মির্জাপুর স্ট্রিট, আমহার্স্ট স্ট্রিট আর হ্যারিসন রোডের মাঝে একটা ত্রিকোণ। তাতে তিনটে বাড়ির একটা দোমহলা। পিছনের অংশটিতে, ট্রামলাইনের উপর, প্যারামাউন্ট বোর্ডিং হাউস। দোমহলার সামনেরটাতে, পশ্চিমে, বেঙ্গল বোর্ডিং। পুবে ইন্টারন্যাশনাল লজ। শ্রদ্ধানন্দ পার্কের দিকে ইন্ডিয়া হোটেল।
উনিশশো আটাত্তর সালের পর কেটে গেছে একচল্লিশ বছর! এই সময়টাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের একটা দেশই পৃথিবী থেকে— মানুষের স্বপ্ন থেকেও— হুশ করে উধাও। কয়েক শতাব্দী পর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে বসেছেন এক কৃষ্ণাঙ্গ। বীরভূমে, আমাদের ছোট্ট গাঁয়ে, বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। পৌঁছেছে টিভি, ফ্রিজ, গ্যাস। কান টানলে মাথার মতো এই সেদিন এল স্ট্রিট লাইট। গাঁয়ে এখন বেশ কয়েকটা টোটো। বেড়ে গেছে পাকা রাস্তায় মোটরবাইক আর অপার বৈষম্য।
এখানে? পুরো ত্রিকোণটিকে কেউ ‘শেক ওয়েল বিফোর ইউস’ ভেবে কষে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে। ফলে ইন্ডিয়া হোটেলের জায়গায় এসেছে হোটেল শ্রীদুর্গা। অবশ্য ‘বাংলাদেশী বোর্ডার রাখা হয়’। আমার মেস প্যারামাউন্টের সঙ্গে বেঙ্গল জুড়ে এখন অতিব্যস্ত একটা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল। ইন্টারন্যাশনাল লজটি কিন্তু আজও রয়ে গেছে। ইয়োরোপীয় একটা দল একবার নামের ফেরে সেখানে উঠে কী-যে ল্যাজেগোবরে হয়েছিল, তার বিবরণ হাসতে হাসতে শুনেছিলাম রুমমেট তপনের কাছে।
বলা হয়েছিল দশটা থেকে বেলা একটার মধ্যে যেতে। দশটাই বাজে। ঢুকব? পা থমকে গেল। নাহ, চা খাই।
গোয়েন্দাদের চিরকালীন আশা— অপরাধী তার সৃষ্ট অপরাধে কিছু-না-কিছু আত্মচিহ্ন রেখে যাবেই। যদি ভুল করেও রেখে গিয়ে থাকে, তার সৃষ্টি খুঁতযুক্ত এবং ব্যর্থ। ধুরন্ধর গোয়েন্দারা দিনের পর দিন সেই আশায় সব কিছু তন্নতন্ন করে খোঁজে। তারা বাড়তি একটা সুবিধেও পায়। পরে আসার সুবিধে। অপরাধী তার কাজ করে যাওয়ার পর গোয়েন্দারা মঞ্চে প্রবেশ করে। প্রথমজন সংশোধনের কোনও সুযোগই প্রায় পায় না। দ্বিতীয়জন বারবার নিজের সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
সেই গোয়েন্দাদের বাড়তি একটু সুযোগ দিতে গোপনে ফিরে এসেছি অকুস্থলে। কেননা তাঁরা পাঠক। মঞ্চে এখন তাঁরাই আমাকে খুঁজছেন। যদি খুঁটিয়ে দেখতে চান, কী দেখছেন তাঁরা?
পুটিরামকে বেড় দিয়ে যে-দোকানটাতে চা খেতাম, চার দশক পরে দাঁড়ালাম সেই দোকানে। এখন ভাইপো। সে-ও প্রৌঢ়। চা-ও প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছে। আমহার্স্ট স্ট্রিটের ওপাশে শুভ্র তুষারের বদলে কয়েক পরত ময়লা-বসা এভারেস্ট কাফে থাকার কথা। নেই। সেখানে এখন ফিনিক্স— ঝকঝকে গিফট সপ। ওপাশেই সুরভি ভাণ্ডার। ঢাকাই পরোটা ছিল পেল্লায় আর বহু পরতবিশিষ্ট। শক্ত কিন্তু খাস্তা। ভেঙে ভেঙে ছোলার ডাল-সহযোগে খেতে হত। কেন যে ঢাকাই, কেউ জানে না। এখনও কী করে যেন রয়ে গেছে! সেই অ্যাসবেস্টসের ছাউনি, দোতলা বাড়ি, তার নীচে।
আর রয়ে গেছে আইডিয়েল হোমিওপ্যাথিক স্টোর। এপারে, মির্জাপুর স্ট্রিটের কোণে। ফাঁকা দেখে ঢুকে পড়ি। মৃদু গন্ধ। থাকবন্দি ছোট-ছোট ঘুমন্ত সব শিশিবোতল। কত বছর?
