একরাম আলি
ক্লাস সেভেন থেকে নাইন-- বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সেরা সময়। আর, এমন সুকর্মটি জীবনে একবারও যদি কেউ না-করে, মনুষ্যপদবাচ্য সে হবে কী করে!
তখন নাইন। ফলে, কোত্থেকে-যে ঝাঁক-ঝাঁক কী-সব এসে মাথার ভেতর বাসা বেঁধেছে, কেন, কিসের, টের পেলাম এক
ক্লাস সেভেন থেকে নাইন-- বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সেরা সময়। আর, এমন সুকর্মটি জীবনে একবারও যদি কেউ না-করে, মনুষ্যপদবাচ্য সে হবে কী করে!
তখন নাইন। ফলে, কোত্থেকে-যে ঝাঁক-ঝাঁক কী-সব এসে মাথার ভেতর বাসা বেঁধেছে, কেন, কিসের, টের পেলাম এক সোমবার হোস্টেলে যেতে যেতে। ভূতুবাবুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখি-- নানা দিক থেকে বাস আসছে যেমন, যাচ্ছেও তো। জেলা স্কুলের মুসলিম হোস্টেল তখন সোনাতোড়পাড়ায়। একটু হাঁটলেই হয়। দু-পা। না-হেঁটে পড়ায় মন বসে গেল। বাসে বাসে লেখা-- দুমকা, দেওঘর, ভাগলপুর, রামপুরহাট, বোলপুর, দুবরাজপুর, সাঁইথিয়া, আহম্মদপুর। দেখা এবং না-দেখা আরও সব জায়গার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গাছপালা, মানুষজন, নদী, পুকুর, রেললাইন, ভাগ্যে থাকলে পাহাড় আর জঙ্গল— সব দেখা যাবে এসব বাসের কোনও-একটায় উঠে পড়লেই। কিন্তু, কোন বাস? কেনার সময় হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যে-ভাবে পেয়ারা, নামগুলো উলটেপালটে দেখছি— কোনটা কেমন। দুমকা— ভয়-ভয় করছে। পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে সে-যে কোথায়! দেওঘর-ভাগলপুর? আরও। রামপুরহাট অচেনা। কিন্তু পালানোর মতো কি? সাত-পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত দুবরাজপুরের বাসে। ক্লাস সেভেনে মামা-ভাগনে পাহাড় আর হেতমপুর রাজবাড়ি ঘুরে দেখার জন্যে কিনা জানি না, মুখওয়ালা ছোট বাসটাকে ভরসাযোগ্য মনে হয়েছিল।
কোলে হোস্টেলের ব্যাগ। তাতে জামাকাপড়। বলতে নেই, ছোট বয়ামে মায়ের দেওয়া ঘি। দু-একটা বইপত্র। জানালার ধারে বসে আছি সেই ব্যাগটি আঁকড়ে। বাস-অফিসের উলটোদিকে বক্সি মিয়ার হোটেল। শীতের সকালে গরম পুরি আর কলেজি ভুনার গন্ধ। হাতের লক্ষ্মী ছেড়ে যাওয়া কি উচিত? মাছি ভনভন করছে যদিও, অজানার উদ্দেশে পাড়ি বলে কথা! আর কি খাবার জুটবে? ভরপেট খেলাম ঠিকই, তবে বলতেই হবে-- সিউড়ির মাছিগুলো ছিল দশাসই চেহারার। মুক্ত নর্দমায় ঘুরেফিরে কালচে নীল। আমাদের গাঁয়ের মতো ফ্যাকাসে আর মিনমিনে ছিল না।
তবু, তখনকার সিউড়ি ছিল হাতের তালুর মতো নরম আর সুন্দর এক জনপদ। তারও একযুগ পর-- কিছুটা নষ্ট ততদিনে হয়েছে-- কলকাতা থেকে একদল বন্ধু-সহ সেই সিউড়ি। নতুন সার্কিট হাউসে তিনতলার ছাদে উঠে এক বন্ধু উচ্ছ্বসিত— এ কোথায় নিয়ে এলে? এ যে বাল্মীকির দেশ!
