শেষ আপডেট: 27th September 2024 11:22
প্রায় সব পাড়া-মহল্লায় কিছু মানুষ আছেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ভাল নয়। তাদের অনেকেরই হয়তো নানা কারণে নামডাক আছে। কেউ কেউ বিশেষ ক্ষমতাধর। কিন্তু প্রতিবেশীদের কাছে তা গুরুত্ব পায় না। ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলির সম্পর্ক এখন ঠিক সেই পাড়ার নামজাদা বাসিন্দার মতো। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একমাত্র বন্ধু প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও সংশয়, অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে।
এমন আবহে বাংলাদেশে ভারতের হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা দিন কয়েক আগে সে দেশের প্রথমসারির রাজনৈতিক দল বিএনপি নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গতমাসে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগির অনুযোগ করেছিলেন, ‘ভারত শুধুই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লিগের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে। যা আর কোনও দেশ করে না।’
তারপর পরই ভারতের হাই কমিশনারের বিএনপি নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক আলাদা মাত্রা পেয়েছিল। মির্জা ফকরুল বলেছেন, আশা করছি, এবার ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করবে।
বিগত জমানায় ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের কূটনীতিক, রাজনীতিক, শিক্ষক-সুশীল সমাজ থেকে সাধারণ জনতার মুখে এই অভিযোগ শোনা গিয়েছে, ভারত একটি দল (আওয়ামী লিগ) আরও স্পষ্ট করে বললে একজন ব্যক্তির (শেখ হাসিনা) সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে। সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাঁদের কেউ কেউ এখন চিমটি কেটে বলছেন, আওয়ামী লিগ অস্তিত্বহীন, তাই ঠেকায় পড়ে বিএনপির দিকে করমর্দনের হাত বাড়িয়েছে ভারত।
নয়া দিল্লির তরফে বাংলাদেশের সাবেক এই শাসক দলের ক্ষোভ প্রশমনের এমন সাধু উদ্যোগ নিয়ে কূটনৈতিক চর্চায় তাল কাটে অমিত শাহের কথায়। ঝাড়খণ্ডে বিজেপির নির্বাচনী সভায় তিনি বলে বসেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উল্টো করিয়ে ঝুলিয়ে সোজা করে দেব।’ বাংলাদেশ সরকার খুব কড়া ভাষায় শাহের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে গেছে। আওয়ামী লিগ সমর্থকদের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের উপর লাগাতার হামলা-মামলা চলছে। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হিসাব অনুযায়ী ৪ থেকে ২০ আগস্ট—১৭ দিনে সে দেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ২০১০টি ঘটনা ঘটেছে। সে দেশের সংখ্যালঘুদের অনেকের আশঙ্কা হামলাকারীদের হাতে বড় অস্ত্র তুলে দিয়েছেন শাহ। তারা এরপর দেশপ্রেমের বুলি আউড়ে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করবে।
অমিত শাহ প্রায়শই এমন হিংসাশ্রয়ী কথাবার্তা বলে থাকেন। গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে তৃণমূলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীদেরও একই হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।
ভারতে বেআইনি পথে আসা বাংলাদেশিদের উপস্থিতি নিয়ে কোনও সংশয় নেই। সমস্যা হল, অনুপ্রবেশের ব্যাপকতা নিয়ে যথাযথ পরিসংখ্যানের অভাব ও রাজনীতি। ভোট এলেই বিজেপি বিরোধীদের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশ আর মুসলিম তোষণের অভিযোগ করে থাকে। অমিত শাহ এর আগে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উঁইপোকার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তখন ঢাকার মসনদে আসীন শেখ হাসিনার সরকার নরম ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সদ্য ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিবাদের ভাষা কড়া হওয়া স্বাভাবিক।
প্রতিবেশী দেশের এই পরিবর্তনকে মেনে নিয়েই ভারত সরকারকে বিদেশ নীতিতে পদক্ষেপ করতে হবে। হাসিনার সময়ে দুই দেশের সম্পর্ক যে অনন্য উচ্চতায় উঠেছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আচমকা পরিবর্তনের পর তা টিকিয়ে রাখা চ্যালেঞ্জ। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির আশু পরিবর্তনের সম্ভাবনাও আপাতত দূরঅস্ত।
