
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়, গঙ্গাসাগর
‘রামদুলারি দেবী, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, দু’নম্বর ঘাটের কাছে আমাদের তথ্যকেন্দ্রে এসে যোগাযোগ করুন। সেখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন ভূপেন্দ্রবাবু।’
গঙ্গাসাগর মেলায় (Gangasagar Mela) রবিবার দুপুরে বেশ কয়েকবার হিন্দিতে চলছিল এই ঘোষণা। একটু পরে অন্য কিছু ঘোষণা শোনা যায় ইনফর্মেশন সেন্টার থেকে। তাতে যেমন রয়েছে কেউ অসুস্থ হয়েছেন বলে অ্যাম্বুল্যান্সের ডাক, তেমনই রয়েছে কুড়িয়ে পাওয়া আধার কার্ডের মালিকের খোঁজ। সেসব সেরে ফের ফিরে আসে রামদুলারি দেবীর হারিয়ে যাওয়ার ঘোষণা।
দু’বার মিষ্টি নারীকণ্ঠে এই একই ঘোষণার পরেই মালুম হয়, মাইক-কর্তার হাত বদল হয়েছে। এবার খাঁটি ভোজপুরী ভাষায় চলছে ডাকাডাকি, ‘ও ভূষণ কি মাম্মি…’ বলে ডেকে বলা হল, তিনি যেন চলে আসেন ডাক শুনেই। গলায় মিশে আছে উদ্বেগ আর আর্তি। আমার প্রায় অনভিজ্ঞ কান বলে, এই ডাক ‘ভূষণের বাবা’র বলেই মনে হচ্ছে। হয়তো কাকুতিমিনতি করে ঘোষকের কাছে থেকে মাইক্রোফোনটি আদায় করেছেন তিনি! আধঘণ্টা পরে ফের ডাক আসে মাইক্রোফোনে, একই কণ্ঠে। ‘ও ভূষণ কি মাম্মি…’ এবার আহ্বান আরও কাতর। শেষ জোড়া হয়, ‘অ্যায়সা অর কাভি না হোয়ে।’

অর্থাৎ আর কখনও এমনটা হবে না। কী হবে না, কার হবে না, তা জানতে পারে না মেলার কয়েক লক্ষ মানুষ, তবে আমার কিঞ্চিৎ-অভিজ্ঞ কান এবার নিশ্চিত করে বলে দেয়, ভূষণের বাবা ছাড়া আর কেউই এমন করে ডাকছেন না ভূষণের মাকে। আর এ নিছক মেলায় হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা নয়, নিশ্চয়ই তিনি কিছু একটা ঘটিয়ে চটিয়েছেন স্ত্রী রামদুলারিকে। রাগ করে স্বামীর হাত ছেড়ে সটান পিছন ঘুরে হাঁটা দিয়েছেন চপলা রামদুলারি, মিশে গেছেন ভিড়ে– এ দৃশ্য মানসচোখে কল্পনা করে নিই আমি।

গতকাল, রবিবার সন্ধেয় গঙ্গাসাগরে শেষ হয়েছে পুণ্যস্নানের মকর তিথি। আহ্নিক-বার্ষিক গতির নিয়ম মেনেই নতুন সকালের নতুন সূর্য প্রবেশ করেছে মকর রাশিতে। আর সেই উপলক্ষে দিন দশেক ধরে উৎসব চলার পরে শুরু হয়েছে মেলা ভাঙার খেলা। কয়েক লক্ষ মানুষ ফের মাথায়-ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন বড় বড় বস্তা, ব্যাগ, বেডিং। পুণ্যস্নান সেরে এবার ঘরের টানে ছুটেছেন তাঁরা। কাতারে কাতারে লাইন দিয়েছেন বাসস্ট্যান্ডে। ভিড়জড়ামড়ি পায়ে এগিয়ে চলেছেন সামনের জনের আঁচলের বা চাদরের খুঁট ধরে। এই শেষবেলায় হারিয়ে গেলে আবার খুঁজে পেতে সে বড় ঝক্কি! মাইকওয়ালারাও তো পসরা গোটাচ্ছেন!

উত্তপ্রদেশের বালিয়া থেকে আসা রঘুরাজ যেমন জিনিসপত্রের বোঝা আর ছোট্টখাট্টো চেহারার বৃদ্ধা মাকে সামলাতে সামলাতে বলেন, ‘প্রতিবারই আসি, ভাবি আর আসব না। কিন্তু মা বায়না করে, ক’দিনই বা বাঁচবে! তাই বছরের ক’টা দিন কষ্ট করতে আসা। প্লাস্টিক পেতে ঘুমিয়েছি, সরকারি লঙ্গরে খেয়েছি। মা তবু খুশি, বছরকার পুণ্যস্নান তো হল! এবার বাড়ি গেলে বাঁচি!’
সত্যিই তাই। এত ভিড়, এত অসুবিধা, এত কষ্টের পরে প্রিয় মানুষটিকে সঙ্গে করে নিয়ে, নির্বিঘ্নে নিরাপদে, নিজের ঘরে ফিরতে পারার মতো বড় পুণ্য আর কী-ই বা আছে!