বাস কখন যেন চলতে শুরু করেছে। সিউড়ি ছাড়িয়ে যাবে-যাবে, কন্ডাকটর এল টিকিটের দাবি নিয়ে। তাই তো, কোথায় যাব আমি? ফস করে বেরিয়ে এল— দুবরাজপুর। টিকিট কাটা শেষ। যাক, ময়লা চামড়ার ব্যাগ কাঁধে লোকটা আর ঘ্যানঘ্যান করবে না। আস্ত একটা জানালা আমার দখলে। সিউড়ি ছাড়িয়ে মাঠ। ধানকাটার পর ঢেউখেলানো তেপান্তর। তারপর এল আঁকাবাঁকা এক ক্ষীণস্রোতা কাঁদর। গালভরা তার নাম-- চন্দ্রভাগা। ডানদিকে, নদীর এপাড়ে ছোট্ট গাঁ। ওপাড়ে বিরাট এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইমারতের ধ্বংসস্তূপ। আগাছার জঙ্গল। কোথাও ইটের চৌকো দেওয়াল পুরনো কক্ষের চিহ্ন নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে। কোথাও লতাপাতায় জড়িয়ে একাকী গোল থাম। পরিত্যক্ত নীলকুঠি। বাঁদিকে, অদূরে গ্রাম। জানা গেল— মল্লিকপুর আর কচুজোড়। তারপর শুরু হল মুড়ো-হয়ে-যাওয়া আদিম জঙ্গল। কোথাও কোথাও পাথুরে মাটি ফুঁড়ে কচি শাল-চারা। শীতে পত্রহীন হলে কী হবে, হাজার হাজার বছরের স্মৃতি থেকে বেড়ে উঠতে চাইছে। চারাগুলো আজও আশা করে, এক-দেড়হাত মাটি খুঁড়ে কেউ তো বের করে আনবে পাথর। ঘসে ঘসে অস্ত্র বানাবে। তারপর গভীর জঙ্গলে ছুটে যাবে শিকারের দিকে। প্রাণরক্ষার সেই আড়াল তো দিতে হবে বুভুক্ষুকে। সেইসব শাল-পিয়াল-মহুয়ার চারাগুলো জানত না, মাত্র এক-দেড় দশকেই সেসব মুড়ো জঙ্গল সাফ করে মাটি ফুঁড়ে ভয়ঙ্কর সব দানবের মতো উদ্ভিদ গজিয়ে উঠবে। আকাশছোঁয়া, গনগনে, চিমনির পর চিমনি। অতিকায় বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। তার আগে মিনি স্টিল প্ল্যান্ট। পরে ঘন জঙ্গল কেটে বারুদ কারখানা।
সেই বারুদ কারখানার হাল এখন নীলকুঠির মতোই। তার ইমারতের গা থেকে খুলে খুলে জানালা-দরজা, ইট, কারা নিয়ে গেছে। মিনি স্টিলের হাল? ভবিষ্যতের ভূত হওয়ার অপেক্ষায়। কালের নিয়মে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চুল্লিগুলোও একদিন নিভে যাবে। তার আগে ভূপৃষ্ঠের হাল এতটাই নষ্ট করে যাবে যে, সেই অরণ্য আর ফিরবে না।
তখনও এসব কিছুই হয়নি। তাই, একটু পরই জানালায় জঙ্গল এসে দেখা দিল নিজের ইচ্ছেয়। মনটা শনশন শব্দে ঢুকে গেল জঙ্গলের ভিতরে। যাচ্ছি, যাচ্ছি। আচমকা বাসে ঘণ্টা। কন্ডাকটরের হাঁক— কচুজোড়, কচুজোড়।
কচুজোড়? নামটা চেনা-চেনা যেন? এখান থেকে সাহাপুর কত দূর? যাত্রা? কাছেই হবে নিশ্চয়। কাকা তো এই পথে একবার যাত্রা গিয়েছিল শুনেছি। গোরুর গাড়িতে। বাস ছাড়বে-ছাড়বে। হুটপাট করে নীচে। কন্ডাকটর চেঁচাচ্ছে— এই ছেলে! ইটো কচুজোড়। দুবরাজপুর অনেক দূর।
হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করার আগেই বিকট শব্দে বাস চলতে শুরু করেছে।
