
গত কয়েকদিনে কলকাতা ও অন্যত্র বিদ্যুৎস্পৃষ্ট (Electrocuted) হয়ে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনাটি আজকের। বিগত কয়েক বছর যাবৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে।
প্রতিটি ঘটনার পর প্রতিক্রিয়াগুলিও একপ্রকার চেনা চিত্রনাট্য। প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। তদন্ত চলে। ইতিমধ্যে কয়েকজন শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু তাতে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে কি?
গত ২৬ জুন সন্ধ্যায় হরিদেবপুরে বিপজ্জনক বাতিস্তম্ভে হাত লেগে মারা যায় নীতীশ যাদব। ক্লাস সিক্সের ছাত্র নীতীশের বাড়ি ছিল হাফিজ মহম্মদ ইশাক রোডে। সেদিন বিকালে বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তায় জলও জমেছিল। তার মধ্যে দিয়ে এক শিক্ষকের বাড়িতে পুজোর প্রসাদ পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল ১২ বছরের ছেলেটি। জমা জলের মধ্যে সম্ভবত কোনও গর্তে পা পড়েছিল তার। টাল সামলানোর জন্য সে পথের ধারে থাকা ল্যাম্প পোস্টে হাত দিয়েছিল। তখনই সে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বালকটি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার এক ঘণ্টা পরে পুরসভার কর্মীরা এসে ওই বাতিস্তম্ভের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। তখন নীতীশকে উদ্ধার করে বিদ্যাসাগর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
একটি ১২ বছরের ছেলের জীবন বিপন্ন জেনেও পুর প্রশাসন সেখানে এক ঘণ্টার আগে কোনও কর্মীকে পাঠাতে পারেনি।
নীতীশের মৃত্যুর পরে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম দ্রুত তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দেয় ২৯ জুন। কমিটির সুপারিশমতো ১১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মজবুরা খাতুনকে সাসপেন্ড করা হয়। এর পরেও নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, পুরসভার বড়কর্তাদের আড়াল করতেই কি ওই ইঞ্জিনিয়ারকে তড়িঘড়ি শাস্তি দেওয়া হল?
গত ২ জুলাই ভোরে বাঁকুড়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান পার্বতী ঘোষ। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে অনঙ্গমোহন ঘোষ নামে অপর এক ব্যক্তিও প্রাণ হারান। পার্বতীর বাড়ি বাঁকুড়া ২ ব্লকের ভূতশহর এলাকায়। বাড়ির খুব কাছ দিয়ে গিয়েছে বিদ্যুতের হাইটেনশন তার। একটি তার ছিঁড়ে মাটিতে পড়েছিল। ভোরবেলা গোয়ালে যাওয়ার সময় সেই তারের ওপরে পার্বতীর পা পড়ে। তখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন অনঙ্গমোহন। তিনি মহিলাকে বাঁচাতে ছুটে আসেন।
২ জুলাই সন্ধ্যা নাগাদ কলকাতায় মুষলধারে বৃষ্টি হয়। সেই সময় নারকেলডাঙা এলাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় মহম্মদ ফরজান আনসারি। ১৩ বছরের ছেলেটি টিউশন সেরে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল। জমা জলের মধ্যে দিয়ে আসার সময় তার পা পিছলে যায়। টাল সামলানোর জন্য সে বিদ্যুতের খুঁটিতে হাত দিয়ে ফেলে। প্রায় ২০ মিনিট পরে তাকে উদ্ধার করে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
গত ৩ জুলাই সন্ধ্যায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান উলুবেড়িয়ার বাসিন্দা সুব্রত মণ্ডল। ২৫ বছর বয়সি সুব্রতর বাড়ি ছিল উলুবেড়িয়ার ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ গঙ্গারামপুরে। তিনি এক বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন। সন্ধ্যায় সাইকেল চালিয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। এমন সময় রাস্তায় পড়ে থাকা একটি তার সাইকেলের চাকায় জড়িয়ে যায়। তারটি খুলতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন সুব্রত।
কলকাতা ও জেলার বহু জায়গাতেই রাস্তায় পড়ে রয়েছে বিদ্যুতের তার। রাস্তার পাশে রয়েছে বিদ্যুতের বিপজ্জনক খুঁটি। সেগুলির দিকে প্রশাসন নজর দেয় না। এতে বোঝা যায়, প্রশাসনের অভ্যন্তরে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বাসা বেঁধেছে। একশ্রেণির কর্মী ইচ্ছামতো ফাঁকি দিচ্ছেন। যা খুশি তাই করছেন। তাঁদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই। আসলে বিশৃঙ্খলা রয়েছে প্রশাসনের উঁচু মহলেও। তাই নিচুতলার কর্মীরা ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যায়। রাস্তায় পড়ে থাকা বিপজ্জনক বিদ্যুতের তার যে সরানো উচিত, সেকথা কারও মনে থাকে না। একসময় পুরসভার ইনস্পেক্টররা বিদ্যুতের খুঁটি ও তারের ওপরে নজরদারি করতেন। এখন সেসব উঠে গিয়েছে।
সর্বোপরি নাগরিকদের একাংশের মধ্যেও রয়েছে বেপরোয়া মনোভাব। তাঁরা নিজেদের বা অপরের নিরাপত্তা নিয়ে আদৌ চিন্তিত নন। সবকিছু যেন ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন।
সেই সুযোগে পুরসভাও নাগরিকদের ওপরে দোষ চাপিয়ে নিজের গাফিলতি ঢাকার চেষ্টা করে।
যেমন সামান্য বৃষ্টিতেও শহরে জল জমে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে পুরকর্তারা ম্যানহোলের মুখে প্লাস্টিক আটকে থাকার কথা বলে নাগরিকদের দিকে আঙুল তোলেন। একথা ঠিক, শুধু প্লাস্টিক কেন, যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলা আমাদের একটি মস্ত বড় অপরাধ। কিন্তু শহরের রাস্তায় জল জমে যাওয়ার আসল কারণ সময়মতো ম্যানহোলের ঢাকনা না খোলা। এই কাজে পুর কর্মীদের নিষ্ঠার অভাব স্পষ্ট।
বিদ্যুতের ছোবলে নাগরিক মৃত্যুর প্রকৃত কারণ যেমন, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মৃত্যুফাঁদগুলিকে উপেক্ষা করা।
কলকাতা যেমন প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো শহর, তেমনই দেশের প্রথমসারির নগরী, সরকারি মানদণ্ডে মেট্রোপলিটন শহর। সেই শহরে মৃত্যুর এত আয়োজন যে অপ্রিয় সত্যের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়, তা হল, চোখ ধাঁধানো শপিং মল, উড়ালপুল, পাঁচতারা হোটেল, পথে ত্রিফলা আলোক স্তম্ভের নজরকাড়া আয়োজনের মধ্যে সাধারণ নাগরিকের জীবন এখনও কতটা অরক্ষিত, অসহায়।
যে কোনও দুর্ঘটনার পরে কিছুদিন হইচই হয়। তড়িঘড়ি তদন্ত কমিটি তৈরি হয়। দু’-একজন শাস্তিও পায়। তারপরে সবাই দুর্ঘটনার কথা ভুলে যায়। মানুষের জীবন নিয়ে এই উদাসীনতা দূর না হলে আগামী দিনেও দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।