তবে কষ্টের কথা যখন উঠলই, তখন ফিরে দেখতেই হচ্ছে সেই আগেকার দিনের গঙ্গাসাগর মেলা। তখন না ছিল এই বাস-লঞ্চ-গাড়ির যোগাযোগ, না ছিল এতরকম সুযোগ সুবিধা। প্রায় ২০ বছর ধরে গঙ্গাসাগর কভার করতে আসছেন এমন এক সাংবাদিকের কাছে শুনছিলাম, আগে রেলপথ ছিল লক্ষ্মীকান্তপুর পর্যন্ত। তার পরে সেখান থেকে নামখানা পর্যন্ত আসা ছিল এক ঝক্কির ব্যাপার, আরও কয়েক বার গাড়ি-অটো-ভ্যানের ধাক্কা। তখন তৈরি হয়নি কচুবেড়িয়া-লট এইট কিংবা কচুবেড়িয়া-বেণুবন পয়েন্টে। দিনভর অপেক্ষার পরে মিলত নৌকো। জোয়ার-ভাটার তাল বুঝে, কুয়াশার ভার মেপে, কোনও রকমে দুলে দুলে, প্রাণ হাতে করে এপারে আসা। দুয়েকটা নৌকোডুবি ছিল নিত্যকার ঘটনা। কচুবেড়িয়া থেকে সাগরদ্বীপ পর্যন্ত আবার ভরসা ভ্যান বা গাড়ি। ছিল না পাকা পথও।
লম্বা যাত্রার শেষে কপিলমুণির পায়ের কাছে যখন পৌঁছনো যেত, তখনই সব শক্তি শেষ। স্নানের জন্য শুরু আরেক লড়াই। না এত পুলিশি পাহারা, না এত প্রশাসনিক সাহায্য। ঠান্ডার দমকও তেমন কড়া। শনেশনে উত্তুরে হাওয়ায় স্নান সেরে, ভেজা গায়ে কোনও রকমে মন্দির পর্যন্ত এসে পুজো দেওয়া। এসবের পরে আবার থাকত সেই একই পথে ফেরার আতঙ্ক।

এই যে কথায় কথায় বলা হয়, ‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’, তা কিন্তু পুণ্যের নিরিখে নয়। এ প্রবচন জন্ম নিয়েছিল, এই দুর্বিষহ ও বিপদসঙ্কুল যাত্রাপথের কারণেই। দেশের নানা প্রান্ত থেকে উজিয়ে গঙ্গাসাগর আসতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হতো, দ্বিতীয়বার আর তার মুখোমুখি হতে চাইতেন না কেউ। সেই জন্যই মাত্র ‘একবার’ এসে পূর্ণচ্ছেদ পড়ত পুণ্যলাভের আশায়। কপিলমুণির আশীর্বাদ মিলত জীবনে ওই একটিবারই।
এখন অনেকেই মনে করেন, গঙ্গাসাগরের পুণ্য বুঝি একবার আহরণ করতে পারলেই যথেষ্ট, সেই কারণেই বুঝি এমনটা বলা হয়ে থাকে। তা মোটেই সত্য নয়। সেযুগের যোগাযোগ ব্যবস্থার করুণ চেহারাই এই প্রবচনের জনক।

তবে এখনকার সবরকম ব্যবস্থাপনা চোখে দেখার পরে বিশ্বাস হয়, একবার নয়, বারবারই আসা যায় গঙ্গাসাগর। তাই আসছেনও তো অনেকে। শুধু পুণ্যস্নানের তাগিদেই এই বারবার আসা নয়, ব্যবসা করতেও আসছেন কতজন, কতজন আসছেন শিল্পের টানে, কতজন কেবলই ঘুরতে, এই ভিড়ের উন্মাদনায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে। বারবার ফিরে আসছেন ছবিশিকারি থেকে সাংবাদিকের দলও। থাকা, খাওয়া, পানীয় জল, শৌচব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতা, মেডিক্যাল পরিষেবা– সব মিলিয়ে যতটা যা করা সম্ভব, চেষ্টার ত্রুটি নেই সরকারেরও। কিন্তু সংখ্যাটা যেখানে কয়েক লক্ষ (সরকারি হিসেবে ৬০ লক্ষ), সেখানে পরিষেবার পাহাড় যতই উঁচু হোক, তা শেষমেশ কমই পড়ে।