জঙ্গল এখানে কিছুটা পাতলা। আশপাশে ঘন। রাস্তা ঘেঁসে, ওপাশে, জুগজুগ করছে একটা চা-দোকান। মাটির খোড়ো ঘর। দু-একজন বসে। খাঁ-খাঁ রাস্তা। চারপাশে জঙ্গল। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেশ সাবালক-সাবালক ভাব। কিন্তু আরেকটু দরকার যে! কী সেটা? জানা গেল— সিগারেট বলতে চার্মিনার। তা-ই সই। এক প্যাকেট। আর দেশলাই। কোনও প্রশ্ন ছাড়াই উঠে এল হাতে।
এমন নয় যে শীতকালে সূর্য ওঠে না। বেলা দশটা-সাড়ে দশটা বেজে গেলে তার রোদও পাকতে শুরু করে। রাস্তা জেনে দক্ষিণমুখো হাঁটা শুরু হল। মাইল ছয়েক পথ। জঙ্গলের ভিতর একটু এগিয়ে বেশ কসরত করে ঠোঁটে সিগারেট। কার নকল? মনে নেই। উত্তমকুমারও হতে পারে, বিলিয়ার্ডের স্টিক হাতে বোর্ডে ঝুঁকে-পড়া লিজ ক্লাবের রাকিব সাহেবও হতে পারে। উকিল ভদ্রলোকটি প্রতি বিকেলে ক্লাবে গিয়ে প্রথমে টেনিসে ঘাম ঝরাতেন। তারপর লম্বা, ফর্সা, সুস্বাস্থ্যটি নিয়ে সন্ধ্যের মুখে ঢুকতেন বিলিয়ার্ড রুমে।
বেমক্কা কাশি। প্রাণ বেরিয়ে যায়-যায়। আল জিভে এসে থমকে গেছে। দরকার ছিল জল, যা নেই। নাহ, সাবালক হওয়া বেশ এলেমের ব্যাপার। সামলে নিয়ে ফের হাঁটা।
কিন্তু বাড়ি থেকে পালানোর কাজটি বেশ ঝামেলার। মাইলখানেক হাঁটার পর যাত্রা যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হল। হাজার হোক, কাকার শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ির চেয়ে ভায়রাভাইয়ের বাড়ি কি নিরাপদ নয়, যদি সে-বাড়িতে সমবয়সী কেউ থাকে? মনু ছিল তেমনই। হিসেবে মাসতুতো ভাই। দাদা নিশ্চয়ই কলকাতায়, হোস্টেলে। মনুকে বুঝিয়ে বললে নিরাপদে থাকা যাবে কয়েকদিন। কিন্তু গ্রামের নাম যে সিজা। মানে আরও দু-মাইল। মোট আট।
এত হাঁটাহাঁটি, মনে জোর নিয়ে বেরিয়ে পড়া-- ব্যর্থই হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। চার-পাঁচদিনের মাথায় ঠিক ধরা পড়ে যাই। একেক সময় মনে হয়, সে-লজ্জার পাশে আর সবই ম্লান। কিন্তু, এটুকু জীবনে এমন তো কতই হয়েছে। কোনও কাজই তো ঠিক মতো করা হয়ে উঠল না।
তবে, মেস থেকে কিন্তু পালানো যায় না। কেউ পালায়নি। মেস ছেড়ে অন্য কোথাও যায়। যায় স্থায়িত্বের সন্ধানে। যেমন কেউ কেউ যায় বাড়ি ছেড়ে। যারা বাড়ি ছাড়ে, তারা চিরতরে ভিটেহারা হয়ে যায়। অস্থায়িত্বই তাদের ভবিতব্য।
আমাকেও মেস ছাড়তে হল একদিন। আটাত্তর সালে। মে-জুন মাসে। কিন্তু কোনও কাজই তো সফলভাবে করতে পারিনি। স্থায়ী ঠিকানা পাইনি। তাই হয়তো-বা প্যারামাউন্ট নামের মেসটি থেকে গেল সঙ্গে। যেমন বীরভূমের বাড়ি।
কিন্তু যাবো কোথায়? সমস্যা তো আমার নয়, কফি হাউসের টেবিলের সমস্যা। সেই টেবিলেই ভাস্করদা (চক্রবর্তী) দু-একদিন সময় চাইলেন। কেউ কেউ অবাক, ভাস্করদার মতো কম কথার মানুষ এত বড়ো দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন!
দু-একদিন নয়, ভাস্করদা একটু বেশিই সময় নিয়েছিলেন। তবে হতাশ হওয়ার মতো বেশি নয়। একদিন-- সম্ভবত শনিবার-- কফি হাউসে এসে তাঁর ঘোষণা: সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কাল সকালে একরাম যাবে বরানগর। বমাল।
অতএব, চলো বরানগর।