Latest News

তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়: আমার স্বাধীনতা

রাজদীপ্ত রায়

Image - তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়: আমার স্বাধীনতা

স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে একগাল উদাসীন “তোঃ!” ছুঁড়ে পাশ ফিরে বসা বাদে আমার আর বিশেষ কিছুই করার বা বলার নেই। চুয়াত্তরেও ছিল না। ছিয়াত্তরেও যে থাকবে না, সে বিষয়েও এই অর্ধশতাব্দী ধরে আজন্ম ভারতবাসী আমি স্থির নিশ্চিত।

উদ্বাস্তু পরিবারে বড়ো হওয়ায় স্কুলবেলাতেও স্বাধীনতার আনন্দের চাইতে দেশভাগের যন্ত্রণা উদযাপনে বেশি অভ্যস্ত বাঙালি সমাজে আমার মতো আরো অনেকেই। দগদগে ঘায়ের মতো ধরে রাখা সেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে ভিটেমাটিছাড়া করে দেওয়ার তেতো স্মৃতি আমার বাবা বা মায়ের দিকের কোনও পূর্বজকেই ঢেউতোলা তেরঙ্গার দিকে নরম শান্ত চোখে তাকাতে দেয়নি। দেশকে, জাতিকে, এই নতুন পুনর্বাসনের মাটিকে ভালোবাসার প্রতিটি পরতে মিশে ছিল শত লজ্জা আর লড়াই থেকে জন্ম নেওয়া অস্বস্তি। পুরোমাত্রায়। পরবর্তী প্রজন্মের নাতিপুতিদের কাছে সেই স্মৃতিধার্য ট্রমাকথনের পৌনপুনিকতায় যেন কোনও অব্যক্ত আকুতি দিয়ে মেশানো থাকত সেই অস্বস্তি। পূর্ব প্রজন্মের ওপর ঘটে যাওয়া জঘন্য অপরাধকে যেন বুঝে নেওয়ার, যুঝে নেওয়ার কোনো না বলা আকাঙ্ক্ষায়। (Independence Day)

স্বাধীনতার প্রদীপের নীচে যে গাঢ় অন্ধকার রাখা ছিল, যে কালোরঙ মোছার চেষ্টা করা তো দূর অস্ত, সামান্য সম্বোধন করবারও চেষ্টা করেনি ভারত রাষ্ট্র, তা যেন অপ্রত্যক্ষ পোস্ট-মেমরি হয়ে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে এবং এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় এক বিরাট ‘স্বাধীন’ জন অংশকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে। এমনকি আজও, পরিসংখ্যানে একবেলা পেটপুরে না খেতে পাওয়া ক্ষুধিত মানুষের জনসংখ্যায় বিশ্বে প্রথম সারিতে থাকা এই ভারতের অমৃত মহোৎসবের প্রহসনের প্রাক্কালে। এত খিদে পেটে নিয়ে দুর্ভাবনার ঘুমে বা নির্ঘুমে পঁচাত্তরই বা কী, আর ছিয়াত্তরই বা কেন, প্রশ্ন জাগে।

আর দ্বিতীয় সমস্যা, ওই জেগে থাকা প্রশ্নটাকে নিয়েই। দেশভাগ যেমন দেশভাগের ফলে ছিন্নমূল হওয়া মানুষগুলির ইচ্ছে সাপেক্ষে হয়নি, তেমনই এই পঁচাত্তর পেরোতে চাওয়া শুধু এবং শুধুইমাত্র রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন বৃদ্ধা রাষ্ট্রে আজও সুচিন্তিত ইচ্ছাপত্রের কোনও মূল্য নেই।

আধুনিক পৃথিবীতে পঁচাত্তর বছরের সার্বভৌমত্ব বিরাট ব্যাপার। অন্তত সময়ের প্রেক্ষিতে তো বটেই। সেই দীর্ঘ সময়ের সালতামামির চরিত্র লক্ষ করে বলাই যায়, ভারতের নির্বাচনী গণতন্ত্র এ মুহূর্তে একটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। অর্থ, পেশীবল, আর নিম্নমেধার রাজনৈতিক বা ধর্মীয় হুজুগের ওপর ভিত্তি করে বছরের পর বছর ভোটের নামে যে সমানাধিকার প্রয়োগ করা হয়, যাতে করে মুড়ি মিছরি একদর হওয়ার মতো করে ভারতীয় গণতন্ত্র চেতনাসম্পন্ন আর পিণ্ডবৎ সমষ্টি নির্জ্ঞানের অচেতন বা অর্ধচেতন রায়কে একই নিক্তিতে মেপে নিয়ে শাসক সম্প্রদায় নির্বাচিত করে নেয়, দশকের পর দশক, ক্লান্তিকরভাবে, সেখানে আর যাই হোক উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা থাকার কথা নয়। এবং নেইও। (Independence Day)