হাসিনার দেশত্যাগের পর তাঁর দল কার্যত উধাও। নেতারা গা ঢাকা দিয়েছেন। হাজার হাজার অসহায় সমর্থক মার খাচ্ছে। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার আগেই শাসক দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ। লুটতরাজ, তোলাবাজি, সিন্ডিকেটরাজ সবেতেই এখন শিরোনামে সাবেক এই শাসক দল।
অন্যদিকে, শান্তিতে নোবেন বিজয়ী প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস হাসিনাবিহীন বাংলাদেশে এমন সব পদক্ষেপ করছেন যা শুধু তাঁর দেশ নয়, গোটা উপমহাদেশের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। খুনি, ধর্ষকের পাশাপাশি নিষিদ্ধ ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনের জেলবন্দি নেতাদেরও মুক্তি দেওয়া হয়েছে। জেল ভেঙে পালিয়েছে কয়েকশো দাগী আসামী। তালিকায় ভারত বিরোধী নাশকতায় যুক্ত আসামিরাও আছে।
পাশাপাশি প্রশাসন সংস্কারের নামে ইউনুস সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে উগ্র ইসলামিক মৌলবাদী আদর্শে বিশ্বাসী লোকজনকে বসাচ্ছে। মাত্র দেড় মাসেই স্পষ্ট স্বঘোষিত মুক্তচিন্তার দিশারি আমেরিকার পরম মিত্র ইউনুস দেশ চালাচ্ছেন জামাতের মতো উগ্র ইসলামিক শক্তির পিঠে চেপে। জো বাইডেনের আমেরিকা আবার বাংলাদেশের জামাতকে মৌলবাদী শক্তি মনে করে না।
ইউনুসের হাত ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্রুত সখ্য গড়ে তোলার বাসনাও স্পষ্ট। বহু বছর পর ঢাকায় পাকিস্তানের স্রষ্টা মহম্মদ আলি জিনহার মৃত্যু বার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়েছে, বাঙালি প্রধান পূর্ব পাকিস্তানেও উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়ে যিনি বাংলাভাষীদের চোখে রাতারাতি ভিলেন হয়েছিলেন। বাংলাদেশ রেডিওর নতুন করে উর্দু সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব দৃঢ করার অন্যতম প্রয়াস।
হাসিনা-মুক্ত বাংলাদেশকে কাছে টানতে ঢাকার পাক হাই কমিশনের তৎপরতাও লক্ষণীয়। পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশিদের ভিসা ফি মকুব করে দিয়েছে। চালু করেছে অন অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধা। ঢাকার সাংবাদিকদের দফায় দফায় পাকিস্তান সফরে পাঠানো হচ্ছে।
এই হঠাৎ জাগ্রত পিরিতির ফলে ওই দুই দেশের কতটুকু লাভ হবে বলা কঠিন। কিন্তু ভারতের জন্য ভাল হবে না। ভারত বিরোধিতায় পাকিস্তান হিন্দুস্থানের পূর্ব প্রান্তেও এক মিত্র পেয়ে যাচ্ছে। ইসলামাবাদের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনে আওয়ামী লিগ সরকার মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালিকে পাক বাহিনীর হত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার পূর্ব শর্ত আরোপ করেছিলেন। সেই শর্তকে পাশ কাটিয়েই তাঁরা এগতে চান, খোলাখুলি জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
হাত গুটিয়ে বসে নেই চিনও। ইউনুস সরকার আমেরিকার মদতপুষ্ট জেনেও বাংলাদেশের দিকে আর্থিক সহায়তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছে বেজিং। বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও তার অবস্থানগত সুবিধাই দুর্লভ প্রাকৃতিক সম্পদের মতো অমূল্য। তাই কোনও শক্তিধর দেশও দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট রাষ্ট্রটিকে উপেক্ষা করতে পারে না। আমেরিকার মতো চিনও ভারতের এই প্রতিবেশী দেশটিতে সামরিক ঘাঁটি তৈরিতে আগ্রহী।
প্রশ্ন হল, এই বাস্তবতাকে আমরা কীভাবে দেখছি। হিন্দুত্ববাদীদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে তারা বেজায় খুশি। তারা মনে করছে, দেশের দুই প্রান্তে বিকৃত ইসলামকে সামনে রেখে মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দিলে ভারতে ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’, ‘হিন্দুস্থান খতরে মে হ্যায়’ বলে লোক খেপিয়ে, মুসলিমদের চাপে রাখার পাশাপাশি ভোটের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা যাবে। হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার পথ আরও সহজ হয়ে যাবে। তাতে বাংলাদেশে হিন্দুরা মরল কী বাঁচল, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ শান্তিতে ঘুমোতে পারল কী পারল না, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।
এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের অবস্থান স্পষ্ট হওয়া জরুরি। প্রতিবেশী যেমন বদলানো যায় না, তেমনই তাঁর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ভারত সরকার কি সেই সারসত্য বিবেচনায় রেখে পদক্ষেপ করছে?
