Latest News

মোদী-শাহর রাজ্যপালদের এজেন্ডা কী

অমল সরকার

‘আপনি নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন, আমি আপনাকে বলেছিলাম যে রাজাজীকে (চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী) যদি চলে আসতে হয় কারও নাম আপনি প্রস্তাব করে পাঠান। …আমাদের নীতি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের লোককে রাজ্যপাল (Governor) পদে নিযুক্ত করা হবে না।’

জবাবি চিঠির বয়ানটি ছিল এই রকম, ‘এই বিষয়ে ইতিমধ্যেই আপনাকে চিঠি লিখেছি, ….ডঃ কাটজুর নাম। তিনি আসতে পারেন। ওই চিঠি কি আপনি পাননি?’

প্রথম চিঠিটির প্রেরক দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। লিখেছিলেন বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে। বেশ কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর দায়িত্বপালন করা সরোজ চক্রবর্তী তাঁর ‘উইথ ওয়েস্ট বেঙ্গল চিফ মিনিস্টার্স’ বইয়ে নেহেরু ও বিধানচন্দ্র রায়ের এই চিঠি দুটির উল্লেখ করেছেন।

ভারতের সংবিধানে কোথাও লেখা নেই রাজ্যপাল নিয়োগের আগে কেন্দ্রীয় সরকারকে মুখ্যমন্ত্রীদের মতামত শুনতে হবে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, রাজ্যপালদের ক্ষমতা ইত্যাদি পর্যালোচনায় গঠিত বিচারপতি সারকারিয়া কমিশন (১৯৮৪), বিচারপতি এমএম পুঞ্ছি কমিশন (২০০৭)-এর মতো কোনও কমিশন বা কমিটির সুপারিশও তখন ছিল না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেহরু মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দ জানতে চেয়েছিলেন।

আবার সেই নেহরুর কেন্দ্রীয় সরকারই কেরলে দেশের প্রথম নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকারকে কলমের খোঁচায় বরখাস্ত করেছিল। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় তাঁদেরই কেন্দ্রীয় সরকারের ওই ‘মিশন কেরল’-এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত ৭৫ বছরে এরকম অনেক ঘটনার সাক্ষী দেশ। এই ৭৫ বছরে ১৩২ বার সংবিধানের ৩৫৬ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত অথবা হঠাৎ তৈরি হওয়া সাংবিধানিক সংকট মোকাবিলা করা হয়েছে। ১৩২ বারের মধ্যে কংগ্রেস সরকার ধারাটির প্রয়োগ করেছে ৯৩ বার। কারণ, ওই দলটিই বেশিদিন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল।

সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের পর ৩৫৬ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রয়োগ এখন আর মুখের কথা নয়। ফলে কথায় কথায় রাজ্যে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন এখন অতীত। বিজেপি সেই কারণেই কংগ্রেসের ব্যবহৃত একটি অস্ত্র এখন আরও দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করে চলেছে। তা হল সরকার কেনা। রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় পণ্য হল রাজ্য সরকার। দল ভাঙিয়ে সরকার কিনে নেওয়ার খেলা এখনকার মতো অতীতে ছিল না। নরেন্দ্র মোদী দিল্লির কুর্সিতে বসার পর বিজেপি ১২টি রাজ্যে বিধায়ক কেনাবেচা করেছে।

পাশাপাশি এই জমানায় রাজ্যপালদের ভূমিকাও আমূল বদলে গিয়েছে। কংগ্রেস, এমনকী বিজেপির অটল বিহারী বাজপেয়ির সময়েও রাজ্যপালেরা কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গুলিহেলনে বিরোধী দল শাসিত রাজ্য সরকারগুলিকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করেছেন। সেই রাস্তা আদালতের রায়ে সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ায় তাঁরা এখন ভিন্ন ভূমিকা নিয়েছেন।

অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালেরাও এখন রাজনীতিতে একটি বিরোধী পক্ষ। রাজভবন হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই বিরোধী পক্ষের দফতর, যেখানে এবেলা-ওবেলা রাজনীতিকদের আনাগোনা এবং প্রায়ই সাংবাদিকদের সেখানে ডাক পড়ছে।

