার। তাঁর ছিল তিন স্ত্রী। এদেরকে মাঝমধ্যে ডাক্তারের চেম্বারে যেতে দেখেছি। তিনজনের সঙ্গে তিনজন কাজের মহিলা। এই ছয়জনই বোরকা পরা। একলাইনে হেঁটে চলেছেন। লাইনের সামনে তাঁদের একজন স্বামী। বেচারা শার্টপ্যান্ট পরা। পিরোজপুর শহরের লোকজন বেশ কৌতুক নিয়ে এই দৃশ্যটি দেখতেন। কখনও কখনও সেই সিনিয়র কলিগের বাসায় যেতে হয়েছে আমাকে। তাঁর স্ত্রীগণের কেউ না কেউ দরজা খুলেছেন। বাকিরাও আমার সঙ্গে হেসে কথা বলেছেন। কেউই তখন বোরকা পরেননি আমার সামনে। বা পর্দার আড়াল হননি। তাঁদের মন পরিষ্কার ছিল।
হিন্দুদের মধ্যে বোরকার চল নেই। কিন্তু আমার মা, মাসি পিসিদের মাথায় ঘোমটা দেখেছি। গ্রামের দিকে একটু বয়স্কদের মধ্যে কেউ কেউ দীর্ঘ ঘোমটা পরতেন। তাঁদের মুখ দেখার উপায় ছিল না। একজন ছিলেন মামাবাড়ির দিদিমা সম্পর্কীয়। তিনি দীর্ঘ ঘোমটা দিতেন। তাঁর একটা নোলকও ছিল। মুখ না দেখা গেলেও ঘোমটার বাইরে তাঁর নোলকটি দেখা যেত।
আমার মা আমাদের সামনে কখনও ঘোমটা দেয়নি। বাড়ির বয়স্কদের সামনে দেয় আধা ঘোমটা। আর অপরিচিতদের সামনে দেয় পূর্ণ ঘোমটা। কিন্তু কপাল খোলা থাকে। অল্পবয়েসী মেয়েদেরকে ঘোমটা পরতে দেখিনি। হিন্দু মহিলাদের এই ঘোমটাকে আমার মুসলমান মহিলাদের বোরকার মতোই মনে হয়েছে। তাঁদের মেয়ে কিম্বা ছেলে-বৌ কেউ ঘোমটা পরে না। তাঁদেরকে পরতে কখনও বলেননি।
নিউ ইয়র্কে কিছু কিছু বাংলাদেশী মহিলাকে বোরকা পরতে দেখেছি। ট্রেনে দেখেছি হাফ-প্যান্ট পরা মেয়েদের পাশে বসে আছে একজন বোরকা পরা মহিলা। তবে মুখ ঢাকা কাউকে দেখিনি। মসজিদের সামনে কোনও কোনও পাকিস্তানি মহিলাকে শুক্রবারে ভিক্ষে করতে দেখেছি। তাদের গায়ে বোরকা আছে বটে, মুখে নেই।
একবার এক বাংলাদেশী প্রবীণ ধার্মিক মুসলমানের সঙ্গে ট্রেনে পাশাপাশি বসেছিলাম। তখন গরমের দিন। ছোটো পোশাক পরা মেয়েরা আছে ট্রেনজুড়ে। প্রবীণ ভদ্রলোক জোব্বা পরা। মাথায় টুপি। মুখে দাড়ি। শুধালাম, এই খোলামেলা মেয়েদের দেখে কি আপনার অসুবিধা হচ্ছে?
তিনি হেসে বললেন, না। অসুবিধা বোধ করব কেন! ওরা আছে ওদের মতো করে। আমি আছি আমার মতো করে। আমার ইমান এতো দুর্বল নয় যে ওদের দেখলে আমার ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। পাপীমনাদেরই অজু নষ্ট হতে পারে কেবল।
বোরকা পরা মেয়ে দেখলে আমার নাস্তিক মন খারাপ হয় না। কারও ইচ্ছে হলে তিনি বোরকা পরবেন। কারও ইচ্ছে হলে পরবেন না। কে কী পরবেন, কে কী খাবেন– কে কী পড়বেন– এসবই হল ব্যক্তির ইচ্ছাধীন। এই ইচ্ছের উপর নাক গলানোর অধিকার কারও নেই। যদি কারও বোরকা পছন্দ না হয়, তবে তিনি বোরকার দিকে তাকাবেন না। মেয়েদের হাফপ্যান্ট পরা দেখলে যদি কারও ইমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে মনে হয়, তবে তিনি তাঁর ইমানের খুঁটিটাকে জোরদার করেন। জোরদার না করতে পারলে চোখ মুদে থাকুন। অথবা ঘরে থেকে কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। বাইরে বেরনোর দরকার নেই। অন্যের ইচ্ছেকে সম্মান করুন।
কেউ নিজে বোরকা পরেন বলে অন্য মেয়েদেরকে বোরকা পরতে জোর করবেন- এটা অসভ্যতা। আবার কেউ বোরকা পরেন না বলে বোরকাওয়ালীদের গা থেকে বোরকা খুলতে বাধ্য করবেন- এটাও অসভ্যতা।
একটা দেশে কেউ বোরকা পরবে। কেউ বোরকা পরবে না। কেউ ফুল-প্যান্ট পরবে। কেউ হাফপ্যান্ট পরবে। কেউ হাফ প্যান্ট পরে ক্রিকেট খেলুক। কেউ বোরকা পরে ক্রিকেট খেলুক। কেউ ধর্ম পালন করবে। কেউ ধর্ম পালন করবে না। থাকুক না সবাই মিলে মিশে। বৈচিত্র্যের মধ্য ঐক্যই তো প্রকৃতির রীতি। আমরা কেউ কারও মতো নই। এক রকম হলে সুন্দর লাগত না এই পৃথিবী।
বৈচিত্র্যই জীবন। বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য।
এই বৈচিত্র্যকে প্রণাম করি। বারবার সেল্যুট করি।
(লেখক নিউইয়র্ক নিবাসী গল্পকার)
(স্কেচটি করেছেন তাজুল ইমাম)
পরের পর্ব আগামী সংখ্যায়…