তবু এ সরকারের অভিনন্দন প্রাপ্য, তেমন বড় কোনও বিপদ বা দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে এই এত বিশাল মাপের এক মেলায়। অভিনন্দন প্রাপ্য কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক তরুণ-তরুণীর। কোভিড-পরবর্তী বাঁধভাঙা ভিড় সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ সামলানো গেছে যথাযথ ভাবে। ২৪ ঘণ্টার অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা দিলেন যাঁরা, যাঁরা মোটরবাইকে করে অগ্নিনির্বাপক নিয়ে মেলাজুড়ে চালালেন নজরদারি, যাঁরা সারারাত ছোট স্পিডবোট নিয়ে সাগরের বুকে টহল দিলেন বিপদ এড়াতে, অভিনন্দন প্রাপ্য তাঁদেরও। অভিনন্দন প্রাপ্য তাঁদের, যাঁরা মেলার কয়েক হাজার সুলভ শৌচালয় একটানা পরিষ্কার রাখলেন এই ক’দিন ধরে, যাঁরা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে আবর্জনা সরালেন মেলাপ্রাঙ্গণ চষে বেরিয়ে।

এত আনন্দ-আয়োজনের মাঝে দুয়েক কুচি অভাব-অভিযোগ যে কান পাতলে শোনা যায় না, একথা বললে মিথ্যে বলা হবে। বিশেষ করে কচুবেড়িয়ার লঞ্চ পরিষেবার বিভ্রাট। কিন্তু তার মূল কারণ প্রাকৃতিক গোলযোগ। ঘনঘোর কুয়াশাই এর পিছনে ভিলেন, যার সঙ্গে লড়তে যাওয়া বোকামি। কিন্তু সব মিলিয়ে এই সুবিশাল ব্যবস্থাপনায়, কয়েক লক্ষ পরিষেবার ভিড়ে, সাগরের ঢেউয়ের মতো জনপ্লাবনের উচ্ছ্বাসে, ওইটুকু সমস্যা পেরিয়ে যাওয়া যায় বলেই মনে হয়। ঠিক যেমন করে তটভরা কাদা-বালি-মাটি-পাঁক পেরিয়ে, চটিজুতো খুইয়েও, লক্ষ লক্ষ মানুষ ঠিক ছুঁয়ে ফেললেন পুণ্য মোহনার ঢেউটুকু!

তাই মোটেই একবার নয়, গঙ্গাসাগর বারবারই।
ভূষণের মাম্মির খোঁজ কিছু পরে থেমেছিল ইনফরমেশন সেন্টারে। তবে ভূষণের বাবার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের মুহূর্তটা কেমন ছিল, লজ্জার না ভর্ৎসনার, তা দেখা হয়নি। তাই তা দেখতে আরও একবার যেতে হবে। সেই পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে সাইকেল চালিয়ে গঙ্গাসাগরে এসে করোনাভাইরাস সেজে ঘুরে বেড়ানো মানুষটি পরের বার কী সেজে এসে জনসচেতনতার বার্তা দিলেন, তা জানতেও আবার যেতে হবে বইকী! আর সেই আসমা খাতুন! ছোট্ট সে মুসলিম কন্যার হাতের চুম্বকে গেঁথে যায় হিন্দু পুণ্যার্থীদের দানের খুচরো পয়সা! সে পয়সার বিনিময়ে চাল এল কি তার ঘরে, তা দেখতেও তো যেতে হবে সেই গঙ্গাসাগরেই! নিজের হাতে ভাইকে মেরে ফেলা সুপান সিং কি মুক্তি পেলেন অনুশোচনার আগুন থেকে, সে উত্তরও তো লুকিয়ে গঙ্গাসাগরেই।

বারবার গঙ্গাসাগরে ফিরেই হয়তো খোঁজ মিলবে এসব উত্তরের, বা হয়তো শেষমেশ মিলবে না কিচ্ছুটি। এ সংশয় পারাবার হয়তো অন্তরেই পার করতে হবে! কিন্তু সাগরের ঢেউয়ের মতোই অনন্ত সেই খোঁজে এভাবেই বছর বছর পুণ্যমেলা মেতে উঠবে উদার ছন্দে, পরমানন্দে… এই খোঁজের আহ্বানেই কত মানুষের ধারা দুর্বার স্রোতে এসে এক হবে… দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে… এই বাংলার মহামানবের সাগরতীরে!





























