শেষ আপডেট: 8th September 2023 11:11
জি-২০ র আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনকে (G20 Summit 2023) সামনে রেখে রাজধানীতে এখন সাজো সাজো রব। এই জি-২০ বা ‘গ্রুপ অফ টোয়েন্টি’ হল বিশ্বের ১৯ টি গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফোরাম, পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে যা গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ভারত (India) এই গোষ্ঠীর সদস্য। জি-২০ র এবারের থিম, "বসুধৈব কুটুম্বকম" অর্থাৎ “এক পৃথিবী - এক পরিবার - এক ভবিষ্যত”। বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলিকে মোকাবিলা করতে পৃথিবীব্যাপী যৌথ ও কার্যকরী ঐক্য গড়ে তুলে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যত সৃষ্টি করাই এই সম্মেলনের লক্ষ্য। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বৈঠকের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক লেনদেন এবং বোঝাপড়া বাড়িয়ে, বিশ্বের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির সহযোগিতামূলক সমাধানের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে।
বিশ্ব জুড়ে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য নিরাপত্তার (World Hunger) প্রশ্নটি এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ - একাধিক গবেষণায় যা প্রমাণিত। রাষ্ট্রপুঞ্জের “ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম'-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে , বিশ্বের ৭৯ টি দেশের প্রায় ৩৪ কোটি মানুষ গভীর খাদ্যসংকটে রয়েছে (World Hunger)। আবার খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বলছে, প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির হার তুলনামূলক ভাবে কমছে। এই অবস্থায় ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে আনুমানিক ৯০০ কোটি মানুষের খাদ্য সংস্থান করতে অতিরিক্ত প্রায় ৭০% খাদ্য উৎপাদন করতে হবে।
এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের একটা বড় অংশ ছোট চাষি। পরিস্থিতির পরিহাসে যারা বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য উৎপাদন করেন তাদেরই দু বেলা খাবার জোটে না। চরণদাসের গানের কথাগুলির সঙ্গে কী মিল “সোনার ফসল ফলায় যে, তার দুই বেলা জোটেনা আহার”। কিন্তু, ‘সুস্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্য ২'- এর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল গোটা বিশ্বে সকল মানুষের জন্য ক্ষুধার নিবৃত্তি, খাদ্য সুরক্ষা ও পুষ্টির বৃদ্ধি। এখানে ‘খাদ্য সুরক্ষা’র অর্থ হল সমস্ত মানুষের জন্য ‘পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর ‘ খাবার পাওয়ার অধিকার ও আর্থিক সঙ্গতি, যা ১৯৯৬ সালে রোমে বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে, স্থির করা হয়েছিল।
আবার ‘গ্লোবাল ফুড পলিসি রিপোর্ট ২০২২' অনুযায়ী পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষিতে সংকট ক্রমশ বাড়ছে। এর দরুন বিশ্বের প্রায় সাড়ে ৬ কোটি মানুষের ভুখা থাকার আশঙ্কা রয়েছে। আগামী বছরগুলিতে কৃষি যে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং এর দরুন পৃথিবীর তাপমাত্রার বৃদ্ধি সমস্ত ফসলের উৎপাদনকে কমিয়ে দিয়েছে যা নিয়ে নীতি নির্ধারকরা যারপরনাই চিন্তিত। সুতরাং বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব থেকে কৃষি উৎপাদনকে রক্ষা করে বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান দেওয়াই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে পৃথিবীতে ভুট্টা, গম, ধান এবং সয়াবিনের ফলন যথাক্রমে ৭.৪% , ৬%, ৬.২% এবং ৩.১% কমবে। আবার, গড় তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে এশিয়া এবং আফ্রিকায় খাদ্যের উৎপাদন ২০-৪০% হ্রাস পেতে পারে। ‘ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-২০১৮’- এর পঞ্চম মূল্যায়ন রিপোর্ট অনুযায়ী ২১০০ সালের আগে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ২.৫-৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবেই। ফলে ধান, গম সহ সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, জোয়ার এবং টমেটোর উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হবে। তাই কৃষিবিজ্ঞানীদের পরিবেশ বান্ধব, সহনশীল কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে।
