সেটা সাতাত্তর। সাতাশ মার্চ জরুরি অবস্থা উঠে গেল। এল নির্বাচন। ফল-- রাজ্যে কংগ্রেসের রাজ্যপাট চুরমার করে বামফ্রন্টের মারকাটারি জয়। মাসটা সম্ভবত ছিল জুন। দিনটা ছিল শনিবার। জরুরি অবস্থার দমচাপা মাসগুলো পেরিয়ে এসে মুক্তির আশ্বাস ছিল ব্রিগেডের বিশাল বিজয় উৎসবে। তাই হয়তো-বা শিয়ালদা থেকে মিছিলের পর মিছিল। একটু এগিয়ে কলেজ স্ট্রিট বা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ঘুরে ময়দানমুখো হবে তারা। একসময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়ি। মিছিলে সারবন্দি রাতজাগা উড়োখুড়ো মানুষ। বলদৃপ্ত। নতুন আশা। কিন্তু কোত্থেকে যেন তাদের খড়িওঠা হাতে এসে জুটেছিল সিল্কের লাল পতাকা! সেই প্রথম। বিশাল আকারের। পতপত করে না-উড়লেও ওড়ার সম্ভাবনা নিয়ে সেগুলো তৈরি হয়েছিল নিশ্চয়। বড্ড চোখে লেগেছিল সেইসব পতাকার ঝলমলানি। রবিবার কাগজে দেখা গেল, নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন— কোনও কমিউনিস্ট সরকারকে সহ্য করবে না দিল্লি। ফেলে দেবেই। তাই সতর্ক থাকতে বলা হল সবাইকে। একটু বেলায় শ্যামবাজারে শঙ্খ ঘোষের বাড়ি। আড্ডায় পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল শুনিয়ে দিলেন— জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না, হায় সিপিএম হায় রে...! ঘরময় চাপা হাসির বুজকুড়ি। আর তাতেই হয়তো ইঙ্গিত ছিল চৌত্রিশ বছরের স্থিতাবস্থার! এ তো বোঝাই যাচ্ছে, তেমন ইঙ্গিত পাইনি। আমরা তত ধুরন্ধর ছিলাম না যে!
কয়েকদিন পর এক বিকেলে-- কী কারণে মনে নেই— দাঁড়িয়ে আছি শিয়ালদায়। আপার সার্কুলার থেকে একটা দক্ষিণমুখো অ্যামব্যাসাডর পেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে গেল। জানলায় ফর্সা মুখ। পিছন ফিরে। আমার দিকে? না-চিনে উপায় কী! সবার মুখে গোঁফ মানায় না। ফর্সা মুখে কালো গোঁফটি (নাকি জোড়া!) যাকে বলে লাগসই ছিল। চেঁচিয়ে নাম ধরে ডাক। স্মৃতির জোর সাঙ্ঘাতিক যে! কাছে যাই।
সোনাদা।
প্রথম দেখি সিঊড়িতে। বাহাত্তরে। নির্বাচন ঘোষণার পরে।
পুরনো পোস্ট অফিস-লাগোয়া সদ্য কেতাদুরস্ত বাড়ি উঠেছে পোস্ট অফিসেরই। উঠলে হবে কি, একটা সরু আর নোংরা গলি গজিয়েছে দুইয়ের মাঝখানে। পুরোনো আর নতুনের মাঝে যে-ধরনের বিভাজন কিছুতেই এড়ানো যায় না আমাদের দেশে। উলটোদিকে চন্দ্রগতি হাই স্কুল। পাশেই বার লাইব্রেরি থেকে শুরু কোর্ট চত্বর। পোস্ট অফিসের সেই গলিতে ঢুকেছি, আচমকা পাশেই কালো কোটের ফর্সা, দোহারা, বেঁটেখাটো, নির্ঘাত উকিল একই কাজে ছটফটিয়ে ঢুকে পড়েছেন। গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। একটা সেকেন্ড যেন ফুরসত নেই নষ্ট করার। ওই অবস্থাতেই ঘাড় ঘুরিয়ে, মিহি করে হেসে— ভাই, আমি সোনাদা। এবারের কংগ্রেস ক্যান্ডিডেট। ভোটটা আমাকে দিয়ো কিন্তু। কোন ইয়ার? সেকেন্ড? ওমপ্রকাশ আছে না? আরে, টিব্রিওয়ালা। ও ঠিক যোগাযোগ করে নেবে।
