একরাম আলি
সাড়ে ন-বছর বয়স থেকে একাধিক হোস্টেলে। হলে কী হবে, বাড়ি ছোট্ট একটা গাঁয়ে। হাঁটু-অবধি কাদা। বিদ্যুতের কল্পনাও করা যেত না। দু-মাইল হাঁটলে পাকা রাস্তার লেজ পাকড়ানো সম্ভব যদিও, কিন্তু ক-জনই-বা যাচ্ছে! এ-হেন গাঁয়ের এক চাষি-পরিবারে জন্ম,
সাড়ে ন-বছর বয়স থেকে একাধিক হোস্টেলে। হলে কী হবে, বাড়ি ছোট্ট একটা গাঁয়ে। হাঁটু-অবধি কাদা। বিদ্যুতের কল্পনাও করা যেত না। দু-মাইল হাঁটলে পাকা রাস্তার লেজ পাকড়ানো সম্ভব যদিও, কিন্তু ক-জনই-বা যাচ্ছে! এ-হেন গাঁয়ের এক চাষি-পরিবারে জন্ম, যাদের গ্রামীণ ব্যবসার হাত-পা নানা দিকে ছড়ানো। ফলে, বাড়ির পরিবেশ ছিল জগাখিচুড়ি। যাকে বলে বেখাপ্পা। বছর ষাটেক আগের একটা শিশুকে দেখতে পাই। খালি গা। মাটির দাওয়ায় বসে ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুটে কৌটোর পলসন বাটার লাগিয়ে ব্রেকফাস্ট করছে। ওই গাঁয়ে পাউরুটি মিলবে কোথায়! কী না, বাবার নির্দেশ। সে-নির্দেশ স্থায়িত্ব না-পেলেও অদ্ভূতুড়ে ব্রেকফাস্টের জন্যে পলসন বাটারের গন্ধটি নাকে থেকে গিয়েছে। তেমনই একবার কার খেয়ালে কে জানে, নতুন অতিথি হয়ে বাড়িতে আসে তাগড়াই এক বাদামি অ্যালসেশিয়ান। দেউড়ির মুখেই উঠোনে পুঁইমাচা। তারই একটা খুঁটিতে বেঁধে রাখা হল। ব্যাপারটা ব্রিটিশপুঙ্গবের পছন্দ হয়নি। তবু বলব, সে-রাজপুত্রের মেজাজ-মর্জিই ছিল বেয়াড়া। এত লাফঝাঁপ আর অবিরাম ঘেউ-ঘেউ অসহ্য হওয়ায় কয়েকদিনের মধ্যেই বিদেয়। তা, হাতফেরতা হয়ে না-হয় অ্যালসেশিয়ান। আদতে তো জার্মান শেফার্ড! মানে লাগবারই কথা।
আজকাল নিজেরই বিশ্বাস হয় না, একবার বাহাদুর নামের মূর্তিমান এক নেপালি দারোয়ান কোত্থেকে এসে হাজির। ছিলও দু-চার বছর। কিন্তু চাষির বাড়িতে কী-যে সে পাহারা দিত, কেউ বোঝেনি সম্ভবত। তার সঙ্গের কুকরিটিও না। আরেকবার কারও শখের টানে আবির্ভূত হল দুধসাদা চারটে রাজহাঁস। মরাল গ্রীবার প্রতি বাড়তি আকর্ষণ— অন্তত ছিল যে— সে ওই হাঁস-চারটের জন্যেই সম্ভবত! একদিন হল কী, উঠোনে পায়চারি করতে করতে সহসা বিশাল ডানা খুলে ফেলে। কোত্থেকে যে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিল, জানা যায় না। তিনতলা কোঠাবাড়ি টপকে সাঁ-সাঁ উড়ান। খোঁজ! খোঁজ! পাওয়া গেল শ-পাঁচেক মিটার দূরে বামনিপুকুরের বটবৃক্ষের ছায়ায়। বাড়ি থেকে রাজহাঁসের উড়ে-যাওয়া ঘোরতর কুলক্ষণ। তাই পাঁচজনের পরামর্শে হাঁস–চারটেকেও সসম্মানে বিদেয় করা হল। ততদিনে অবশ্য তাদের ব্রহ্মাণ্ড সাইজের ডিমের বালি-বালি স্বাদ আমরা পেয়ে গেছি। সেদ্ধ এবং ওমলেট— দুই রূপেই।
