
গত সোমবার ভোরে যোধপুর পার্ক এলাকায় মর্নিং ওয়াকাররা একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পান। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার (Justice Rajasekhar Mantha) বিরুদ্ধে কে বা কারা দেওয়ালে কয়েকশো পোস্টার সাঁটিয়ে দিয়েছে।যোধপুর পার্ক লেক থেকে বিচারপতির আবাস অবধি প্রায় ৩০টি বাড়িতে পোস্টার সাঁটানো ছিল।যোধপুর পার্ক বয়েজ হাইস্কুলের দেওয়ালও বাদ যায়নি। কলকাতার মানুষ নানা রাজনৈতিক পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু বিচারপতির বিরুদ্ধে পোস্টার এই প্রথম দেখা গেল।
কে বা কারা পোস্টার দিয়েছে জানা যায়নি। গভীর রাতে চোরের মতো গোপনে সেগুলি সাঁটানো হয়েছে।
সোমবার বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ একদল আইনজীবী হইহই করে হাইকোর্টে বিচারপতি মান্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমে পড়েন। তাঁর এজলাসে অন্য আইনজীবীদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। সেখানে কয়েকবার ধাক্কাধাক্কিও হয় বলে অভিযোগ। পরে জানা যায়, রাজ্য সরকারের কৌঁসুলিরাও এদিন বিচারপতি মান্থার এজলাসে উপস্থিত হননি।হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবকে বিক্ষোভের কথা জানান কেন্দ্রের ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল বিল্বদল ভট্টাচার্য। প্রধান বিচারপতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনও আদালতে এমন ঘটে না। এই ঘটনা ভারতের অন্যান্য হাইকোর্টের উদ্দেশে খুব খারাপ বার্তা দিচ্ছে।

আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রধান বিচারপতির কাছে আর্জি জানান, প্রয়োজনে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে তোলা হোক। বিচারপতিকে এভাবে আক্রমণের লক্ষ্য বানানোয় সরব হন বিরোধীরা। বিজেপির বক্তব্য, বিচারপতি যখন আক্রান্ত হন, তখন বোঝা যায়, সেই রাজ্যে আইনের শাসন নেই।
গত ৮ ডিসেম্বর বিচারপতি মান্থা নির্দেশ দিয়েছিলেন, আদালতের অনুমতি ছাড়া বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে পুলিশ এফআইআর করতে পারবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্যালিকা মেনকা গম্ভীর হাইকোর্টে ইডির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। বিচারপতি মান্থা সেই অভিযোগ মানতে রাজি হননি। এরপরেই বিচারপতির বিরুদ্ধে রাজ্যের শাসকদল অসন্তুষ্ট হয়।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ সাংবাদিক বৈঠকে অভিযোগ করেন, বিচারপতি মান্থার জন্য শুভেন্দু অধিকারী বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তৃণমূল মুখপাত্রের ওই মন্তব্যের এক মাসের মধ্যে দেখা গেল, একদল আইনজীবী বিচারপতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে নেমে পড়েছেন। অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা তাঁর নামে পোস্টার সাঁটাচ্ছে।
বিচারপতিকে এভাবে আক্রমণ করা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের শেষ আশ্রয় হল আদালত। পুলিশ-প্রশাসনে নাগরিকরা যখন সুবিচার পায় না, তখন আদালতের শরণাপন্ন হয়। সেই আদালতে যারা অশান্তি করে, তারা চায়, আইনের শাসন ভেঙে পড়ুক। গণতন্ত্র নয়, দলতন্ত্রই তাদের কাম্য।
পশ্চিমবঙ্গে এর আগেও বিচারপতি শাসকদলের আক্রমণের নিশানা হয়েছেন। রাস্তা আটকে মিছিল-মিটিং করার বিরুদ্ধে ২০০৩ সালে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমিতাভ লালা। তখন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের দোর্দণ্ড প্রতাপ। সিপিএম স্লোগান দিয়েছিল ‘লালা গো ব্যাক!’ বিচারপতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে সরব ছিলেন বামফ্রন্টের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিমান বসু।
বাম নেতারা অবশ্য দ্রুত সংযত হয়েছিলেন। সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস বিবৃতি দিয়ে বলেন, বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সংঘাতে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁদের নেই। বামফ্রন্টের অন্যান্য শরিক দলের নেতারাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বিচারপতিকে আক্রমণের নিশানা বানানো তাঁদের মনঃপুত নয়।
বিচারপতি মান্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কিন্তু টানা দু’দিন ধরে চলছে। আইনজীবীদের একাংশ মঙ্গলবারও বিচারপতি মান্থার এজলাস বয়কটের কথা বলেছেন। কোথায় এর শেষ হবে বোঝা যাচ্ছে না।
একইসঙ্গে একথাও সত্যি যে, বর্তমানে দেশের নানা মহল থেকে বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে অসন্তোষের সুর শোনা যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, আদালত আগের মতো নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না। মনে হচ্ছে, বিচারপতিরা নানাভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গেও সেই অভিযোগ উঠেছে। সেই সুযোগ নিয়েই একদল আইনজীবী বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। এমন হওয়া অভিপ্রেত নয়। গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হল আদালত। অতীতে ওই স্তম্ভটি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল। আগামী দিনেও তাই থাকতে হবে।