শ্লেষ্মা জড়ানো গলা—তা নব্বই তো হল।
পেরিয়ে গেছে না কি?
ওপাশের মধ্যবয়স্ক—কেন বলুন তো?
না, এমনিই।
ফের পুটিরাম। ক্ষীরের চপ সাজানো হচ্ছে। খাবো? খেয়েই ফেলি। খেতে খেতে দেখি, দরবেশগুলো আগের মতো কাচ-স্বচ্ছ নেই। কেমন গেবে গেছে। স্বাদও কি? ট্রামলাইনের ওপারে বাটার ছোট্ট শোরুমটি হাপিস। কীসের-যে দোকান হয়েছে, বোঝা গেল না। অবশ্য গোটা কলকাতাতেই এখন এমন দোকান বহু, যারা ঠিক কী বেচতে চাইছে, বাইরে থেকে বোঝা মুশকিলের।
আর না। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে দশটায়। চৌকাঠ পেরোই। একচল্লিশ বছর পর। লক্ষ করলাম— ডান পা আগে গেল। মেঝেয় গ্রানাইট টাইলস। সাদা ঝকঝকে দেওয়াল। ডানদিকের দেওয়ালে আঁকা মাদার টেরিজা। বাঁদিকে দেওয়াল জোড়া ইংরেজিতে— সৈয়দ মুরাদ সেবা মিশন। টানা লেখা। অল ক্যাপস।
সেই সুড়ঙ্গপথ। সামনে সিঁড়ির আভাস। মাথার উপর— ‘ফ্রি হোমিয়ো ক্লিনিক’ লেখা বোর্ড। তাতে লায়ন ড. সৈয়দ মুরাদ আহমেদের স্মৃতিতে ক্লিনিকটি চলার উল্লেখ। বাঁদিকে যেখানে ছিল খোলা উঠোন, সেখানে তালাবন্ধ কাচের দরজা। ভেতরে উঠোন জুড়ে ঝকঝকে ক্লাসঘর। মাথায় তার ছাদ। তাহলে রান্নাঘর, খাবার ঘর? আরে, সামনে তো একটা দরজা! তালাবন্ধ নাকি? আস্তে ঠেলা দিতে খুলে যায় নিঃশব্দে। কাঠের পিঁড়িতে বসে আমাদের সেই খাবার ঘরটা না? কয়েক সার বেঞ্চ, সামনে স্যরের চেয়ার-টেবিল। ডানাওয়ালা একটা ক্লাসঘর কবে যেন উড়ে এসে বসেছে আমাদের সেই ডাঁটা চিবোনোর ঘরে। তাহলে রান্নাঘরটার পরিণতি কী? দেখা হল না।
বাকি রইল সিঁড়ি। না, বাকি নেই। মার্বেলে পা দিয়ে উঠতে হল। এবং দেখতে হল দোতলাটা। অনেক মাথা খাটাতে হয়েছে। একাধিক প্রকৌশলীর পরামর্শ নিতে হয়েছে। তবেই মাঝের উঠোনটা পেয়েছে এমন ব্যবহারযোগ্যতা। চারিদিকে ক্লাসঘর। সকালের প্রাইমারি সেশন শেষ হয়েছে। ডে সেশন শুরুর মুখে। হইহই করে আসবে বড়রা। তার আগের নিঃস্তব্ধতা। যেন ভাটা শেষে জোয়ারের থমথমে ভাব। দূর থেকে দেখতে হল কোণের ঘরটি। আন্দাজে বুঝে নিতে হল—ওটাতেই আমি থাকতাম। তার একটা ঘর আগে ছিল সিঙ্গল রুম। কাঠের তক্তার পার্টিশন। এখানে তক্তা? ধুর! সেসব গেছে। কাউকে যদি বলি—ওই ঘরে এক সদ্যবিবাহিত দম্পতি এসে কয়েক মাস ছিল, কেউ বিশ্বাস করবার জন্যে দাঁড়িয়েও নেই এখানে।
কিন্তু তারা কি সত্যিই দম্পতি ছিল? না-হলেই-বা। ছিল তো একসঙ্গে কিছুদিন। ম্যানেজারবাবু তাড়া দিতেন—আর কত দিন? উত্তর আসত মেয়েটির কাছ থেকেই—বাড়ি খুঁজছে তো ও। আর একটা মাস সময় দিন আমাদের।