ভারতের গণতন্ত্র আজ একটি ‘ফেইলড ডেমোক্রেসি’ হয়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক চেতনা সম্পন্ন গুটিকয় মাত্র প্রশ্নকারীকে প্রতিমুহূর্তে ঠেলে দিচ্ছে খাদের কিনারে। তাদের জীবন বিপন্ন করছে। শাসাচ্ছে। অশিক্ষিত, তস্কর, পরস্বাপহারী এবং প্রকাশ্যে অপরাধী মানসিকতা বহন করা কিছু রাজনৈতিক দালালকে কখনো ভাবাবেগের নামে আর কখনোও বা পপুলিজমের নামে ক্ষমতার অলিন্দে নির্বাচিত করে পাঠাচ্ছে বারেবারে। কেন না, নির্বাচন নির্ভর ফলাফলের কোনো গুণগত মান নির্ণয় ভারতীয় গণতন্ত্র বা ভারত নামক রাষ্ট্র আজও, এই পঁচাত্তর বছরেও, করে উঠতে পারেনি। করতে চায়নি। জড়পিণ্ডবৎ, চিন্তা চেতনা রহিত এবং বিশ্লেষণ-বিমুখ এক বিরাট জনসংখ্যার শুধুমাত্র সংখ্যাধিক্যের নিরিখেই স্বাধীন ভারত তার রাষ্ট্রিয় গতিপ্রকৃতির অভিমুখ ঠিক করে। মতামতের মান বা সূক্ষ্মতা সেখানে অবান্তর বলে বিবেচ্য। অর্থাৎ, প্রশ্নকারীকে প্রান্তে ঠেলে এই যেমন সাম্প্রতিক ভারতের সংসদ, যা কিনা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে নাম জড়ানো পুলিশের খাতায় থাকা সাংসদদের নজিরবিহীন সংখ্যাধিক্যে গর্বিত, তিলে তিলে কিন্তু অনায়াসে হয়ে উঠছে স্বৈরতন্ত্রী। (Independence Day)

স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বছরপূর্তির দুরন্ত উচ্ছাসের পাশে বসে একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, যে স্বাধীনতার মূল্য চোকাতে একটি দেশকে টুকরো টুকরো করা হয়েছিল, আত্মপক্ষ সমর্থন বা প্রশ্ন করার ন্যূনতম অধিকার না দিয়ে প্রজন্মকে ঘরছাড়া করা হয়েছিল মুহুর্তে, দাঙ্গার রক্তগঙ্গায় ভেসেছিল দেশ, সেই শারীরিক বা মানসিক রক্তক্ষরণের নাছোড়বান্দা আঁশটে গন্ধে আজও ছেয়ে আছে গৌরী লঙ্কেশ বা স্ট্যান স্বামী থেকে ভারভারা রাওয়ের হত্যা বা অত্যাচারের ইতিহাস। গণতন্ত্রের অছিলায় স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হওয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্র এখন ভারত নামক বৈপরিত্যময় রাষ্ট্র। এখানে প্রশ্ন করা, প্রশ্ন তোলা বারণ। রুশদী সাহেবের বলা ক্রিপ্টো-ফ্যাসিজম এখন পূর্ণ-ফ্যাসিজমে যৌবন পেয়েছে। এই অদ্ভুত স্বাধীন দেশে তার জন্মলগ্ন থেকেই, নীরবে মেনে নেওয়াটাই কাম্য। রাষ্ট্র এখানে কোনো বিরুদ্ধ মত চায় না।

Image - তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়: আমার স্বাধীনতা
গৌরী লঙ্কেশ

বাক স্বাধীনতা আমাদের কোনওদিনই ছিল না। ইদানীং চিন্তা আর রুচির স্বাধীনতাও বিপন্ন। ভারত এখন রাষ্ট্র হিসেবে স্পেক্ট্যাকল তৈরিতে বিশ্বাসী। ভারতের সার্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিও আজকাল স্পেক্ট্যাকল নির্ভর। সেই সব স্পেক্ট্যাকল, যা কিনা কেবলই দৃশ্যের জন্ম দেয়, ভারত নামক রাষ্ট্র চায় সেসবের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ আনুগত্য। ব্যক্তি চেতনার বিকাশ নয়, স্বাধীনতার পঁচাত্তর পূর্তিতে সেইসব ভাবাবেগের স্পেক্ট্যাকলে সমর্পিত চিন্তা-চেতনাহীন সমষ্টির গড্ডলিকা প্রবাহই ভারত রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত আদর্শ নাগরিক সত্তা।

হয়তো এত দৃশ্যের জন্ম হওয়া সত্ত্বেও কিছু মানুষ চোখে চোখ রেখে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে চায়। জানান দেয় প্রকৃত স্বাধীনতার অর্থ। রাষ্ট্রের মহোৎসবের কাড়া নাকাড়ায় হয়তো আপাতত চাপা পড়ে যায় সেই স্বর। কিন্তু বিশ্বাস করতে ভালো লাগে যে, সেইসব স্বরেরা যায়নি মরে আজও। ক্রমশ আলো কমে আসা এবং নিতান্ত সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়া গুটিকয় মুক্তচিন্তকের স্বাধীনতা উদযাপনে না হয় এটুকু প্রতীতিই ভালোবাসা হয়ে জেগে রইল। হয়ে রইল আমার স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীনতা। ক্ষতি কী!

এরপর বাকি গল্প ঢাকা পড়ে যাবে অকারণে স্বাধীনতা নামে ডেকে ফেলা অমৃত মহোৎসবের বল্গাহীন উচ্ছ্বাসে। উচ্ছ্বাসে আবেগ জরুরি। ইদানীং, ভাবাবেগ। ওখানে অবশ্য প্রশ্নেরা ব্রাত্য। মহোৎসবে প্রকৃত স্বাধীনতারও প্রবেশ নিষেধ।

You might also like