আর বই? প্রতি চৈত্রে আসত গুপ্ত প্রেসের ঢাউস পঞ্জিকা। এছাড়া কাকার ঘরের দেওয়াল-তাকে ছিল বিশ্বনবী, বিষের বাঁশি আর আনোয়ারা। ব্যস, তালিকা শেষ। তবে, কলের গান আর রেডিও ছিল জীবনের অঙ্গ। সে-দুটোও গেছে।
এতসব এবং আরও রকমারি কতকিছু এল-গেল, বাড়ির এক কোণে নাছোড়বান্দার মতো পড়ে রইল শুধু জং-ধরা লোহার সিন্দুকটা। ভেতরের গুমোট গন্ধ সমেত। যেমন খুশবুদার গড়গড়াটিও কোথাও রয়ে গেছে হয়তো, যার কেতাবি নাম আলবোলা।
সেই আমি একদিন কফি হাউসে কাউকে না-পেয়ে মেসে ফিরে আসছি। সন্ধে গড়িয়ে গেছে। ঢুকব, হাসতে হাসতে মেস থেকে বেরিয়ে আসছে রুমমেট তপন মুখার্জি। আমাকে দেখে হাসি চওড়া হল— যান, যান। ঘরে ষোলোজন গেস্ট আপনার।
কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইলে হাত-পা নেড়ে তার সহাস্য উত্তর ছিল— এই একটু ঘুরে আসি এদিক-ওদিক। ঘরে তো জায়গা নেই!
সর্বনাশ। ষো-লো-জ-ন! মাথা ঠান্ডা রাখা জরুরি। অলস পায়ে সিঁড়ি ভাঙি। যেন কিছুই জানি না। উঠে, ধীরেসুস্থে বারান্দা পেরনো। কিন্তু দরজার মুখোমুখি তো একসময় হতেই হয়, যেটি খোলা। ভেতর থেকে ব্যস্ত পার্থপ্রতিমের গলা-- এই তো, একরাম এসে গেছে। তিনটে বেডে কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে, কোনও বিছানায় এলিয়ে কেউ। কিন্তু সবার শরীরের ভেতর নানারকমের চঞ্চলতা নানাভাবে তরঙ্গায়িত হচ্ছে যে, সেটা স্পষ্ট।
সামনেই আমার বেড। কেউ একজন কাত হয়ে শুয়ে। বলা ভালো, জ্ঞানহীন। সাদা বাংলায়—আউট! মুখটি দরজার দিকে। রোগা। ফর্সা। লম্বা। সর্বোপরি অচেনা। ক্ষীণ স্রোতের মতো জলীয় কিছু বেরিয়ে আসছে তার হাঁ-খোলা মুখ থেকে, যার নাম বমি। বালিশ বেয়ে বিছানা, বিছানা থেকে মেঝেয় গড়াচ্ছে।
ঘরে ঢুকে, আমি নই, হাতদুটোই নিজে-নিজে দরজা ভেজিয়ে দিল। পার্থ স্বাভাবিক নেতা। জানা গেল—শায়িতজনের নাম শৌনক লাহিড়ী। সদ্য হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে। সেন্ট পলস থেকে। কেটি-ফেরত দলটির হয়ে পার্থই জানিয়ে দিল, একটু বেশি হয়ে গেছে। ঠিক হয়ে যাবে।
এমন সময় ঘরে ব্যারিটোন ভয়েস, একটু জড়িয়ে গেলে যা আরও জমে— কিচ্ছু বেশি হয়নি, দাদা। শরীরটা যুতে নেই।
সেই রোগা ছেলেটা না? এমন কণ্ঠস্বর!
তার কিছুদিন পর সেই শৌনকেরই পাইকপাড়ার ফ্ল্যাটে বর্ষার এক দুপুরে আমরা দু-জন। বৃষ্টি পড়ছে। লংপ্লেইংয়ে বিটলসের ঝংকার। সঙ্গে ঘরময় ঘুরে-ঘুরে শৌনকের হালকা নাচ। একসময় থেমে— ধ্যাত্তেরি, চলুন তো!