একবার হয়েছে কি, রাতে চিকেন রান্না করে খাওয়া হবে। কে করবে রান্না? তপনের উত্তর— সে ভাবতে হবে না। বউদি আছে। একটা প্রেসার কুকারও আছে বউদির। সেদিন আমাদের ঘরে মেয়েটির ঘনঘন যাওয়া-আসা। একসময় শুরু হল রান্নাপর্ব। সব মশলা মেখে পাঁচ লিটারের প্রেসার কুকারেই ঘণ্টাখানেক মেরিনেট করা হল মাংস। তারপর স্টোভ জ্বেলে বসিয়ে দেওয়া হল। মাঝেমাঝেই মেয়েটি— এসব ক্ষেত্রে সুন্দরী হতেই হয়— দেখে যায়। হুইসল ক-টা পড়ল? দু-টো? ঠিক আছে। ফের এসে— ক-টা? কে আর গুনছে! মাংস রান্নার গন্ধে ঘর ভর্তি আর তাতেই সবাই খুশি। একসময় তপনের বউদির উদ্বেগ— এত দেরি তো হওয়ার কথা নয়! সবার মুখের দিকে একঝলক তাকিয়ে সে নিজের বিশ্বস্ত কুকারটাকে দেখতে থাকে। ফুসফুস করে ভাপ বেরোচ্ছে। বেরোতে বেরোতে ফুসস করে তীব্র হুইসল। কী মনে হল, স্টোভ বন্ধ করে দিল মেয়েটি।
রাত ততক্ষণে দশটা পেরিয়ে সময়ের উপর সর পড়তে শুরু করেছে। খেতে বসা হল হইহই করে। পরিবেশনের দায়িত্বেও স্বেচ্ছায় সে, অর্থাৎ সেই তরুণী বধুটি। এতগুলো ভাশুর, দেওরকে খেতে দেওয়ার ভাগ্য কি হবে আর? মাংস আর ভাত। আর কিচ্ছু রাখা হয়নি। কিন্তু ভাশুর-দেওররা খেতে বসে বিপদে পড়ল, নাকি বধূটিই— বুঝতে সময় লেগেছিল খানিকটা। সরাসরি প্রেসার কুকার থেকেই সে দিচ্ছিল পাতে পাতে। কিন্তু তার হাতায় শুধু ঝোল! মাংস কোথায়? মাঝেমধ্যে দু-একটা হাড়। একেবারে সাদা। সানলাইটে কাচা। আশ্চর্য, মাংসগুলো গেল কোথায়? বেচারা মেয়েটি, তার কোনো দোষ ছিল না, লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। তার তো জানার কথা নয় যে, দেওর-ভাশুরদের দায়িত্বজ্ঞান কোনও কালেই থাকে না। কেউ কোনওদিন হুইসল গোনার ঝক্কি নেয়নি যে!
তিনতলায় ওঠার ইচ্ছে আর হয়নি। দেখিনি কমলবাবুর ঘরটার কী হাল। ওদিকের কোণে সুধীরবাবুর ঘরটাই-বা কেমন থাকতে পারে, আন্দাজ হচ্ছিল।
চৌরঙ্গীতে আজ যদি কোটালিপাড়ার সেই ভট্টাচার্যিমশাই এসে দাঁড়ান, দেখেন তাঁর গম্বুজধারী সাধের প্রাসাদটিকে, নামে যেটি মেট্রোপলিটন ম্যানসন, ভিতরে যত্রতত্র পার্টিশন আর গলি আর বহুবিভক্ত ভাড়াটে বাহিনী, যার স্বত্ব এখন এলআইসি-র— কী ভাববেন?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবো, উপর থেকে হাঁক— উঠবেন না? দাদা অবশ্য বেরিয়ে গেছেন। আসুন, চা খেয়ে যান।
এক মধ্যবয়স্ক। সাদা পাজামা, খাদির পাঞ্জাবি। উঠি। ডানদিকের ঘরে এক মহিলা কাজে ব্যস্ত। অফিস হয়তো-বা। খোলা ছাদ ছিল যেটা, সেটা এখন লোকজন বসার বড় ঘর। এককোণে দু-তিনটে টেবিলের উপর হাজারো ট্রফি। নেতা-নেত্রীর ছবি। পৌঁছনো মাত্র কাগজের কাপে চা। বিস্কুট তিনি হাতে ধরে আছেন-- খালি পেটে চা খেতে নেই। নিন।
খালি পেটেই খেলাম। চারিদিকের নতুন কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে। বিশেষ করে চোখে পড়ছিল একটা সিঁড়ি। মাঝখানের নতুন ছাদ থেকে যেটা উঠে গেছে নবনির্মিত চারতলায়। কী বিসদৃশ! যেন সুস্থ কোনও মানুষ জমকালো একটা ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে!
দ্রুত নেমে আসি সিঁড়ি বেয়ে। এত দ্রুত যে ভয় করছিল, এখনই বুঝি তপন বা প্রসেনজিৎ কেউ হয়তো-বা একচল্লিশ বছরের ওপার থেকে চেঁচিয়ে ডেকে উঠবে— অ্যাই একরামদা, যাচ্ছেন কোথায়!