মস্ত হলঘর। ও-প্রান্তে সিঁড়ি। ওপরের বারান্দায় তিনি স্বয়ং দাঁড়িয়ে। রেলিঙে হাত— কে, সোনা? বাঁদিকের পয়লা ঘরটায় বোস। সিনেমার সেটে যেন চুরুটজ্যান্ত কমল মিত্র।
ঘরটা তেমন বড় বলা যাবে না। সোফায় বসে পড়ি। ফের ফিসফিসিয়ে সতর্কতা— মনে আছে তো, যা বলেছি? একটু পর, মানে অনেকটা পরে, নেতার আবির্ভাব। হালকা নীল হাওয়াই শার্ট, সাদা স্ট্রেচলনের প্যান্ট। পাতলা কোঁকড়ানো চুলে ব্যাক ব্রাশ। বড় একটা সোফায়, আসলে একজনই বসতে পারে, তিনি বসলেন। পিছু-পিছু ট্রে-সহ দুটো হাতের প্রবেশ। চা। দুজনের জন্যে। না, গৃহকর্তা খাবেন না।
কথা শুরু হল। চলছেও। সবই মান-অভিমানের কথা। পরাজিত দলের দুই জয়ী চরিত্র। একজন বোড়ে, অন্যজন গজ। এই যে বুক ফুলিয়ে ব্রিগেড হল, বলতে পারিস, ওরা কেউ ছুঁতে পেরেছে আমাকে? আমার মতো মার্জিনে কেউ জিতেছে? কেউ নেই। বেঙ্গলে আমিই সব চেয়ে বেশি ভোট নিয়ে এসেছি রে! আর দেখ, তুই বাগবাজার ঘুরে তারপর আমার কাছে এলি। কেন, আগে আমার কাছে আসার কথা তোর মনে এল না কেন? না-না, তোকে বলেই বলছি। এটাই আমাদের ক্যারেক্টার রে। কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তার ফল হ্যান্ড টু হ্যান্ড পেল দল। পেল তো? এবার আঙুল চোষ পাঁচ বছর।
ঠিক এই কথাগুলোই হুবহু নয়, তবে মোদ্দা কথাগুলো ছিল এরকমই।
ডানদিকে খোলা দরজা। এতক্ষণ ধরে সেই দরজার ওপাশটা ছিল নিস্তরঙ্গ। কী-একটা হালকা সবুজ ঢেউ যেন পেরিয়ে যাচ্ছে ওপাশে। ঢেউয়ের শেষ প্রান্তে ফেনার নকশা। কী? ঘাড় তো আর নাটবল্টু দিয়ে আটকানো থাকে না। নিজে-নিজেই ঘুরে যেতে পারে। যায়ও। সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট কিন্তু কড়া সতর্কতা— উঁহুহু, ওদিকে না। ওদিকে কিছু নেই।
সোনাদার হাতে চায়ের কাপ। থমকে গেল। কুঁচকে-যাওয়া চোখ এদিকে। অর্থাৎ, এটা কী করলে! ততক্ষণে তিনি সামলে উঠেছেন-- নে, চা-টা শেষ কর। আসিস মাঝে মাঝে। বিপদে পড়লেও আসিস। আমি তো আছি রে! ভয় পাস না।
ঊঠতে হল এরপর। বেরিয়েও যেতে হয়। বাইরে সন্ধ্যের ঝোঁকে মেঘলা হাওয়া। আমগাছে জোনাকি? না, চোখের ভুল। গাড়িতে উঠে ড্রাইভার শোনে— পার্ক স্ট্রিট।
ইচ্ছে করে না। ‘না’ বলে দিই। আর এক দিন। কেন? চলো না, কোথাও বসে একটু কথা বলি। না এবং হ্যাঁ-এর টানাপড়েনে গাড়ি ততক্ষণে গান্ধী ভবন থেকে বেরিয়ে এঁকেবেঁকে থিয়েটার রোডের ব্যস্ততায় ঢুকে পড়েছে।
লেখক কবি ও প্রাবন্ধিক। লিখেছেন একটি উপন্যাস এবং একটি স্মৃতিকথা।