জানা গেল, কোনও এমব্যাসিতে চাকরিসূত্রে পাশের বাড়িতে একটা সেলার বেশ জমকালো। কিন্তু ছাতা নেই। অগত্যা বেডকভার মুড়ি দিয়ে অভিযান। দোতলা। বাইরে অঝোর বৃষ্টি। দরজার সামনে বেডকভার-আবৃত দুই মূর্তিমান। খুলেই এক তরুণীর অস্ফুট আর্তধ্বনি এবং সপাটে দরজা বন্ধ করার চেষ্টা। ‘আরে, আমি! আমি!’— বেডকভার থেকে মুখ বের করে শৌনকের অন্তিম চেষ্টা। এবং শেষ পর্যন্ত জয়লাভ। ট্রয় নগরী ধ্বংসও হল না, অধিকন্তু হাতে হেলেন! নিটোল কি আর পাওয়া যায়? এত রক্তপাত! অর্ধেক খালি না-বলে তাই বলা উচিত— অর্ধেকটা তখনও তরল সোনায় টলটল করছে। হ্যাঁ, কনিয়াক। কুলীন ফরাসি। মানে বোর্দো থেকে আশি কিলোমিটার দূরে ওই নামেরই শহরটি তিনশো বছর ধরে দুনিয়াকে জুগিয়ে যাচ্ছে এই পানীয়।
আমাদের বায়েনপাড়ার শুকো, মানে শুকদেব বায়েন, রোজ রাতে ভাটি বসায়। ভাত পচিয়ে হাঁড়িয়া নয়। পাকি। ডিস্টিলড লিকিওর। সিক্সটি আপ তো হবেই। ফ্রান্সের কনিয়াক কিন্তু ব্র্যান্ডি। মূলত ইতালির ট্রিবিয়ানো নামের আঙুরজাত, যে-আঙুরটি আবার ফ্রান্সে উইনি ব্লঁ। টুয়েন্টি আপ থেকে বড় জোর ফর্টি আপ। স্কটিশরা একই নামে বানায় হুইস্কি। বার্লি পচিয়ে। শুকোর গোত্র তারা।
সেই শুকো, যে একসময় চাষ করত। পারত না। কালো। রোগা। সিড়িঙ্গে টাইপের শুকো কুঁড়ের বদনাম পেয়েছিল পাঁচ ঘরে। কিন্তু যখনই দেখা হয়েছে, অধোমুখে হাসি— কাকা, ভালো আছেন? যে জোরে হাঁটতে পারে না, সে যে কখনো সরসরিয়ে উঠে তালগাছের মাথা নাড়িয়ে দিতে পারে, কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। শুকোর ভাটি সম্ভবত আজও রমরমিয়ে চলছে।
ততদিনে শৌনক গোয়েঙ্কা কলেজে। বেরিয়েও এসেছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। তারপর ভেসে গেছে। কবিতায়? না, তার অনুসঙ্গেও। সেই সময় সে লিখেছিল— চিড়েগুড় খেয়ে ওড়ে গোখুরা...!
সে-রাতে মেসে ফেরাটা অন্য দিনের মতো ছিল না। খাওয়া-দাওয়ার পর প্রসেনজিৎ, তপন কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। নীচের রাস্তা সুনসান। বিছানায় টেবিল ল্যাম্পের বৃত্তাকার আলো। বসে আছি, বসে আছি। আলোর উসকানির সামনে ঝুঁকে–পড়া এক আকন্দ ঝোপের জাগরণ। নিষ্ফল অপেক্ষা। যেমন আজও, বিয়াল্লিশ বছর পরেও, আলো জ্বলতে জ্বলতে মাঝরাত গড়িয়ে গেল। বাইরে, থেকে-থেকেই হুইসলের সতর্কতা। সে তো অনেক উপরে। রাতের অনেক নীচে যেখানে বুনো লতাপাতা, অচেনা রাতপোকারা ঘুরে বেড়ায়, সেখানে অগ্নিপীঠে বসে আছে এক রাতমাসি। কানে কানপাশা, নাকে ভারী নথ। ঝলকানি মেরে অনবরত সে উসকায়। ফিসফিসিয়ে বলে— আরেকটু, আরেকটু জাগো। অপেক্ষা করো।