দেশের উত্তর ও পশ্চিমপ্রান্তে পাকিস্তান আমাদের চিরস্থায়ী প্রতিপক্ষ। উত্তর ও উত্তর-পূর্বে স্থায়ী বিপদ চিন। বাংলাদেশ যে দিকে এগচ্ছে, তাতে পূর্ব ও উত্তর পূর্ব প্রান্তেও আমরা স্বস্তিতে থাকতে পারব কিনা সন্দেহ। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসন ভারতকে অমূল্য স্বস্তি দিয়েছিল। চরম বিপদে তাঁকে আশ্রয় দিয়ে ভারত সরকার যেমন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তেমনই বাস্তববাদী পদক্ষেপ দাবি করে বাংলাদেশের বর্তমান ও আগামীর সরকারগুলির সঙ্গে সু-সম্পর্ক তৈরির প্রচেষ্টা।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে ফোনে ইউনুসকে ভারতের উদ্বেগ, অসন্তোষের কথা জানিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। আরও ভাল এবং জোরালো হত, নিউ ইয়র্কে মুখোমুখি আলোচনায় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাকে প্রধানমন্ত্রী সে কথাগুলি বললে। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের ফাঁকে বাংলাদেশ এই বৈঠকের প্রস্তাব দিলেও নয়াদিল্লি সাড়া দেয়নি। নিউ ইয়র্কে মোদী বৈঠক করেছেন নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির সঙ্গে। অন্যদিকে, ইউনুস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকে সার্কের (সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওন্যাল কো-অপারেশন) পুনরুজ্জীবনের ডাক দিয়েছেন।
নেপালের পাশাপাশি ভুটানেও চিন প্রভাব বাড়াচ্ছে। থিম্ফু-বেজিং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা এখন আর গোপন নেই। ভারত বিরোধিতাকে সাহায্যের অন্যতম শর্ত করেছে চিন। তাই মালদ্বীপের মতো দেশও ভারতকে চোখ রাঙাতে সাহস পেল। দেশ থেকে ভারতীয় সেনা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে তারা।
শ্রীলঙ্কায় সদ্য ক্ষমতায় আসা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রপতির সময়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কোন খাতে বইবে এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বহু বছর দু-দেশের সম্পর্কে কোনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। অথচ মালদ্বীপের মতো শ্রীলঙ্কাতেও শান্তি ফেরাতে ভারতীয় সেনা প্রাণ দিয়েছে।
সেদিক থেকে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনার বলিদানের সুবাদে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রক্তের সম্পর্ক। হাসিনা তথা আওয়ামী লিগ বিরোধীরা তা মানতে না চাইলেও বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অস্বীকার করার উপায় নেই।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের এমন বৈরি সম্পর্কের নজির অতীতে নেই। নরেন্দ্র মোদীকে যতই বিশ্বগুরু সাজানো হোক, যতই চেষ্টা হোক তাঁর অনুগামীরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর উদ্যোগ নেওয়ায় তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার দাবি তুলুন, প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের দশে শূন্য প্রাপ্য।
বিএনপি জমানার (২০০১ থেকে ২০০৬) পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ বাংলাদেশের মাটিকে ভারত বিরোধী ষড়যন্ত্রে ব্যবহার হতে না দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করাই নয়াদিল্লির কাছে এখন সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হওয়া দরকার। আজকের বাংলাদেশকে আমরা যদি নিজেদের মতো করে পেতে চাই তাহলে দূরত্ব নয়, ঘনিষ্ঠতাই আসল কৌশল।