এই মুহূর্তে কৃষিবিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ থেকে কৃষিকে বাঁচাতে ‘ক্লাইমেট-স্মার্ট এগ্রিকালচার’ বা সিএসএ-এর পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশ্ব ব্যাংকের সংজ্ঞানুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কাঠামোয় খাদ্য নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কৃষি কর্মসূচীকে একত্রে ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার বলে। এর মূল লক্ষ্য একাধারে সুস্থায়ী কৃষি উৎপাদন, ফসলের অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবকে ঠেকানো।
নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) তাঁর ভাষণে, কৃষিক্ষেত্রে চিরাচরিত ও আধুনিক পদ্ধতির মেলবন্ধনে জোর দেন। তিনি বলেন, ভারত প্রাকৃতিক চাষের পাশাপাশি প্রযুক্তি-নির্ভর কৃষিতেও সমান গুরুত্ব দিয়েছে। কৃষকরা কৃত্রিম সার বা কীটনাশকের পরিবর্তে একদিকে যেমন জৈব বিকল্প ব্যবহার করছেন অন্যদিকে তেমনই কৃষি উত্পাদনশীলতা বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তির সক্রিয় প্রয়োগ করছেন। তাঁরা নিজস্ব তত্বাবধানে তৈরি সৌরবিদ্যুৎকে চাষের কাজে ব্যবহার করছেন, কীটনাশক স্প্রে করতে ড্রোনকে কাজে লাগাচ্ছেন। কৃষকেরা মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে চাষের জন্য উপযুক্ত ফসল নির্বাচন করছেন । কৃষি উৎপাদনশীলতার স্থায়ীত্ব বজায় রাখতে ভারত একদিকে যেমন বাজরা, কুইনোয়া, জোয়ারের মত জলবায়ু সহনশীল ও পুষ্টিকর শস্য চাষে জোর দিয়েছে অন্যদিকে তেমনই ধান, গম এবং ভুট্টার মতো চিরাচরিত ফসলগুলিকেও গুরুত্ব দিয়ে চাষ করছে । এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমান বছরকে বাজরার আন্তর্জাতিক বছর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাজরা উৎপাদন সংক্রান্ত গবেষণা ও প্রযুক্তি কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ভারত ‘ইনস্টিটিউট অফ মিলেটস রিসার্চ’ তৈরি করেছে। ফসল হিসেবে বাজরা শুধু পুষ্টিকরই নয়, প্রতিকূল পরিবেশে কম জল ও কম সার প্রয়োগে ভাল ফলন দেয়।
জি -২০ (G20 Summit 2023) ভুক্ত দেশগুলির কৃষি ও অর্থমন্ত্রীদের অনুরোধে ২০২২ সালে ফাও , বিশ্ব ব্যাংক এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কতকগুলি উচ্চস্তরের নীতি সম্বলিত রিপোর্ট তৈরি করেছিল যা ডেকান উচ্চস্তরের নীতিমালা নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী হায়দ্রাবাদের বৈঠকে ঘোষণা করেন যে 'খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সম্পর্কিত এই ডেকান উচ্চস্তরের নীতিমালা' এবং বাজরাসহ অন্যান্য শস্যের জন্য যে 'মহাঋষি’ উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে তার সফল প্রয়োগ করা হবে। এই নীতি এবং উদ্যোগগুলি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সুস্থায়ী এবং স্থিতিস্থাপক ভাবে কৃষির উন্নয়ন ঘটাবে। কৃষিকে আরও শক্তিশালী করবে। পাশাপাশি, কৃষিতে উদ্ভাবন এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ক্ষমতায়ন ঘটাবে।
জি -২০ ভুক্ত দেশগুলির কৃষি উৎপাদক, ভোক্তা এবং রপ্তানিকারিদের সম্মিলিত প্রয়াসে একটি স্বচ্ছ, সুস্থায়ী, সহনশীল, ভারসাম্যযুক্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক খাদ্য ‘ উৎপাদন ও বন্টন’ ব্যবস্থা আগামীদিনে গড়ে উঠবে – এই আশা করাই যায়। মন্ত্রীরাও আশাবাদী তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টা এবং পারস্পরিক সহযোগিতায় সুস্থায়ী কৃষি বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বের ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূর করা সম্ভব হবে। এখন দেখার বিষয় বিশ্বে ‘খাদ্য সুরক্ষা ও পুষ্টি’কে সুনিশ্চিত করতে জি - ২০ শীর্ষ সম্মেলন ২০২৩ (G20 Summit 2023) থেকে কী বেরিয়ে আসে এবং খাদ্য সংকট (World Hunger) দূর করতে আগামী দিনে ভারতই বা কী ভূমিকা নেয়।
(লেখক কৃষি অর্থনীতির গবেষক)
মতামত ব্যক্তিগত
আরও পড়ুন: উপনির্বাচনে ইন্ডিয়া ৪, এনডিএ ৩, লোকসভায় বিজেপির হার নিশ্চিত, দাবি মমতা, কংগ্রেসের