কিন্তু রাজ্যপালের প্রকৃত ভূমিকা কী? বিধানসভায় রাজ্যপালদের ভাষণে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ‘আমার সরকার’ শব্দবন্ধ লেখা হয়ে থাকে। এই শব্দবন্ধ উল্লেখের কারণ, রাজ্যপালেরা রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান এবং রক্ষক। আর রাজ্যবাসীকে দেখভালের দায়িত্ব নির্বাচিত রাজ্য সরকারের, রাজ্যপালেররা যার অংশ নন। যেমন ভারতের রাষ্ট্রপতির অফিস সংসদের অংশ। রাষ্ট্রপতির ভাষণ দানের মধ্য দিয়ে সংসদের অধিবেশনের সূচনা হয়। যদিও রাষ্ট্রপতি সংসদের কোনও কক্ষেরই সদস্য নন।

কিন্তু উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে বাংলার রাজ্যপাল পদে থাকা জগদীপ ধনকড়, তামিলনাড়ুর বর্তমান রাজ্যপাল এ রবি, কেরলের আরিফ মহম্মদ খান, তেলেঙ্গানার তামিলিসাই সুন্দররাজন, ঝাড়খণ্ডের রমেশ ব্যাসরা চলেছেন সংবিধানে উল্লেখিত ভূমিকার সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে।

শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, কোনও সরকারকেই সার্টিফিকেট দেওয়ার সুযোগ সীমিত। সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে রাজ্যপালের কাজ সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরা। সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে যেমন চমকপ্রদ শূন্য করে রাখা হয়েছে, রাজ্যপালেরা আবার তা নন। তারা রাষ্ট্রপতির বকলমে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি।

ধনকড় বাংলার রাজ্যপাল থাকাকালে কেন্দ্রীয় সরকারকে কতটা কড়াভাষায় রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন জানা যায়নি। কিন্তু রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে শুধু প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণাই করেননি, কার্যত সমান্তরাল প্রশাসন চালাতে চেয়েছেন।

উপরাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী ঘোষণার দিনে বাংলার সেই রাজ্যপালকে বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা ‘জনগণের রাজ্যপাল’ আখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যপালদের কাছ থেকে তাঁরা কী ধরনের কর্মধারা প্রত্যাশা করেন। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে পদে পদে উপেক্ষা করা, রাজ্যপালের মতো মনোনীত পদে আসীন ব্যক্তির অসাংবিধানিক পদক্ষেপকে জনগণের কাজ বলে আখ্যায়িত করার পিছনে কোন লক্ষ্য কাজ করছে বিজেপির?

বাংলার সেই রাজ্যপালের উপরাষ্ট্রপতির মতো সম্মানজনক পদপ্রাপ্তির প্রতিক্রিয়া এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে অবিজেপি শাসিত রাজ্যে রাজ্যপালদের ধনকড় হয়ে ওঠার দৌড় দেখে। কেরলের সিপিএম এবং তামিলনাড়ুর ডিএমকে সরকার রাজ্যপালের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে। দুই রাজ্যেই রাজ্যপালেরা বিধানসভায় পাশ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিল আটকে রেখে রাজ্য সরকারের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছেন। কেরলের রাজ্যপাল উপাচার্য নিয়োগের ক্ষমতা নিয়ে লড়াইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অস্থির পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছেন। বিজেপি শাসিত গুজরাতে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই উপাচার্য নিয়োগে রাজ্যপাল তথা আচার্যের কোনও ক্ষমতা নেই। অথচ, অবিজেপি শাসিত রাজ্যে বিজেপির রাজ্যপালেরা সেই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে মরিয়া। উদ্দেশ্য গুরুত্বপূর্ণ পদে অনুগতদের বসিয়ে উচ্চশিক্ষার গৈরিকীকরণ।

‘ভারত জোড়ো’ অন্য রাহুল, ভিন্ন রাজনীতি

কেরলের রাজ্যপালের সবচেয়ে আলোচিত কীর্তিটি হল মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ। রাজ্যপালদের এমন ক্ষমতা কি সংবিধান দিয়েছে? লোকসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল পিডিটি আচারি এক নিবন্ধে বলেছেন, রাজ্যপালদের এই ক্ষমতা নেই। একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীই কোনও মন্ত্রীকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা রাখেন। রাজ্যপালের ভূমিকা শুধু পদত্যাগপত্র গ্রহণে।

সংবিধানের ১৬৪ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপাল কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং অন্যান্য মন্ত্রীরা মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে রাজ্যপাল কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং মন্ত্রীরা রাজ্যপালের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে পদে আসীন থাকবেন। রাজ্যপালের এই সন্তুষ্টি (Pleasure of the Governor) কখনই একজন মন্ত্রী তাঁর সমালোচনা করলে প্রত্যাহার করে নেওয়া চলে না। তাহলে সংবিধানে উল্লেখিত বাক্ স্বাধীনতাকেই হরণ করা হয়।

কেরলের অর্থমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত বিবাদে নাম না করে রাজ্যপালের ভূমিকার সমালোচনা করেছিলেন। যদিও তা করতে গিয়ে কেরল এবং আরিফের রাজ্য উত্তরপ্রদেশের তুলনা টেনে ঘোরতর অন্যায় করেছেন ওই সিপিএম নেতা। কিন্তু সে জন্য বড়জোর রাজ্যপাল তাঁকে চিঠি লিখে সতর্ক করতে পারতেন। তিনি সে পথে না হেঁটে ক্ষমতা জাহির করতে চেয়েছেন।

লাভদায়ক পদে থাকা সংক্রান্ত বিতর্কে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তথা জেএমএম নেতা হেমন্ত সরেনের বিধায়ক পদ থাকবে কিনা সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন দু-মাস হতে চলল তাদের সুপারিশ রাঁচির রাজভবনে পাঠিয়ে রেখেছে। কিন্তু রাজ্যপাল ব্যাস রা কাড়ছেন না।

বিভিন্ন সূত্র থেকে রাজ্য সরকার জানতে পেরেছে, মুখ্যমন্ত্রীর বিধায়ক পদ খারিজ করার সুপারিশ করেছে কমিশন। কিন্তু রাজ্যপাল কোনও পদক্ষেপ করছেন না। উল্টে ছত্তীসগড়ের সাতবারের বিজেপি সাংসদ ব্যাস দেশের বাড়িতে দীপাবলির ছুটি কাটাতে গিয়ে সাংবাদিকদের ডেকে বলেছেন, অপেক্ষা করুন, ঝাড়খণ্ডে রাজনীতির পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ হবে।

জেএমএমের অভিযোগ, বিজেপিকে বিধায়ক কেনার সময় করে দিতেই সরেনের বিধায়ক পদ নিয়ে এখনও পদক্ষেপ করছেন না রাজ্যপাল। ইতিমধ্যে তিনজন কংগ্রেস বিধায়ক বিপুল টাকা সহ ধরা পড়েছেন।

অতীতের কংগ্রেস শাসনের মতো এই রাজ্যপালদের প্রত্যেকেরই দলীয় রাজনীতির অতীত আছে। বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার মতোই দলের পুরস্কার হিসাবে মেলে রাজ্যপাল পদ। কিন্তু অতীতে রাজ্যপালেরা কেউই প্রকাশ্যে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আজকের মতো পায়ে পা দিয়ে ঝগড়ায় মাতেননি। কথায় কথায় রাজভবনে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে সরকারকে নিশানা করেননি। কেরলের রাজ্যপাল এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের বিরুদ্ধে চোরাকারবারে পৃষ্ঠপোষকতা করার ইঙ্গিত পর্যন্ত করেছেন।

বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি রাজ্যপালের তকমা দিয়ে দলের এই দক্ষ খেলোয়াড়দের মুখ্যত সেই সব রাজ্যে নামিয়েছে যেখানে তারা দুর্বল। বিরোধী দল হিসাবে বিজেপির ভূমিকায় রাজ্যপালেরাই সেখানে সামনের সারিতে। জগদীপ ধনকড় উপরাষ্ট্রপতি হয়ে বাংলা ছাড়াতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে বেশি খুশি হয়ে থাকবেন বোধকরি দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারীরা। কারণ, প্রচারের সব আলো গিয়ে পড়ছিল রাজভবন আর ধনকড়ের উপর। কেরল, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানাতেও তাই। রাজ্যের নেতারা দুদুভাতু, রাজ্যপালেরাই আসল।

কারণ, বিজেপির আসল লক্ষ্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবসার পরিবর্তন ঘটানো। মোদী-শাহ’রা দেশকে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে চান। যে ব্যবস্থায় কেন্দ্রের হাতেই থাকবে যাবতীয় অধিকার ও ক্ষমতা। সেই পথে এগনোর প্রাথমিক পদক্ষেপ হল রাজ্য সরকারগুলিতে ‘নষ্টের গোড়া’ প্রতিপন্ন করা। অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে অপশাসনের নজির বলে দেখানো তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। সেই কাজে দক্ষ ধনকড়কে জনগণের রাজ্যপাল আখ্যা দেওয়ার আসল উদ্দেশ্য রাজ্যপালদের মাধ্যমে জনমনে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যে, কেন্দ্রীয় সরকারই প্রকৃত ত্রাতা।

You might also like